‘সবটা জানি বলেই বললাম।’ নিবিড় ঠান্ডা গলায় উত্তর দিল।
দেওয়ালে টুনির আলো জ্বলছে। ড্রয়িং রুমে এদিক ওদিক কুশনগুলো ছড়ানো।সেন্টার টেবিলের উপর দুটো পুজো সংখ্যা।দূরে সাইড টেবিলের ওপরে সুগন্ধি মোম জ্বলছে। ল্যাম্ব, চপ-কাটলেটের গন্ধে ঘর একবারে ম ম করছে। নিবিড় জানে বাড়িতে এমন আয়োজন কোন কোন সন্ধ্যায় হয়।
আজ নিশ্চয়ই বিদিতা আর রাত্রি আসবে। গদ্য পাঠের আসর বসবে। সারা সন্ধ্যা হা হা হি হি। একটা গল্পও পড়া হবে না। তার পর নেটফ্লিক্স খুলে সম্ভ্রান্ত সেক্স ওয়াচ। সহেলিকে এক প্লেট ভাত মাংস চটকে খাইয়ে দেবে নিবিড়।দাঁত মেজে, ফ্লস করে সহেলি বাবার দিকে তাকিয়ে এক গাল হাসি দেবে।বলবে, ' কাল স্কুলের পর কাউন্সিলিং সেশনে যাবে তো?' নিবিড় মাথা নেড়ে সম্মতি জানালে পনেরো বছরের সহেলি দোতলায় উঠে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে দেবে।এপাশ ওপাশ হতে হতে গভীর রাতে ঘুমিয়ে পড়বে।
এদিকে ড্রয়িং রুমে আড্ডা চলবে রাত একটা দেড়টা পর্যন্ত।অভ্যস্ত হয়ে গেছে নিবিড়। গত বারো বছর ধরে পেনসিলভেনিয়ার ম্যালভার্ন শহরের হাইওয়ে, গ্রসারির দোকান, মেয়ের স্কুল, লাইব্রারির রাস্তা প্রভৃতির মতোই অহনার স্বভাবের সঙ্গে দিনভর মানিয়ে নেয় সে।
বছরের পর বছর অহনাকে প্রায়োরাটাইজ করেছে নিবিড়।ভেবেছে, এতে স্ট্রেস কমবে। কিন্তু, ক্রমশ আরও স্পষ্ট হয়েছে যে, অহনাকে সুখী করা প্রায় অসম্ভব। অহনা জানে না সে কী চায়।
একটা প্রডাক্টিভ সংসার? একমাত্র মেয়ের সুস্থ বেড়ে ওঠা? অফিসের প্রমোশন? এই দেশের বাঙালি সাংস্কৃতিক জগতে বিশেষ এক নাম হয়ে ওঠা?
এ বছর সেপ্টম্বরের মাঝামাঝি বেশ জমিয়ে ঠান্ডা পড়ে গেল। সূর্যাস্তের পর বেরলে গায়ে হালকা জ্যাকেট জড়াতে হয়। ঘণ্টা দেড়েক হল রাত্রি আর বিদিতা চলে এসেছে। পাশের ঘর থেকে সমস্তটা শোনা যাচ্ছে।গল্পপাঠ দূরের কথা, একটা বইয়ের পাতাও উল্টে দেখেনি তিনজন।
নিবিড়ের এক হাতে মদের গ্লাস, অন্যহাতে সিগারেট।সেটা ধরাবে বলে ব্যাকইয়ার্ডের দরজা খুলেছে, এমন সময় রাত্রি ডাকল, 'নিবিড়দা, আজকাল তোমার পাত্তাই পাওয়া যায় না। কী খবর? শুনলাম, এলেনার সঙ্গে রুদ্র আজকাল প্রায়ই রাত করে বাড়ি ফিরছে?'
নিবিড় ঘুরে রাত্রির দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিল, 'তাতে তোর কী?' শুরু হল এমন একটি কথোপকথন যা নিবিড় আসলে রাত্রিকে বলতে চায় না।কথাগুলো অহনার কানে দেওয়াই উদ্দেশ্য।
'না, আমার আর কী? পাড়াময় রটছে...'
