সুন্নত দিলে হয় মুসলমান
নারীর তবে কী হয় বিধান
বামুন চিনি পৈতে প্রমাণ
বামনি চিনি কেমনে রে!
সাম্প্রতিক কালে দিল্লির হিংসায় এক পুরুষ সাংবাদিককে প্যান্ট খুলে লিঙ্গ দেখাতে বলেছিল ঘাতকের দল, যাতে তাঁর লিঙ্গ দেখে বোঝা যায় তিনি হিন্দু না মুসলমান। কীভাবে? লিঙ্গের খৎনা হয়ে থাকলে তিনি মুসলমান, নচেৎ হিন্দু। খৎনা হয়ে থাকলে শরীরের অগ্রভাগ নামিয়ে দিয়ে তাঁকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে। যদিও এই চিহ্ন দেখে ধর্মীয় পরিচয় পাওয়ার বিষয়টি এত সরল নয়। এই ঘটনার তার পর থেকে সোশাল মিডিয়ায় খৎনা নিয়ে বহু আলাপ-আলোচনা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। সে প্রসঙ্গে দু চার কথা।
‘খৎনা’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল—পুরুষের লিঙ্গাগ্রচর্মচ্ছেদন। পুরুষের শিশ্নমুণ্ডি আবৃত করে রাখা অগ্রত্বক কেটে বাদ দেওয়া। কেউ কেউ একে ‘মুসলমানি’ বলে থাকেন। যদিও ইহুদি ধর্মে ও খ্রিস্টানদের একটি অংশে খৎনা আবশ্যিক ধর্মীয় রীতি বলে পরিগণিত। ইসলাম ধর্মে এটি ‘সুন্নত’-এর একটি অংশবিশেষ। ইসলাম ধর্মে বহু পালনীয় বা সুন্নতের মধ্যে এটিও একটি। স্বাস্থ্যের কারণে, অগ্রত্বকের বিভিন্ন ব্যাধির কারণে অনেক পুরুষকে খৎনার পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকেরা। অগ্রত্বক লিঙ্গের মুণ্ডিকে ঢেকে রাখে বলে মিউকাস আবরণীতে অবস্থিত অসংখ্য গ্রন্থি থেকে স্মিগমা নামক দুর্গন্ধ বস্তু জন্মে এবং নানা প্রকার অসুখের সূচনা করে। পৃথিবীর প্রায় ৩০ শতাংশ পুরুষের খৎনা হয় এবং তার শতকরা ৬৮ ভাগ মুসলমান।
খৎনা ভাল না খারাপ, সেই আলোচনায় ঢোকার আগে এর উৎপত্তি ও ইতিহাস নিয়ে কিঞ্চিৎ জেনে নেওয়া দরকার। ধর্মীয় পুরাণ ঘাটলে দেখা যায়, সেমীয় ধর্মের আদি পিতা আব্রাহাম খৎনার প্রচলন করেন। যে জন্য তিনটি সেমীয় ধর্ম—ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলামে এই প্রথা আজও দেখা যায়। ইহুদি ও মুসলমানেরা এই প্রথা কঠোরভাবে মেনে চললেও খ্রিস্টানদের সকলে মানেন না। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, খৎনার উৎপত্তি প্রাচীন মিশরে, যেখানে ইহুদি ধর্মের উৎপত্তি।
তবে গ্রিক ও রোমানরা মনে করত লিঙ্গের অগ্রত্বক থাকাটা পুরুষের বীরত্বের পরিচায়ক। তারা খৎনাকে বর্বর প্রথা হিসাবেই দেখত। তাই এসব থেকে শত হস্তে দূরে থাকত তারা। মিশরে এই প্রথা শুরু হওয়ার সপক্ষে অনেকে ইহুদি ধর্মের মোজেসের কথা বলে থাকেন। তিনিই আব্রাহামীয় ধর্ম বলে কথিত আচারব্যবস্থাসমূহকে পৃথিবীতে ঐতিহাসিকভাবে প্রথম প্রচার করেন। তোরাহ ও বাইবেলে