খবরটা পড়ার পর ভিতরে ভিতরে কেঁপে উঠল সুকান্ত। তার অবস্থাও তো অনেকটাই রকম। তার বাবাও বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন। অনেক কষ্টেসৃষ্টে প্রথম জীবন কাটিয়েছেন। বিয়ে করে থিতু হতে বেশ কয়েক বছর কেটে যায়। নিজে কোন বাড়ি করতে পারেননি ভাড়া বাড়িতেই দিন কাটিয়েছেন। ভ্যান রিকশা চালিয়ে কোনরকমে দিন গুজরান।
সেটাও নিজের ভ্যান নয়। দিনশেষে রোজগার থেকে ভ্যানভাড়া মালিককে গুনে দিতে হত। সেই জন্য ছেলেকে ঠিকঠাক লেখা পড়া শিখিয়ে উঠতে পারেননি। টেনেটুনে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত স্কুলে যাওয়ার পর সুকান্তকে পড়াশোনায় ইতি টানতে হয়। পড়াশোনা ছাড়ার পর কিশোর বয়স থেকেই সংসারের হাল ধরার জন্য বাবার মত ভ্যান চালায়। সুকান্তর বাবা-মা দুজনেই ভোটার ছিলেন। ভোট দিয়েছেন কয়েকবার। দু'হাজার দুই সালের বন্যায় তাদের ঘর জলের তলায় চলে যায়। নষ্ট হয়ে যায় সমস্ত নথিপত্র। বাবার মুখে শুনেছিল বন্যার সময় তাদের রেশনকার্ড, বাবামায়ের ভোটারকার্ড তার বার্থ সার্টিফিকেট, আরও অনেক দরকারি কাগজপত্র বাবা একটা ফাইলের মধ্যে রেখেছিল। তার মনে আছে সন্ধ্যার মুখে মুখে তাদের ঘরে যখন বন্যার জল ঢোকে, তখন তাড়াহুড়ো করে দরকারি জিনিসপত্র টাকাপয়সা, গুছিয়ে তুলতে গিয়ে ফাইলটা কোথায চাপা পড়ে যায় বাবা খুঁজে পায়নি। কিশোর সুকান্ত তার সাধ্য মতো খোঁজাখুঁজি করেছিল কিন্তু সন্ধ্যার অন্ধকার হয়ে আসায় শর্ট সার্কিটের ভয়ে সমস্ত এলাকায় ইলেকট্রিক লাইন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। জল ক্রমশ বাড়ছিল, মায়ের তাগাদায় শেষ পর্যন্ত তারা হাতের কাছে যা পেয়েছিল তাই নিয়ে, বাকি জিনিসপত্র খাটের উপরে রেখে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিল। বাবা বলেছিল পরদিন সকালে এসে বাকি জিনিসপত্র নিয়ে যাবে। সারারাত স্কুলবাড়িতে কাটিয়ে পরদিন সকালে বাবার সঙ্গে জিনিসপত্র নেওয়ার জন্য বাড়ি এসে দেখল, ঘরে বুক সমান জল। খাটের উপরে রাখা সমস্ত জিনিসপত্র সারা ঘর জুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। জলের মধ্যে ফাইলটা আর খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি।
দ্বিতীয়বার ভোটারকার্ড পেতে হলে যে সমস্ত কাগজপত্র দরকার, সেসব জোগাড় করে উঠতে পারেননি সুকান্তর বাবা। সেই সময় সুকান্তর মায়ের ক্যান্সার ধরা পড়ে। স্ত্রীর চিকিৎসা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি, নতুন ভোটারকার্ড তৈরি করা একসঙ্গে সামলাতে পারেননি তিনি। ফলে দু'হাজার দুই সালের ভোটার তালিকায় নাম ওঠেনি। স্ত্রীর মৃত্যুর পর উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিলেন অবশেষে দু'হাজার পাঁচ সালে তিনিও মারা যান।
বাবা মারা যাওয়ার পর, পার্টির লোকজনকে ধরাধরি করে অনেক কষ্টে নিজের জন্য ভোটার আর আধারকার্ড বানিয়ে নিয়েছিল। ভোট দিয়েছে কয়েকবার।
পুরো ব্যাপারটা না জানার জন্য সে অনেক দুশ্চিন্তা করল খবরের কাগজ পড়ে নিজের বুদ্ধিমত যেটুকু বুঝেছে এবং তার ভ্যান রিকশার দুই একজন প্যাসেঞ্জারকে জিজ্ঞেস করে যা জেনেছে তা মোটামুটি এইরকম: যে দু'হাজার দুই সালের তালিকায় নাম না থাকলে অসুবিধা নেই। তার বাবা অথবা মা যে কোনোও একজনের নাম থাকলেও হবে। বাবামায়ের নাম না থাকলেও অসুবিধা নেই। জমি বাড়ির দলিল, বার্থ সার্টিফিকেট অথবা মাধ্যমিক পাশের সার্টিফিকেট থাকলে হবে। অথচ তার কাছে এগুলো কিছুই নেই।
নেই তার কারণ বন্যা এবং তাদের অজ্ঞতা। এখন সে অদ্ভুত বিপন্নতা অনুভব করল। কার কাছে যাওয়া যায়? প্রথমে তার চুমকির কথা মনে পড়ল। চারপাশে পরিচিত বেশ কিছু অভিজ্ঞ জ্ঞানী ব্যক্তি থাকা সত্ত্বেও এই বিপন্নতার মাঝে চুমকিকে কেন মনে পড়ল!