'তাতেই-বা তোর কী?'
'সে তুমি যাই বলো নিবিড়দা। আমরা এমন কোনও আমেরিকান সমাজে বাস করছি না যে, যা-খুশি করে বেড়াব।'
'বেশ। তা, যা-খুশি বলতে কী বোঝায় বলবি? কে সিদ্ধান্ত নেবে আমরা কী করে বেড়াব? তুই নাকি তোদের এই সিউডো ইন্টেলেকচুয়াল দল? কথায় কথায় যাদের ভাল লাগা বদলায়, ট্যালেন্ট বদলায়।প্রতি মাসে একটা করে নতুন শখ জন্মায়।কখনও গান গাইব, কখনও কবিতা পাঠ করব।'
'অমন করে বলছ কেন, নিবিড়দা? বিভিন্ন ট্যালেন্ট চেষ্টা না করলে বুঝব কীভাবে নিজেদের ভাল লাগাটা?'
নিবিড় এতক্ষণ মাথা নিচু করে কথা বলছিল।কড়া দৃষ্টিতে ড্রয়িং রুমটা আর একবার চোখ ঘুরিয়ে দেখল।তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, ‘ ওহে নির্বোধ, ভাল লাগা জন্মায় ছোটবেলায়।মধ্য জীবনে বড়জোর সেই ভাল লাগাটা নারচার করা যায়।বুঝেছিস?'
সেন্টার টেবিলের ওপর থেকে একটা পুজো সংখ্যা হাতে তুলে বিদিতা মুখ বেঁকিয়ে বলল, 'আমরাও নারচার করছি।'
নিবিড়ের মুখে মলিন হাসি।চোখের কোণ দিয়ে অহনাকে দেখছিল সে। কতটা আহত হল অহনা? কতটা অপমানিত হল? সন্ধ্যার পর সন্ধ্যা ড্রয়িং রুম জুড়ে অহনার খামখেয়ালিপনা অনেক আশকারা দিয়ে এসেছে সে। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের লাজুক, মনযোগী মেয়েটা এই দেশে এভাবে বদলে গেল কবে, নিবিড় টেরই পেল না। সারাক্ষণ মেজাজ বিগড়ানো। বাঁকা বাঁকা কথা।বিখ্যাত হওয়ার দৌড়ে প্রাণমন নিবেদন করে রেখেছে! অদ্ভুত অবাস্তব এক পাগলামি!
অহনা সোফার এক কোণে বসে সব কথা শুনেছে। আচমকা উঠে এসে নিবিড়ের বুকে ধাক্কা মেরে বলল, ' তুমি কথাগুলো কাকে বলছ, আমাকে… না ?'
নিবিড় ভুরু উঁচু করে স্বজোরে অহনার হাত সরিয়ে বলল, 'ইয়েস! বুঝেছ দেখছি।'
অহনা দ্রুত তেড়ে এল নিবিড়ের দিকে, 'তুমি কী চাও? আমি শুধু অফিস আর বস্তাপচা সংসার করি?'
নিবিড়ের ঠোঁটে আবারও তাচ্ছিল্যের হাসি, 'সেটাও কি ঠিকঠাক পারবে? আমি কী চাই বড় প্রশ্ন নয়। তুমি যেটা পারো সেটাই করো। অতিরিক্ত ট্যালেন্ট দেখানোর ভিড়ে নিজের ফ্রি ফর্মটা নষ্ট করছ তুমি! এই এই এই যে…এই আড্ডা বসাও। কী আলোচনা হয়ে এখানে? অন্যের আড়ালে গসিপ। গসিপের কন্টেন্ট কী? কে কার সঙ্গে বিছানায়!'