অগ্রত্বকচ্ছেদনকে ঈশ্বরের সঙ্গে আব্রাহামের একটি চুক্তি হিসাবে উল্লিখিত আছে। ইহুদিদের মধ্যে এই প্রথা চালু থাকলেও খ্রিস্টানরা সম্ভবত ৫০ খ্রিস্টাব্দে চার্চ কাউন্সিল ইন জেরুজালেমে ডিক্রি জারি করে একে ঐচ্ছিক বলে ফরমান দেন। বর্তমানে কেবল কপটিক খ্রিস্টানরা এটা পালন করে থাকেন। মধ্যযুগের ধর্মবেত্তা টমাস একুইনাস এই প্রথা নিয়ে বহু কথা বলেন যার মধ্যে খৎনার বিরোধিতা প্রবল।
এই বার আসা যাক ভাল-মন্দের প্রশ্নে। নৈতিকতা দেশে কালে ভিন্ন ভিন্ন। লালন সেই কবে বলে গেছেন, পাপ পুণ্যের কথা আমি কারে বা শুধাই/এক দেশে যা পাপ গণ্য অন্য দেশে পুণ্য তাই। আমেরিকায় খৎনার হার সবচেয়ে বেশি হলেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের একটি বড় অংশ খৎনার বিরুদ্ধে। নেহাত শারীরিক প্রয়োজন ছাড়া ডেনমার্ক ও সুইডেনে খৎনা নিষিদ্ধ। তবে আফ্রিকার কিছু অংশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খৎনার পক্ষে প্রচার চালায়। মহাত্মা লালন বলছেন, দেশ সমস্যা অনুসারে ভিন্ন বিধান হতে পারে/সুক্ষ্মজ্ঞানে বিচার করলে পাপ পুণ্যের আর নাই বালাই। গরমের দেশে খৎনা করলে ফাইমোসিস নামক রোগ থেকে নিস্তার পাওয়া যায় বলে চিকিৎসকেরা মনে করেন। এইচআইভি ইত্যাদি সংক্রমণ এড়াতে খৎনা কার্যকর ভূমিকা পালন করে। কিন্তু যখন এটাকে ধর্মীয় বাধ্যতার জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয় তখন ওঠে ব্যক্তির ইচ্ছে-অনিচ্ছের প্রশ্ন। ওঠে শরীরের অধিকারের কথা। কেন ধর্মের নামে শরীরের একটি খুব ছোটো অংশ বাদ দিয়ে দেওয়া হবে। অবাঞ্ছিত হলেও তা বাদ দেওয়া উচিত ব্যক্তির সম্মতি নিয়ে। কিন্তু কৈশোর বা প্রাক-কৈশোর অবস্থায় খৎনা আবশ্যিক হলে তাকে নৈতিকভাবে সমর্থন করা যায় না। অবশ্য এর বিরুদ্ধেও অনেক যুক্তি আছে। কারণ অপ্রাপ্তবয়স্কের অসুখ-বিসুখ করলে বা কোনও অঙ্গ কর্তন করতে হলে তার অভিভাবক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কিনা সেই প্রশ্ন গুরুতর। পরবর্তী জীবনে এই প্রথা মানুষের যৌনজীবনে কোনও প্রভাব ফেলে কিনা সেই প্রশ্নটিও গুরুতর। বিশেষজ্ঞরা বলেন, লিঙ্গের অগ্রভাগের ত্বক কেটে দিলে যৌন সংবেদনশীলতা খানিকটা কমে যায় বলে পুরুষ অধিক সময় রমণ করতে পারে।
সাম্প্রতিক কালে দিল্লির হিংসায় যে পুরুষ সাংবাদিককে প্যান্ট খুলে লিঙ্গ দেখাতে বলা হয়েছিল তিনি মুসলমান, ইহুদি হতে পারেন কিংবা কপটিক খ্রিস্টান। অথবা, রোগজনিত কারণে তাঁর ত্বকচ্ছেদন হয়েছিল এবং তিনি হিন্দুও হতে পারেন। শুধু তাই নয়, বহু পুরুষ জন্মগতভাবে লিঙ্গের অগ্রত্বক ছাড়াই জন্মান। ঘাতকের দলের অবশ্য সে সব শুনতে বয়ে গেছে!