বন্যার আগে তারা যে বাড়িতে ভাড়া থাকত সেই বাড়িতেই অন্য একটা ঘরে চুমকিরা ভাড়া থাকত। সুকান্তর চাইতে চুমকি মাত্র দু বছরের ছোট। তারা পাশাপাশি একসঙ্গে বেড়ে উঠেছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে একটা আকর্ষণ তৈরি হয়। যদিও প্রেম ভালোবাসা বোঝার মত পরিপক্কতা তৈরি হয়নি, তবুও টিভিতে সিনেমা দেখে তারা নারী-পুরুষের সম্পর্কের খানিকটা আভাস পেয়েছিল। বয়সে ছোট হলেও তার উপর বেশ খবরদারি করত চুমকি এবং বাস্তব বুদ্ধিও সুকান্তর থেকে তার অনেক বেশি ছিল। তাই সুকান্ত নির্বিবাদে তার পরামর্শ শুনে চলত। একটা ব্যাপারে সুকান্তর খবরদারি ছিল। সে চুমকিকে মাঝে মাঝেই বলত, "আমি তোর বর। সব সময় আমার কথা শুনবি।" উত্তরে চুমকি ভেংচি কেটে চলে যেত। বন্যার পর অবস্থা মোটামুটি ঠিকঠাক হলেও পুরনো ভাড়া বাড়িতে তারা আর ফিরে যেতে পারেনি, কারণ বাড়ির মালিকও তাদের মত গরিব ছিল। ঘরগুলোর যে ক্ষতি হয়েছিল তা সারিয়ে নিয়ে ভাড়া দেওয়ার মতো আর্থিক সঙ্গতি তার ছিল না। যার ফলে সুকান্তর বাবা অন্য পাড়ায় বাসা ভাড়া করে চলে যান।
চুমকিরা যে কোথায় গিয়েছে সে খোঁজ সুকান্তদের বাড়ির কারও কাছেই ছিল না। মাঝে দশ বছর কেটে গিয়েছে। বাবা মা কেউ নেই, সুকান্ত একেবারেই নিঃসঙ্গ। একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। সারাদিন ভ্যান চালায়। একা মানুষ। কিছু টাকা পয়সা জমেছে। ঘরে একটা ফ্যান, টিভি এমনকি ছোট একটা ফ্রিজও কিনেছে।
সেদিন মাল ডেলিভারি দিতে গিয়েছিল তালপুকুরে শাড়ির হাটে। প্রায় দশ কিলোমিটার ভ্যান চালিয়ে খুব ক্লান্ত হয়ে চায়ের দোকানে বসেছিল কিছুক্ষণ। গাছ তলায় ছাওয়ায় ছোটখাটো ছিমছাম দোকান। দুপুর বলে ফাঁকা। একটি মেয়ে দোকানদারি করছিল। সুকান্ত চায়ের অর্ডার দিয়ে জল চাইল। মেয়েটি জলের জগ এগিয়ে দিল। সুকান্ত যখন গলায় জল ঢালছে তখন মেয়েটি প্রায় চিৎকার করে উঠল, "সুকুদা না?” গলায় জল আটকে প্রায় বিষম খাওয়ার অবস্থার সুকান্তর, কোনও রকমে সামলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকল। মেয়েটি বলল, "চিনতে পারলে না? বল দেখি আমি কে? অবশ্য তোমার যা বুদ্ধি বয়স হলেও বেড়েছে মনে হয় না" এইবার সুকান্তের মস্তিষ্কে আলো জ্বলে উঠল। সে বিস্ময়ে অস্ফুটভাবে বলল, "চুমকি!”