'তাতে তোমার কী?' অহনা চেঁচিয়ে ওঠে। নিবিড়ের কানে প্রশ্নটা আর্তনাদের মতো শোনায়। অহনার চুলের মুঠি ধরে ঝগড়া করতে ইচ্ছে করছে। সেটা সম্ভব নয়। বিদিতা আর রাত্রি গোটা ম্যালভার্ন শহরে রটাবে, নিবিড়দা অ্যাবিউসিভ হাজবেন্ড।
রাগ সামলে নিবিড় বলল, 'আমার অনেককিছু! আমার সংসারটা টেকাতে হবে! একটা হাই স্কুলের মেয়ের লেখাপড়া রয়েছে। তোমাদের মতো হাওয়ায় গা ভাসিয়ে চলি না..’
‘ছাড়ো! তুমি আসলে আমাকে ঈর্ষা করো! কী ভাবো? বুঝি না আমি!’
‘কতটা নির্বোধ তুমি অহনা! আরে বিয়ের পর তোমার হাতে ভাল সাহিত্য তুলে দিয়েছিল কে, অহনা? ক্লাসিক্যাল গান শোনাতে শিখিয়েছিল এই উল্টোদিকের লোকটাই!’
তুড়ি মেরে নিবিড় হঠাৎ রাত্রি আর বিদিতাকে বেরিয়ে যেতে ইশারা করল, 'দাম্পত্যের ঝগড়া পার্সোনাল।তখন আশপাশের লোকজন স্বামী স্ত্রীকে একলা ছেড়ে চলে যায়। এটুকুও শিখে আসিসনি তোরা? নাকি এই মুহূর্তে নিবিড়দার বিরুদ্ধে রসদ খুঁজছিস? রটাতে হবে! নিবিড় কতটা খারাপ স্বামী।তার পর তোদের ফেমিনিজেমের ঝাণ্ডা তুলবি সোশ্যাল মিডিয়ায়।চ্যালা চামুণ্ডাদের লাইক কুড়িয়ে আবার কয়েক মাস আমারই ড্রয়িং রুমটা হয়ে উঠবে ফেমিনিজিমের ধ্বজা! এই নিয়ে ক'টা সংসার ভাঙলি তোরা? '
রাত্রি দরজার দিকে হেঁটে যায়। 'চলি রে অহনা। নিবিড়দা আজ অন্য জগতে। চললাম নিবিড়দা।' বলে গুটিগুটি পায়ে বিদিতার সঙ্গে বেরিয়ে গেল।
ঘরময় আধো আলো।নিবিড় গ্লাসে সাদা ওয়াইন ঢালতে ঢালতে বলে, 'কী জানিস অহনা, আমরা জীবনে কিছুই পারি না।যে দু'একটা জিনিস পারি সেটা আমাদের লার্নিং প্রসেস। বাকি সবটাই সংগ্রাম। সারভাইভাল স্ট্র্যাটিজি। সোশ্যাল মিডিয়ার সিউডো প্রেজ পেতে পেতে তোরা এগুলো সিম্পলি ভুলে গেছিস।সবজান্তা ভাবটা একদিকে সরিয়ে এটা যেদিন বুঝবি হয়তো দেরি হয়ে যাবে।এখন আমার একটাই চিন্তা।সহেলিটা এরকম ডিস্টার্বড পরিবেশে বড় হচ্ছে…এমনটা চাইনি আমি, চাইনি…’
অহনা এক ধাক্কায় হিংস্রভাবে নিবিড়ের হাত থেকে গ্লাসটা ফেলে দিল। কাঁচের গ্লাস চুরমার হওয়ার কুচি কুচি শব্দ বইছে ঘরের বদ্ধ বাতাসে। সহেলি দোতলার ঘরে কাঁদছে।কাঁপছে।একবার শুধু মুখ ফুটে বলল, ' হল্ড মি! আমার ভীষণ ভয় করছে।'
২
বার বার ঘড়ি দেখছে অহনা। হাইওয়ের ওপর দিয়ে শা-শা করে গাড়ি ছুটিয়ে নিয়ে চলেছে নিবিড়। চারপাশ আলো আধারি। সন্ধে নামবে কিছুক্ষণে। অস্থির গলায় অহনা বলল, 'আমি আর টেনশন নিতে পারছি না!' তক্ষুনি গাড়ির স্পিড হঠাৎ বাড়িয়ে দিল নিবিড়।বলল, 'জেনেটিক গার্বেজ ! তুমি একটা জেনেটিক গার্বেজ! কী প্রয়োজন ছিল মেয়েটার ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করার? স্কুলের একটা সিস্টেম আছে। বোঝো এ সব?'
