নির্বাচন শুরু হয়ে গেছে। নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত ব্যস্ত এটা প্রমাণ করতে যে ভারতীয় গণতন্ত্র অটুট আছে, কারণ ইতিমধ্যেই ইভিএম নিয়েই যে প্রশ্ন উঠছে সেগুলো নির্বাচন কমিশনকে ভাবাচ্ছে।ইভিএম কি সত্যিই প্রযুক্তি দিয়ে প্রভাবিত করা সম্ভব? তাহলে কি আমি আপনি যে ভোট দিচ্ছি তার কোনও মূল্য নেই?কোনও গোপনীয়তা নেই?আমি আপনি যে সরকার গঠনের কথা ভেবে ভোট দিচ্ছি তার কোনও দাম নেই? নির্বাচন কমিশনও এই বিষয়ে ভাবনা চিন্তা করছেন, তাই এবারের নির্বাচনে তারা একটা নতুন যন্ত্র সমস্ত বুথে সমস্ত মেশিনের সঙ্গে জুড়ছেন তার নাম ভিভিপ্যাট, বা ভোটার ভেরিফায়েবেল পেপার ট্রেল। এটা অনেকটা কম্পিউটারের সঙ্গে যুক্ত প্রিন্টিং মেশিনের মতো। কোনও ভোটার তাঁর পছন্দসই প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার পর এই মেশিন দিয়ে বোঝা সম্ভব আদৌ তাঁর ভোট ঠিক জায়গায় পড়েছে কিনা?৭ সেকেন্ড অবধি এই কাগজের স্লিপটি দেখা যাবে তারপর এটি ভিভিপ্যাট মেশিনের স্টোরেজে চলে যাবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কিছু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। বিভিন্ন মহল থেকে নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রশ্ন করা হচ্ছে যার উত্তর এখনও অবধি নির্বাচন কমিশনের কাছে নেই।
কি সেই প্রশ্ন?
১। যদি দেখা যায় একজন ভোটার তাঁর প্রদত্ত ভোট নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করলো তাহলে নির্বাচন কমিশন কি করবে? এখনও অবধি যা জানা গেছে নির্বাচন কমিশন সেই ভোটারকে সবার উপস্থিতিতে পুনরায় সেই ভোটারকে ভোট দিতে বলবে, এবার যদি ঠিক হয় তাহলে কি তাঁর আগের করা অভিযোগটি মিথ্যে বলে গণ্য হবে? গণতন্ত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী কে? যে ভোট দিচ্ছে সে, না নির্বাচন কমিশন? অনেক সময়ে আমরা এই ধারণা নিয়ে থাকি হয়তো নির্বাচন কমিশন সবচেয়ে শক্তিশালী অথচ নিজের ভুমিকা আমরা বিস্মৃত হই যে গণতন্ত্রে “আমি” সবচেয়ে শক্তিমান। সেই কথাটাও মনে করিয়ে দিতে আমাদের জন্য বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন বা নির্বাচন কমিশনের ফোন নম্বর বা ইমেল আইডি দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমাকে কেন প্রমান করতে হবে আমি সত্যি অভিযোগ করেছি এবং মিথ্যেবাদী নই?
২। যদি দেখা যায় বারবার একই অভিযোগ ঘটছে তাহলে নাহয় নির্বাচন কমিশন তখনকার মতো নির্বাচন প্রক্রিয়া বন্ধ রাখবে কিন্তু আমাদের মতো দেশে যেখানে ইভিএমে ভোট বিষয়টাই এখনও সড়গড় হয়নি ভোটকর্মীদের কাছেই সেখানে কতজন মানুষ ভিভিপ্যাট মেশিনের দিকে খেয়াল রাখবেন বা রাখলেও তা নিয়ে অভিযোগ করবেন? এতে কি চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার ভয় থাকছে না? একবার একটি বুথে এই ধরনের অভিযোগ উঠলে কি সেই ইভিএম মেশিনটাই প্রশ্নের মুখে পড়েনা?
অনেকে বলছেন এই ইভিএম সংক্রান্ত ভয়টা অমূলক এই মেশিন নিয়ে সবসময়েই কোনও না কোনও বিরোধী দল প্রশ্ন তুলেছে কিন্তু শেষ বিচারে এটা প্রমানিত হয়েছে যে এই মেশিনকে প্রভাবিত করা সম্ভব নয়। কিন্তু সত্যি কি তাই? তাহলে গত রাজস্থান, ছত্তিসগড় কিংবা মধ্যপ্রদেশ এর নির্বাচনে এমন অভিযোগ এসেছে কেন যে ইভিএম মেশিন হোটেলের ঘরে পাওয়া গেছে?এর সম্পূর্ণটা কি মিথ্যে অভিযোগ?