দোকানের পিছনেই বাড়ি। চুমকি তাকে টেনে বাড়িতে নিয়ে গেল। কাকিমা তাকে দেখে খুশি হলেন। তার বাবা-মা দুজনে মারা গেছেন শুনে চোখের জল মুছলেন। মায়ের সঙ্গে তার খুব বন্ধুত্ব ছিল। চুমকির বাবাও গত হয়েছেন। চুমকির বিয়ে হয়ে গেছে শুনে কেন জানিনা সুকান্ত খুব মুষড়ে পড়ল। তারপর শুনল বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই চুমকিকে মারধর করে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। চুমকির বাবা জামাইকে মোটরবাইক কিনে দিতে পারেনি।
ওরা শুধু চুমকিকে বাড়ি পাঠিয়ে থামলো না। মাস দুয়েকের মধ্যে সন্ধান করে ছেলের বিয়ে দিয়ে দিল। অনেকে বলেছিল কোর্টে যেতে, কিন্তু চুমকি বলল সে এই বিয়ে মানেই না আর কোর্টে যাওয়ার সংগতিও নেই। হয়তো চুমকির চিন্তাতেই কিছুদিনের মধ্যে তার বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা যান।
এরপর চুমকির সঙ্গে তার যোগাযোগ নিয়মিত হয়। মাঝেমধ্যে কারণে অকারণে ভ্যান চালিয়ে চলে যেত তালপুকুরে চায়ের দোকানে। নানান ধরনের কথাবার্তা হত। চুমকির দোকানের দেওয়ালে একটা পোস্টার সাটানো আছে যাতে লেখা- এসআইআর-এর নামে বৈধ নাগরিকদের বেনাগরিক বানানোর চক্রান্ত রুখে দিন। চুমকি একটি নারী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। তার কাছে থেকে সুকান্ত প্রথম এসআইআর-এর কথা শুনেছিল। তখন বিষয়টায় খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি সে, বরং পুরোনো দিনের স্মৃতি, শৈশব, কৈশোরের কথাবার্তায় বেশি উৎসাহী ছিল। একদিন সে চুমকিকে কে বলে বসল "তোর বর তো আবার বিয়ে করে নিয়েছে সারা জীবন তুই কীভাবে কাটাবি চুমকি?"
আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চুমকি বলল, "সবার বর ভাগ্য হয় না। আমিও সেই দলে। একটা জীবন কেটে যাবে কোনও ভাবে, তুইও তো বিয়ে করলি না সুকুদা। তোর কি হবে?"
সুকান্ত সাহসী হয়ে বলে ফেলেছিল, "ছোটবেলা থেকেই বিধাতা ঠিক করে রেখেছিল যে আমিই তোর বর। তাই ভাবছি তোকেই বিয়ে করে ফেলব।"
কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছিল চুমকি, "একটা উচ্ছিষ্ট মেয়েকে কেন বিয়ে করবি তুই?" "উচ্ছিষ্ট!” অবাক হবার ভান করেছিল সুকান্ত, "সেটা তোর বর করেছিল। বন্যার বছরে দোলের দিন চুমুর কথা মনে নেই?" লজ্জায় লাল হয়ে পুরোনো দিনের মতো ভেংচি কেটে দোকান ছেড়ে বাড়ির দিকে দৌড় দিয়েছিল চুমকি।
এই ঘোরতর সমস্যায় চুমকির কথা মনে পড়তেই সে সিদ্ধান্ত নিল পরদিন সকালে তার কাছে গিয়ে গিয়ে পরামর্শ চাইবে।
সব শুনেই চুমকি কিছুটা চিন্তা করে বলল, "কাকু যে ভ্যান মালিকের ভ্যান চালাতেন তার সঙ্গে একবার দেখা কর। যদি ভ্যান নেওয়ার সময় পরিচয়পত্র জাতীয় কোনও কাগজপত্র জমা দিয়ে থাকেন একটু খোঁজখবর করে দেখতে পারিস।"