মা না-হলে বুঝবে না। চব্বিশ ঘণ্টার বেশি হতে চলল মেয়ে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরেনি। এই সময় অত ভেবেচিন্তে পা ফেলা যায়? আর কত অপমান করবে আমায় বলতে পারো?'
'সহেলি আমাদের মধ্যে না-থাকলে আমি বহু, বহু আগেই তোমাকে ছেড়ে চলে যেতাম। আমি অপমান করি, না? ন্যূনতম বুদ্ধি থাকলে বুঝতে যে, আমি ভালর জন্যই...'নিবিড়ের কথা মাঝপথে থামিয়ে অহনা চিৎকার করে উঠল, 'কার ভালর জন্য, নিবিড়?'
'সে কথা থাক… এখন ভাবার চেষ্টা করো, সহেলি এমন একটা কান্ড ঘটাল কেন? না বলেকয়ে স্কুল থেকে বেপাত্তা ! মেয়েটার মনের মধ্যে কী চলে,ধারণা আছে তোমার?'
'না, ধারণা নেই। সহেলি দিন দিন তোমার মতন জটিল, অবাধ্য হয়ে উঠছে!' অহনা যখন চিৎকার করে নিবিড়ের মনে হয় দু'হাতে কান চেপে রাখতে। শূন্যে হাত পা ছুঁড়ে পালটা চেঁচাতে ইচ্ছে করে।কিন্তু অধিকাংশ সময় রাগটা মনের মধ্যে গুমরে বলে, 'ক্যান ইউ স্টপ ইয়েলিং!'
এদিকে হোয়াটসাপের নেত্যনাচন চলতেই থাকে। একটার পর একটা ফোন কল। নিবিড় একটাও ফোন তুলছে না। নার্ভাস লাগছে।চেনা-পরিচিতদের ফোন ধরছে না। রাত বাড়ছে। বিপদ যেন ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে। ঘিরে ধরছে একটা পুরনো জং ধরা দাম্পত্যকে।
নিবিড় যখন সিগারেটের পর সিগারেট ধরায়, অহনাকে বুঝেও বোঝে না, সহেলিকে নিয়ে নিবিড় ঘরের মধ্যে দল পাকানোর চেষ্টা করে, তখন সহেলিকেও তার বাবার মতোই কেমন দুর্বোধ্য মনে হয় অহনার! কিন্তু, তার জন্য অহনার স্নেহ তো কিছু কম পড়ে না।তা হলে মেয়েটা এমন করল কেন? মাথা নিচু করে এক মনে ভাবছে,অহনা।
আচমকা ব্রেক কষল নিবিড়। অহনা মাথা তুলে তাকিয়ে দেখল স্কুলের সেই দীর্ঘ পার্কিং লট।
'একটা শেষ কথা শোনো'। বলে নিবিড় ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল অহনার দিকে।' পরশু ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে কেঁদেছিলাম অনেকক্ষণ। আমাদের সব অ্যাকাউন্ট আলাদা করে দিয়েছি। তুমিই চেয়েছ। কী জানো, অহনা, শুধু দাম্পত্যে নয়, যে কোনও সম্পর্কে যখন টাকাপয়সার হিসেব চলে আসবে, বুঝবে, সম্পর্কটা প্রায় শেষের দিকে।'
দু'জনেই খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। এই সদ্য নেমে আসা সন্ধ্যার অন্ধকারে কেউ কোথাও নেই।মেঘে ঢেকে আছে আকাশের চাঁদ। সারা আকাশ তারায় ভরা।মেঘ সরিয়ে একটা তারাও চোখে পড়ছে না।চোখ ঝাপসা না আকাশটা বহু দূর?