এর পরে আসছে ভিভিপ্যাট মেশিন গোনার বিষয়টি। নির্বাচন কমিশন যা নিয়ে এখনও ঐক্যমত্যে আসতে পারেনি।প্রাক্তন আইপিএসদের মধ্যে থেকে ৭৩ জন একটা প্রস্তাব দিয়েছে প্রতি বিধানসভার অন্তর্গত ৫০ শতাংশ ভিভিপ্যাট গুনতে হবে। নির্বাচন কমিশন দিল্লির স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের কাছে এই বিষয়ে রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে, যতদূর জানা যাচ্ছে তারা একটা রিপোর্ট জমাও করেছেন। কিন্তু সেই রিপোর্টে কি আছে তা এখনো প্রকাশিত হয়নি।এর মধ্যে প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার ডঃ এসওয়াই কুরেশি একটি অনলাইন পোর্টালে তাঁর নিজস্ব মত লিখেছেন।কিছু দিন আগে যখন বেশ কিছু বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং অন্যান্যরা ৫০%ভিভিপ্যাট গোনার জন্য সওয়াল করছেন তখন কুরেশি সাহেবের এই প্রস্তাব কিন্তু অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য মনে হতে পারে। কিন্তু তা কতটা বাস্তবসম্মত সেই প্রশ্নও করছেন কেউ কেউ। উনি কি প্রস্তাব দিয়েছেন?উনি বলেছেন ক্রিকেটের মতো, রানার্স আপ দুটো দলের তরফ থেকে বেছে নেওয়া হোক যে কোনও দুটি ভিভিপ্যাট মেশিন, সেই দুটো মেশিন কে গোনা হোক তাতে সময় বাঁচবে এবং মানুষের প্রশ্নেরও নিরসন হবে।
কিন্তু কয়েকটা বিনীত কথা।
ক) এটা ভারতের গণতান্ত্রিক নির্বাচন, কোনও টি২০ ক্রিকেট ম্যাচ নয়, এর মধ্যে দিয়ে আপনি সাময়িক উত্তেজনা অনুভব করতে পারেন, কিন্তু এই নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তের একজন অত্যন্ত সাধারণ নাগরিক কিন্তু অন্তত একদিনের জন্য হলেও নিজেকে এবং নিজের ভোটকে মুল্যবান মনে করেন। ক্রিকেটীয় বিচারপদ্ধতি্র সঙ্গে এর পরীক্ষা পদ্ধতি মিলিয়ে ফেলাটা কি অতি সরলীকরণ হয়ে যায় না?
Like our Facebook Page
খ) এই গণতন্ত্রে যে মানুষটি নোটাতেও ভোট দেবেন তাঁর ভোটেরও কি সমান মূল্য থাকেনা, যিনি এই পরিচিত রাজনৈতিক দলগুলোকে ভোট দিচ্ছেন তাঁর ভোটের সঙ্গে? সুতরাং শুধু রানার্স আপ দলগুলো যা চাইবে সেটাকেই মান্যতা দেওয়া হবে এটা কোন ধরনের গণতন্ত্র?এটাও কি একধরনের আধিপত্যবাদী চিন্তা চাপিয়ে দেওয়া নয়?
গ) সময় বাঁচানোর যে যুক্তি বারবার কেউ কেউ দিয়ে থাকেন সেটাকে খণ্ডন করতে গিয়ে যদি এটা বলা হয় প্রায় ৫০ দিনের এই রাজসুয় যজ্ঞে আর ২টো দিন বেশী গেলে কি খুব কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?এর মধ্যে নির্বাচন কমিশন সুপ্রিম কোর্টের কাছে জানিয়েছে যে ইভিএম গোনার পর যদি ৫০% ভিভিপ্যাট তাঁদের গুনে ফলাফল ঘোষণা করতে হয় তাহলে আরও ৬ দিন বেশী সময় লাগবে,পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি পাল্টা যুক্তি চলছেই।
নির্বাচন কমিশনের কি উচিত নয় আরও বেশী স্বচ্ছতা, আরও বেশী গোপনীয়তা , আরও বেশী সঠিক যাতে হয় সেদিকে নজর দেওয়া? কোনও মতে একজন শাসকের হাতে দেশকে তুলে দিতে পারলেই কি নির্বাচন কমিশনের দায় এবং দ্বায়িত্ব শেষ হয়ে যায়?যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী ট্যুইট করে বলেন যাতে বেশী সংখ্যক মানুষ এই নির্বাচনে অংশ নেন তখন কি নির্বাচন কমিশনের কাজটা আরও কঠিন এবং দ্বায়িত্বশীল হয়ে পড়েনা?এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে আরও বেশী মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা দেওয়ার?একে একে যখন প্রায় সমস্ত সংস্থার স্বশাসন নিয়েই প্রশ্ন উঠে যাচ্ছে তখন সেটাকে রক্ষা করার দায় তো এই প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরই বর্তায়।না হলে তো এই নির্বাচন প্রক্রিয়াকেই প্রহসন মনে হতে পারে কারুর।
সমস্ত কিছু কি ক্রিকেটের মতো ব্যাটসম্যান বা বোলার বা ফিল্ডার বদল করার সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া যায়?
0 Comments
Post Comment