পরদিন সুকান্ত আর কাজে বেরোল না। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাবা যে মালিকের ভ্যান চালাতেন সেই মালিকের বাড়ি গেল। সেখানে সেখানে গিয়ে শুনল তিনি অনেকদিন মারা গিয়েছেন তার ছেলে এখান থেকে ব্যবসা গুটিয়ে বর্ধমান চলে গিয়েছে। সুকান্ত ঠিক করল সে বর্ধমান যাবে। কিন্তু ঠিকানা, ঠিকানা কোথায় পাবে? সারাদিন ঘুরে অনেক কষ্টে বাবার সময়কার হারানজেঠুর খোঁজ পেল। জেঠুর কাছে বর্ধমানের ঠিকানা মিলল।
পরদিন ভোর থাকতে বর্ধমানের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল সুকান্ত। সেদিনও কাজ কামাই গেল। বর্ধমানেও সেই ঠিকানা খুঁজে পেতে পেতে দুপুর গড়িয়ে গেল। মালিকের ছেলে প্রায় তার সমবয়সি। সে কোনও রকম সাহায্য করতে পারল না।
তবে এটা জানা গেল যে ভ্যান ভাড়া নেওয়ার আগে সবাইকে তাদের ভোটারকার্ড প্রমাণপত্র হিসেবে রাখতে হত। তার বাবার কাছে অনেক ভ্যানচালক কাগজপত্র রাখত, তবে দোকান ছেড়ে আসার আগে বেশিরভাগ ভ্যানচালক তাদের কাগজপত্র নিয়ে গিয়েছিল। সুকান্ত বুঝল কিছু পাওয়ার আশা নেই। যদিও তার বাবা কিছু রেখেছে কিনা সে বিষয়ে সে নিশ্চিন্ত নয়, উপরন্তু মালিকের ছেলে জানাল যে, সে নিজেই একই ঝামেলায় ফেঁসে আছে। তার বাবার নাম দু'হাজার দুই সালের লিস্টে থাকলেও সে তখনও ভোটার হয়নি। কোনও দিন স্কুলমুখ হয়নি বলে তার কোনও সার্টিফিকেট নেই। তার বাবা কিভাবে ভোটার কার্ড আধার কার্ড করে দিয়েছিল সে জানে না। তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, পাসবই সবই আছে। কিন্তু এসব হবে নাকি সে জানে না। সুকান্ত বলল, "এই বাড়ির দলিল তো আছে তাহলেও হবে।"
মালিকের ছেলে খুব চিন্তিত মুখে বলল, "না দাদা তাও হবার নয়। এই বাড়িটা আমার পিসির। পিসি নিঃসন্তান। পিসি বলেছিল আমার নামে দানপত্র করে দেবে। কিন্তু দেব দেব করতে করতেই হঠাৎ মরে গেল। এখন কি হবে আমি জানি না।"
সুকান্ত ব্যর্থ হয়ে ফিরে এল।
বর্ধমান থেকে ফেরার পর দিনও ভ্যান নিয়ে বেরোতে পারল না, শরীরটা খারাপ ছিল। দু'দিনের জ্বর। মাখা ভার, গলা শুকিয়ে কাঠ। ঘরের ফ্যানটা একটানা ঘুরছে, তবু গরমের দমকে ঘামে ভিজে যাচ্ছে চাদর। ভ্যানটা বাইরে দাঁড় করানো। ধুলো মাখা, চাকার কাছে একটা ছেঁড়া প্লাস্টিকের থলে উড়ছে। জানলার ফাঁক দিয়ে বিকেলের সূর্য এসে পড়েছে মুখে।
সুকান্ত চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। মনে পড়ল, চুমকি বলেছিল- "যাই হোক না কেন, ভয় পাবি না। আমরা একসাথে লড়ব। তোর কাগজ না থাকলে নতুন করে তৈরি করব। আমাদের সংগঠনের লোকজন সাহায্য করবে।"
তখন সে ম্লান হেসেছিল, 'আজ এই দেশের সন্তান হয়েও আমাকে প্রমাণ করতে হচ্ছে আমি এদেশের মানুষ। কাগজ তাহলে মানুষের চেয়ে বেশি দামি চুমকি?”
চুমকি মুখ নিচু করে চুপ করে ছিল কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে বলেছিল, "কাগজের থেকেও মানুষের ইতিহাস বড় সুকুদা। তোর ইতিহাস এই মাটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। কয়েকটা কাগজের টুকরো তার প্রমাণ কখনও হতে পারে না।" সে কথাটা আজও কানে বাজছে।
সন্ধ্যার দিকে চুমকি এল। হাতে একটা ব্যাগ।
"তুই আজ ভ্যান নিয়ে বেরোসনি কেন?"