অহনা তাড়া দিল, 'প্রিনসিপাল অনেকক্ষণ ডেকেছেন। বাজে না-বকে চল।' গাড়ি থেকে নেমে স্কুলের দরজার দিকে হাঁটতে হাঁটতে নিবিড় বলে, ' কী বললাম, কেন বললাম, কতটা বললাম, কতটা বললাম না, কিছুই বুঝলে না। আর বুঝলে না বলেই আজ সহেলি...'
'স্টপ ব্লেমিং মি!' নিবিড়ের কথা থামিয়ে অহনা স্কুলের দরজা খুলে চেঁচিয়ে ওঠে। করিডরে কথাগুলো ইকো হল।নিবিড়ের কানে 'স্টপ' শব্দটা ফিরে ফিরে আসে।
কিছুটা এগিয়ে গিয়ে ডানদিকের প্রথম ঘরটাই অফিস ঘর। লম্বা অফিস ঘর পেরিয়ে বাঁ দিকের দ্বিতীয় ঘরে প্রিনসিপাল ডনা বসে আছেন।এই অবধি পৌঁছে থেমে যায় দু'জন।তাদের পদশব্দে ঘুরে তাকালেন।বললেন, 'প্লিজ কাম ইন।' উঠে দাঁড়িয়ে দু'জনকে হাতের ইশারায় বসতে বললেন।
‘আফটার আ ওয়াইল সাম গুড নিউজ! কপস ফাউন্ড সহেলি অ্যাট দা নিয়ারেস্ট ট্রেন স্টেশন।শি ওয়াজ ক্রাইং!'
অহনা বিস্মিত গলায় প্রশ্ন করল, 'এখন ও কোথায়? আমি যাব সেখানে...'
'শান্ত হন মিসেস অহনা চ্যাটার্জি! ওকে স্কুলে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে।শি ইজ অন হার ওয়ে ব্যাক।'
নিবিড় কপালে দু'হাত রেখে বসে রইল কিছুক্ষণ। লজ্জা, অপমান, মিলেমিশে অসহায় করে দিয়েছে তাকে।
বড় বড় শ্বাস ফেলে সে বলে, 'সহেলিকে একটাও প্রশ্ন করবে না তুমি!'
অহনা ভুরু কুঁচকে তাকায় নিবিড়ের দিকে। ডনা দু'জনের চোখেমুখে টেনশন আঁচ করতে পারেন।হেসে বলেন,' রিলাক্স! ইউর চাইল্ড ইজ ইন সেফ হ্যান্ডস। একটা কথা বলি আপনাদের।এক্ষুনি মেয়েকে জেরা করবেন না। থিতু হতে দিন।দিন সাতেক পর আমাদের স্কুল কাউন্সিলর ওর সঙ্গে পার্সোনালি কথা বলবে।ওকে?’
এই কথার পর অহনার প্রথম জবাব, 'নট ওকে। সহেলি দিন দিন...'বলে হঠাৎ টেবিল চাপড়ে সে উঠে দাঁড়ায়।
'কী হচ্ছেটা কী? ক্যান ইউ নট...' নিবিড়ও উঠে দাঁড়াল।চোখ পাকিয়ে স্ত্রীকে থামাতে যায়। অহনা তখন আরও ভায়ালেন্ট হয়ে ওঠে।টেবিলের ওপর রাখা একটা পেন স্ট্যান্ড ছুঁড়ে মাটিতে ফেলে দেয়।
'মিসেস চ্যাটার্জি! কাম ডাউন।দিস ইজ আ পাবলিক প্লেস।' ডনা বলতে বলতে এক দল পুলিশের সঙ্গে সহেলি ঘরে ঢুকল। মাথা নিচু করে সে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ।অহনা দৌড়ে গিয়ে মেয়েকে জাপটে ধরেছে।নিবিড় অনেকগুলো কাগজপত্র সই করে নিজের আইডেন্টিফিকেশনের প্রমাণ পত্র তুলে দিল পুলিশের হাতে।
প্রিনসিপালের ঘর থেকে পুলিশ বিদায় নিতেই সহেলি ফসফস করে কেঁদে মাটিতে বসে পড়ে। নিবিড় এগিয়ে যায় মেয়ের কাছে।মেয়েকে তুলে বুকে জড়িয়ে নেয়। বলেল,’ কাঁদে না,মা। আই অ্যাম হিয়ার।কাঁদে না।'
ডনা এক গ্লাস জল এগিয়ে দিলেন সহেলির দিকে।বললেন, ' প্লিজ সিট!'
