চারদিকে জ্যান্তব উল্লাস চলেছে ফাঁসি চাই। ফাঁসি।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে সাধারণ ঘরের মা মাসিমা, এমনকি পাশের বাড়ির মেয়েকে কেউ টিটকিরি মারলে যে ভদ্রলোক "আমি সাতে পাঁচে নেই" বলে জানলা বন্ধ করে দেন, তিনি পর্যন্ত। একটাই কথা ফাঁসি চাই। ফাঁসি।
দেখে মনে হচ্ছে, দোষী বলে দেগে দেওয়া ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের অধীনে, মিডিয়ার নন স্টপ লাইভ কভারেজের সামনে খুন করা হলেই ধর্ষণ নামক সামাজিক অপরাধের অবসান হবে।
মুখ্যমন্ত্রী ফাঁসির দাবিতে মিছিল করে মানুষকে আরও ক্ষেপিয়ে তুলেছেন। নিজের যুক্তিকে আরও পোক্ত করতে, তিনি আজ, ৩ সেপ্টেম্বর বিধানসভায় বিল আনছেন। তাঁর গুণধর ভাইপো, যিনি কোটি কোটি টাকা দুর্নীতি অভিযোগে বিগত বছর গুলিতে বার বার ডাক পেয়েছেন কেন্দ্রীয় এজেন্সির দফতরে, তিনি তো সোজা এনকাউন্টারের কথা বলেছেন। কারণ সহজ, পিসির থেকে এক ধাপ এগিয়ে থাকতে হবে। তাঁর পরামর্শদাতা সংস্থা বার বার এই কথা তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেয়। নতুন তৃণমূল।
জানি না, তিনি জানেন কিনা, কয় বছর আগে হায়দ্রাবাদে ধর্ষণকারী কয়েক জন যুবককে বিচারের বদলে সোজা এনকাউন্টার করে পুলিশ মেরে দেয়। যে সব পুলিশ এই কাজ করে মানুষের কাছে বাহবা নিয়েছিলেন, শেষ অব্দি তাঁদের জেলের সাজা হয়েছে।
বিজেপি তো নিজেদের দলের ধর্ষক দের ফুল মালা দিয়ে পুজো করলেও এ ক্ষেত্রে ফাঁসির পক্ষে। বামেদের একাংশও একমত।
পাঠকরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, আর জি করের ঘটনার অপরাধীর কথা বলা হচ্ছে।
আপনাদের নিশ্চয়ই ২০১২ সালে দিল্লির নির্ভয়া বা কলকাতার হেতাল পারেখ কে ধর্ষণ করে খুনের কথা মনে আছে। নির্ভয়া কান্ডে ৭ বছর ধরে বিচার চলার পরে চারজনের ফাঁসি হয়েছিল। পারেখের ক্ষেত্রে ধনঞ্জয়ের ফাঁসি হয়েছিল।
ধনঞ্জয়ের ফাঁসি হয় ২০০৪ সালে। ২০১২ তে নির্ভয়ার ঘটনা । এরপর ২০১৩ তে মুম্বইতে শক্তি মিলের কাছে এক মহিলা চিত্র সাংবাদিককে ধর্ষনের ঘটনা ঘটে। এবং বিচারের পরে ২০২১ সালে তিন জনের ফাঁসি হয়। এই তিনটি ঘটনার পরে কি ধর্ষনের মত অপরাধ কমেছে? কমেনি। এখনও দেশে গড়ে প্রতি ৯০ মিনিটে সরকারি ভাবে একজন ধর্ষিতা হন। কারণ, এটি একটি জঘন্য সামাজিক অপরাধ। ফাঁসি দিয়ে সাময়িক ভাবে ভাবা যেতে পারে অপরাধীর শাস্তি হয়েছে। আর কেউ এই পথ নেবে না। কিন্তু বার বার দেশে দেশে সেটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
উল্টে বিতর্ক বেঁধেছে, রাষ্ট্র যখন কাউকে প্রাণ দান করতে পারে না, তখন কারও প্রাণ নেওয়ার অধিকার কি রাষ্ট্রের আছে?