সুকান্ত হেসে বলল, "জ্বরটা আজও একটু আছে।"
চুমকি ব্যাগ খুলে ওষুধ, কিছু লেবু, গ্লুকোজ বের করল।
"আজ সকালে সভা ছিল। অনেকে নতুন কেস নিয়ে এসেছে। কারও বাবার নাম আছে দু'হাজার দুইয়ের লিস্টে অথচ মায়ের নাম নেই, কারও নিজের নাম নেই। যাদের নাম নেই, তারা সবাই আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে, যদি নতুন ভোটার তালিকায় নাম না ওঠে তাহলে কি তারা বেনাগরিক হয়ে যাবে?"
সুকান্ত কিছু না বলে চুপ করে বসে থাকল। তারপর হতাশ গলায় বলল, "শুনছি... ভয়ও পাচ্ছি চুমকি। যদি আমিও..."
চুমকি হঠাৎ তীক্ষ্ণ গলায় বলল, "না, তোর কিছু হবে না। তুই একা নোস।"
দুজনেই চুপচাপ বসে থাকলে কিছুক্ষণ। তারপর চুমকি ডান হাত দিয়ে সুকান্তের কপালের উত্তাপ পরীক্ষা করতে করতে বলল, "এই দেশে একদল মানুষ বাস করে যাদের জন্ম এখানেই, কিন্তু প্রমাণ নেই। যাদের পরিশ্রমের ঘাম রক্ত মিশে দেশের উন্নতি হচ্ছে, সেটা কোনও প্রমাণ নয়! প্রমাণ কয়েক টুকরো কাগজ। অথচ যারা কোটি কোটি টাকা কামায়, জাল সার্টিফিকেট বানায়, তারা নাগরিক!"
সুকান্ত কিছু বলতে পারল না। শুধু তার বাবার পুরনো ফাইলটার কথা ভাবতে থাকল। তিনদিন পর সুকান্ত কিছুটা ভালো বোধ করল। চুমকির কথায় এক সংগঠনের অফিসে গেল-ছোট ঘর, দেয়ালে লেখা "রাষ্ট্র তুমি বৈধ নাগরিকদের হয়রান করা বন্ধ কর।"
একজন যুবক, তার ভোটার, আধার কার্ড দেখে বলল, "তোমার স্কুলের নাম বলো, আমরা হেডমাস্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেখি কিছু উদ্ধার করা যায় কিনা। আর জন্মের প্রমাণপত্রের জন্য পৌরসভায় যোগাযোগ করো।"
সুকান্ত বলল, "আমাদের স্কুলটা তো ভেসে গেছিল বন্যায়, কাগজপত্র সব নষ্ট হয়ে গেছিল। তাছাড়া ছাত্রছাত্রীর অভাবে সরকার স্কুলটা বন্ধ করে দিয়েছে। এখন সেখানে পৌরসভার দাতব্য চিকিৎসা কেন্দ্র।”
যুবকটি বলল, "তবু আমরা চেষ্টা করব দাদা। হার মানলে চলবে না। তুমিও চেষ্টা চালিয়ে যাও। আমরা পাশে আছি।"
সেদিন বিকেলে চুমকির দোকানে এল সে। তারা দুজন চুপচাপ চা খেল। দূর থেকে মাইকে রবীন্দ্রসঙ্গীত ভেসে আসছে, "ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা..."
গানটা শুনতে পেয়ে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে হাসল।
চুমকি বলল, "এই যে তুই, আমি, আমাদের মতো মানুষ যদি ভয় পেয়ে যাই, তাহলে ওরা আমাদের আরও নাজেহাল করবে। এই দেশের মাটি কি ওদের বাপের! আমাদের বাপ, দাদার না?"