সৌম্যদর্শন সহেলি এই স্কুলের কৃতি ছাত্রী। প্রত্যেক বিষয়ে অনার্স।মিশুকে। বছরখানেক হল গোমড়া মুখে স্কুলে আসে।গোমড়া মুখে বাড়ি ফিরে যায়। পারিবারিক অশান্তি সামলাতে সামলাতে খানিকটা শুকিয়ে গেছে। টিচার, কাউনসিলর যদি প্রশ্ন করে, 'তোমার মুখে হাসি নেই কেন?' ও বলে, ' ভাল্লাগছে না...'
সহেলি দু'দিকে মাথা নেড়ে বলল, 'আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু সিট!'
অমনি পাশ থেকে অহনা প্রিনসিপালের দিকে তাকিয়ে বলল, ' দেখেছেন কেমন বাবার মতোই অবাধ্য? এতকিছুর পর কথা শুনছে? ঘুরে মেয়েকে বলে, ’প্লিজ আর নাটক কোরো না। গত দেড় দিন ধরে যা খেল দেখালে! '
সহেলি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে, 'ফাইন! আমি কথা শুনি না। কী করবে? করো!'
নিবিড় বিস্মিত চোখে অহনাকে দেখে।মেয়েকে দেড় দিন পর দেখেও বকাবকি করছে? বলে, 'লেট মি সর্ট ইট আউট, অহনা। অনেক হয়েছে!'
ডনা উল্টোদিক থেকে অহনাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে আসেন। সহেলির কাঁধে হাত রাখেন।বলেন, ' ইউ ওয়ান্ট টু গো হোম, ডার্লিং?'
' নো...'
ডনা হাসেন, ' বেশ তো! কোথায় যাবে, বলো?'
সহেলির উত্তরের পরের অংশটা অতি-সংক্ষিপ্ত।জীবনের হাজার হাজার প্রশ্ন তুলেছিল।
' জানি না কোথায়! কোথাও, যেখানে কেউ হারিয়ে যায় না। আমার বাবা হারিয়ে গেছে, ওকে কেমন যেন দূরের মানুষ মনে হয়। মাও হারিয়ে গেছে।মাকে প্রায়-ই অচেনা লাগে। সব বদলে গেছে। আমি কোথাও হারিয়ে গেছি! তাই বন্ধুরাও কাছে আসে না আমার! আই ওয়ান্ট টু গো টু আ প্লেস ওয়েয়ার দা আদার পার্সন ডোন্ট থিঙ্ক অনলি অ্যাবাউট হিমসেলফ ওর হারসেলফ।এমন কোথাও...' বলতে বলতে সহেলির ছলছল চোখ চলে যায় জানলায়।ব্লাইন্ডসের ফাঁকে অন্ধকার উপচে পড়ছে এই ঘরের এমাথা ওমাথা।তীব্র অন্ধকার।
প্রিনসিপাল রুমটা কোন এক অব্যক্ত বাতাসে ভাসছে।আকাশে মন মরা, হারানো, অন্ধকারচ্ছন্ন কোনও রঙের প্রলেপ। সূর্যোদয়ের প্রত্যাশা আছে কি কোথাও?
নিবিড় থমথমে মুখে মেয়েকে দেখছে। পরিস্থিতির ভারসাম্য রাখতে না-পেরে অহনা ধপাস করে বসে পড়ল চেয়ারে।
দেড়টা দিন ফুরিয়ে এল। নিরুদ্দেশের খোঁজে। আকাশের ছায়া পড়ছে এই ঘরের প্রতিটি মানুষের নিখোঁজ অনুভূতির ভিতর!