এবার আরেকটি ঘটনার কথায় আসি। ২০০৪ সালে ধনঞ্জয় যখন প্রাণ ভিক্ষার দাবিতে রাষ্ট্রপতির কাছে শেষ আবেদন রেখেছিলেন, তখন তাঁর ফাঁসির দাবিতে এই তৃণমূলের মুখপাত্র কুনাল ঘোষ ধর্মতলায় একটি প্রকাশ্য সভার আয়োজন করেন। তিনি ওই সভার ওজন বাড়াতে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এর স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্যকে এনেছিলেন। সঙ্গে সিপিএমের মহম্মদ সেলিম। তাঁরা সবাই ফাঁসির পক্ষে মত দেন।
কিন্তু আমাদের কিছু সাংবাদিকের মনে হয়েছিল কাজটা ঠিক হচ্ছে না। ধনঞ্জয়ের ক্যালিটাল পানিশমেন্টের বিরুদ্ধে আমরা কলকাতা একটি প্রেস ক্লাবে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করি। আমি আহ্বায়ক ছিলাম। সঙ্গে মিলন দত্ত, জয়ন্ত চৌধুরী, আলোক ব্যানার্জি, প্রসেনজিৎ বক্সি প্রমুখ। বক্তা ছিলেন অপর্ণা সেন, বিকাশ ভট্টাচার্য, জয়মাল্য বাগচী (তখন আইনজীবী), সরকারের এডভোকেট জেনারেল বলাই রায়, কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী এবং মডারেটর সুমন চট্টোপাধ্যায়। এরা প্রত্যেকেই মৃত্যু দণ্ডের বিরুদ্ধে মত দেন। বলাই রায় ইংল্যান্ডের একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করেন। যা খুবই প্রাসঙ্গিক।
প্রায় একশ বছরের আগে লন্ডন শহরে খুব পকেটমার হচ্ছিল সাধারণ মানুষের। প্রশাসন ও পুলিশ এটা বন্ধ করতে না পেরে নাজেহাল অবস্থা। পুলিশের মতে, ধরা পড়ে কিছু দিন জেল খাটার পর পকেটমাররা ছাড়া পেয়ে যায়। আবার অপরাধ করে।
শেষ অব্দি সিদ্ধান্ত হল, কয়েক জন পকেটমারকে প্রকাশ্যে টেমস নদীর ধারে ফাঁসিতে লটকানো হবে। সবাই যাতে দেখতে পায় তারজন্য স্টেজ বাঁধা হল। সরকার ভেবেছিল, প্রকাশ্যে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি হলে পকেটমারি বন্ধ হবে।
ফাঁসি দেখতে হাজার হাজার মানুষ ভিড় করলেন টেমস নদীর দুই পাড়ে। অপরাধীর চরম শাস্তি হচ্ছে। মানুষের উল্লাসে কান পাতা দায়। কিন্তু ফাঁসির পর যখন জনতা ঘরে ফিরছে, দেখা গেল অন্তত ৫০ জনের পকেটমারি হয়ে গিয়েছে।
এই ঘটনার উল্লেখ করে বলাইবাবু বলেছিলেন, মৃত্যুদন্ড বা ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট দিয়ে অপরাধ বন্ধ করা যায় না। তারজন্য সামাজিক আন্দোলন দরকার। মানুষের অর্থ সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন জরুরি।
কিন্তু যাঁরা রাজনীতি করেন তাঁরা সস্তায় হাততালি পেতে চান। আজ কুনালবাবু তাঁর অধীনে কাজ করা সাংবাদিক কৃষ্ণ দাসকে দিয়ে প্রতিদিন সংবাদপত্রে খবর করাচ্ছেন, ধনঞ্জয় কে ফাঁসি দেওয়া ভুল হয়েছিল। তিনি অপরাধী ছিলেন না। সেই সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে যাঁরা সাক্ষী দিয়েছিল, তাঁদের নাকি পুলিশ ভয় দেখিয়ে মিথ্যে সাক্ষী দিয়েছিল। অর্থাৎ একজন নির্দোষ মানুষের প্রাণ কাড়া হয়েছিল ভুল বিচারে।
আমি প্রতিদিনের সাংবাদিক কৃষ্ণ কুমার দাসের রিপোর্টে পুরো আস্থা রেখেই বলছি,
১) তাহলে আজ কি কুনাল তাঁর অপরাধ স্বীকার করবেন?
২) যদি ধনঞ্জয়ের ফাঁসি দেওয়া না হতো, তাহলে এই রিপোর্টে এর ভিত্তিতেই কেসটি আবার রি-ওপেন হত। কিন্তু সেটা আর সম্ভব নয়। কারণ রাষ্ট্র কারো প্রাণ নিতে পারে। দিতে পারে না।
শুধু এই একটি ক্ষেত্রেই নয়, পৃথিবীতেই বহু ক্ষেত্রেই দেখা হয়েছে, মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পর দেখা গিয়েছে ওই ব্যক্তি দোষী ছিল না।
ঠিক এই কারণেই আজ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশ গুলিতে ফাঁসি বা মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ। পৃথিবীতে মোট ১১১ টি দেশ মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। আমেরিকার ৫০ টি প্রদেশের মধ্যে কিছু প্রদেশে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ। অন্য দিকে ভারত, চিন এবং আরব দুনিয়া বিশেষ করে ইসলামিক দেশ গুলিতে মৃত্যুদণ্ড বহাল রয়েছে।
পৃথিবীতে ৫৬ টি দেশে মৃত্যুদণ্ড থাকলেও খুব কম দেশেই সেটা কার্যকর হয়।এসব থেকে বেশি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় চিন, ইরান এবং সৌদি আরবে। ইরানে কিছুটা থাকলেও বাকি দুই দেশে গণতন্ত্রের "গ" নেই।
এখন হিস্টিটিয়া রোগগ্রস্তের মত 'ফাঁসি ফাঁসি' আওয়াজ তুলে আপনি পিছনের হাঁটবেন, নাকি সামনের দিকে, সেটা আপনাকেই ভাবতে হবে। কারণ আপনি নাগরিক সমাজের একজন।