সুকান্ত চুপচাপ তাকিয়ে রইল। আকাশের দিকে। কালো মেঘ জমছে।
কিন্তু সময় থেমে থাকল না।
পরের সপ্তাহ থেকে বাড়ি বাড়ি সরকারি প্রতিনিধিরা ভোটার যাচাই করণের কাজ শুরু করে দিল। সুকান্ত বেশ ভয়ে ভয়ে ছিল। তবে প্রথমে তেমন অসুবিধা হল না। যারা এসেছিলেন তারা সুকান্তর হাতে একটা ফর্ম ধরিয়ে দিয়ে গেলেন, সেটা ভর্তি করে জমা দিতে হবে। ব্যাপারটা যত সহজ মনে হয়েছিল ততটা নয়। ফর্ম ফিল আপ করলে হবে না, তার সঙ্গে বার্থ সার্টিফিকেট অথবা মাধ্যমিক পাশের সার্টিফিকেট জমা দিতে হবে। আধারকার্ড দিলে কিছুই হবে না, আধার কার্ড নাকি নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়। তার মনে হল তাহলে ভোটারকার্ড, আধারকার্ড, প্যানকার্ড, রেশনকার্ড, এত গুচ্ছ কার্ডের প্রয়োজন কি ছিল? সবকিছুর সঙ্গে যখন আধার কার্ড লিঙ্ক করা হচ্ছে তখন ভোটারকার্ডের সঙ্গে আধারকার্ড লিঙ্ক করে দিলেই তো ঝামেলা মিটে যেত। তাহলে তো আর মৃত ব্যক্তি অথবা অবৈধ ভোটাররা ভোট দিতে পারত না। আরও প্রশ্ন মনের মধ্যে জাগে, বৈধ নাগরিকরাই তো ভোটারকার্ড পাওয়ার যোগ্য তাহলে অবৈধভাবে ভোটার কার্ড দেওয়ার জন্য দায়ী কারা! তারা তো সরকারের লোক। সরকার তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না কেন? তাছাড়া যদি অবৈধ ভোটারের দেওয়া ভোটে সরকার তৈরি হয়ে থাকে, তাহলে সেই সরকার তো অবৈধ। অবৈধ সরকার কি করে বৈধ নাগরিক যাচাই করতে পারে? কিন্তু সে জানে এ প্রশ্নের উত্তর কেউ দেবে না, কারণ মানুষকে অশান্তি এবং আশঙ্কার মধ্যে রাখতে পারলে ওদের লাভ জনগণের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করতে পারে।
ফর্ম জমা দেওয়ার আগে সে পৌরসভায় গিয়ে জন্মের প্রমাণপত্রের জন্য আবেদন জানিয়ে এল। বেশ কয়েকদিন কাজকর্ম বন্ধ রেখে ঘোরাঘুরি কর জানতে পারলো তার আধার কার্ডে দেওয়া জন্ম সাল তারিখ কিছুই পৌরসভার রেকর্ডে কিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি। তার মনে পড়ল আধারকার্ড তৈরির সময় এক পার্টির দাদা তাকে সাহায্য করেছিল। যেহেতু তার স্কুল
সার্টিফিকেট ছিল না পার্টির দাদা জন্ম সাল তারিখ সহ অন্যান্য ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। সেটা সঠিক ছিল কিনা সে নিজেই জানে না। শুধু জানে এই দেশেই তার জন্ম হয়েছিল। তাকে দেখে বলল, "চুমকি শেষমেশ আমি যদি বাংলাদেশি প্রমাণিত হই, তাহলে তুইও তো আর আমার হবি না?"
চুমকি ভাঙা গলায় বলল, "তুই আমি একই দেশের মানুষ। তুই আমার মনের মানুষ। কে কি বলল বা কি প্রমাণ হল তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি তোর সঙ্গে ছিলাম তোর সঙ্গেই থাকব।"
সেদিন চুমকির দোকান বন্ধ ছিল। সন্ধ্যাবেলায় সরাসরি সুকান্তর ঘরে এল।
সুকান্ত জানলার ধারে চুপচাপ বসে আছে। মুখ শুকনো, দূর মনস্ক চোখ।
সে এগিয়ে এসে সুকান্তর কাঁধে হাত রাখল।
দুজনেই চুপচাপ বসে রইল। বাইরে হালকা বৃষ্টি পড়ছে।
শেষ চেষ্টা হিসেবে সুকান্ত সেই পার্টির দাদার কাছে গেল। দাদা এখন দল বদল করে, অন্য দলের অনেক বড় নেতা। তাকে দেখে চিনতেই পারল না, তারপর তার অনুরোধ শুনে ভীষণ রেগে গিয়ে সকলের সামনে বলল, "আমি তোর ভোটার, আধারকার্ড তৈরি করে দিয়েছিলাম? এসব দুনম্বরী কাজ এই শর্মা কখনও করেনি। তোর সাহস তো কম নয় তুই আমার অফিসে এসে আমাকে দুনম্বরী কাজের কথা বলছিস! শালা ঘুসপেটিয়া! ওদেশ থেকে এ দেশে এসে টাকাপয়সা দিয়ে নাগরিক হয়ে গেছিস? তোর আসল নাম সুকান্ত না সুকুল তাই বা কে জানে!
এইবার সবাই ধরা খাবি।"
লজ্জায় অপমানে চোখে জল এসে গেছিল সুকান্ত কোনক্রমে বাড়ি ফিরে আসে।
যথারীতি খসড়া ভোটার তালিকায় সুকান্তর নাম উঠল না। হিয়ারিংয়ের দিনও সে কোন কাগজপত্র দেখাতে পারল না। নতুন ভোটার তালিকাও বেরিয়ে গেল। সে জানত তার নাম থাকবে না, তবুও জেরক্স-এর দোকান থেকে একটা কপি করিয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরল।
সেই রাতে আকাশ ঘন মেঘে ঢেকে আছে। হয়তো ঝিরঝির বৃষ্টি হচ্ছে, ঘরের মধ্য থেকে
বোঝা যাচ্ছে না।
পোকামাকড়ের শব্দ পর্যন্ত নেই। ঘরের মধ্যে সুকান্ত বসে আছে মাটিতে। হাতে আধার কার্ড।
"আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী এসআইআর", একটি মাত্র বাক্য লিখে চুমকির হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে ফোন সুইচ অফ করে দিয়েছে সে।
সুকান্ত টেবিলের উপর থেকে দড়ির টুকরোটা হাতে তুলল। তার মনে পড়ল বাবার মুখ, মায়ের ক্যান্সারের যন্ত্রণা, বন্যার জলের আওয়াজ, হারানো ফাইলটা... আর চুমকির চোখের
সেই তেজভরা দৃঢ়তা-
"ভয় পাবি না, তুই একা নোস।"
চেয়ারটাকে ঘরের টেনে ঘরের মাঝখানে নিয়ে এল। মন শক্ত করে চেয়ারে উঠতে যাবে এমন সময় বাইরে থেকে দরজায় প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা।
"সুকুদা! দরজা খোল! আমি চুমকি!"
সুকান্ত চমকে উঠল। পা কেঁপে গেল।
আবারও দরজায় ধাক্কা, "সুকুদা দরজা খোল বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে।"
সুকান্ত দরজা খুলল। দেখল, বৃষ্টিতে একেবারে ভিজে চুপচুপে চুমকি তার সামনে দাঁড়িয়ে। চোখ লাল, চোখের জল আর বৃষ্টির জল মিলেমিশে তাকে অপরূপা করে তুলেছে।
ভেতরে ঢুকেই চুমকি তার হাতে থাকা দড়িটা কেড়ে নিল।
"এটা কী করতে যাচ্ছিলি তুই?"
সুকান্ত স্তব্ধ। কিছু বলতে পারল না।
চুমকি কাঁপা গলায় বলল, "যে মানুষটা অল্প বয়সে বাবা, মাকে হারিয়ে লড়াই করে বেঁচে আছে, সে কীভাবে এত সহজে হেরে যেতে পারে? তোর ছোটবেলার বউ, আমার কথা একবারও ভাবলি না? এত স্বার্থপর হতে পারলি? জানিস, আজ আমাদের সংগঠনের সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, আমরা তোর বিষয়টা আদালতে তুলব। আমরা শেষ পর্যন্ত যাব। দেখা যাক কারা জেতে?"
সুকান্ত তখনও অস্থির। কাঁপা গলায় বলল, "এত লড়াই করেও যদি কিছু না হয় চুমকি? আমি যদি চিরদিনই বেনাগরিক থেকে যাই?”
চুমকি এগিয়ে এসে তার হাত দুটো নিজের বুকে চেপে ধরল।
"তুই আমার মানুষ, এই মাটির মানুষ। তুই বেনাগরিক হতে পারিস না। আর যদি তুই নাগরিক না হোস, তবে আমিও নই। আমরা থাকব একসাথে। লড়ব, একসাথে। বাঁচব একসাথে। হয়তো কাগজে নাম থাকবে, নয়তো থাকবে না। তাতে কী এসে যায়! ইতিহাসে আমাদের নাম থাকবে।"
বাইরে তখন বৃষ্টি থেমে গেছে।