পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

তরুণ প্রজন্মের সবুজের জন্য লড়াই

  • 28 May, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 608 view(s)
  • লিখেছেন : সন্তোষ সেন
হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ৪০০ একর জঙ্গলকে উড়িয়ে দিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনার বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্মের সবুজের জন্য লড়াই। প্রকৃতির অপার ছন্দে গড়ে ওঠা একমাত্র ‘ন্যাচারাল কার্বন-সিঙ্ক’ উদ্ভিদকূল অতিরিক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইডকে নিজের শরীরে শুষে নিয়ে পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য করে রাখে। সেইসব প্রাকৃতিক জঙ্গলকে উচ্ছেদের এক করুণ গল্প শোনাবো পাঠকদের। শোনাবো সবুজ বাঁচানোর অভিযানের কথাও।

প্রকৃতির পারদ চড়ছে হুহু করে। এতদিনকার সব রেকর্ড ভেঙ্গেচুরে ২০২৪ সাল পৃথিবীর ইতিহাসে উষ্ণতম বর্ষ হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। শুধুমাত্র চরম তাপমাত্রা, তীব্র তাপপ্রবাহ এবং হিটস্ট্রোকে ২০২৪-এ ভারতবর্ষে ৭৩৩ জন অসহায় গরীব মানুষ বলিপ্রদত্ত হয়েছেন। মার্চ থেকে জুন –এই  সময়কালে ১৭টি রাজ্যে হিটস্ট্রোকে আক্রান্তের সংখ্যা ৪১, ৭৮৯। এই এক বছরেই নতুন করে সাড়ে পাঁচ কোটি সিওপিডি-র রুগি এসেছে চিকিৎসকদের কাছে। এই স্বীকৃতি স্বয়ং কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের। দিল্লি, কলকাতা সহ অনেক শহরের এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স ৫০০-এর বেশি হওয়ার নজিরও আছে। সম্প্রতি ভারতে এক পরিবেশ কর্মশালায় যোগ দিতে এসে ‘সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল ক্লাইমেট রিসার্চ’র বিজ্ঞানী বললেন –“ভারত সহ গোটা দক্ষিণ এশিয়ার স্বাস্থ্যের উপরেই মাত্রাছাড়া গরম এবং বায়ুদূষণ ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে।”
 
মেকি উন্নয়ন আর বহুতল, রাস্তা, ব্রিজ তৈরির নির্মাণকাজের দাপটে বাতাসে ভাসমান বিষাক্ত কণার পরিমাণ বাড়ছে। বিষাক্ত কণা সেঁধিয়ে যাচ্ছে মানুষের বক্ষস্থলে। হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট সহ ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন লক্ষ কোটি মানুষ। জীবাশ্ম জ্বালানির বেহিসেবি ব্যবহার এবং নির্বিচারে জঙ্গল ধ্বংস ও নদী, জলাভূমি বোজানোর পরিনামে বাতাসে বাড়ছে কার্বনের মাত্রা, পাল্লা দিয়ে বাড়ে ভূউষ্ণায়ন। অথচ প্রকৃতির অপার ছন্দে গড়ে ওঠা একমাত্র ‘ন্যাচারাল কার্বন-সিঙ্ক’ উদ্ভিদকূল অতিরিক্ত কার্বন ডাইঅক্সাইডকে নিজের শরীরে শুষে নিয়ে পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য করে রাখে। সেইসব প্রাকৃতিক জঙ্গলকে উচ্ছেদের এক করুণ গল্প শোনাবো পাঠকদের। শোনাবো সবুজ বাঁচানোর অভিযানের কথাও।

পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি প্রায় ১.৫ ডিগ্রির ঘরে পৌঁছে গেছে। মেরুপ্রদেশ ও হিমালয়ের বরফের চাদর পাতলা হচ্ছে দ্রুত। গঙ্গা সহ বড় নদীর জলস্তর দিন দিন কমছে। জীবন জীবিকা হারিয়ে মৎস্যজীবী, কৃষিজীবী সহ সমাজের এক বড় অংশের প্রান্তিক মানুষ সর্বসান্ত হচ্ছেন। দিনদিন বাড়ছে ভিটেমাটি হারা, শিকড়চ্যুত পরিবেশ-উদ্বাস্তুর সংখ্যা। মানবসভ্যতার এইসব জ্বলন্ত সমস্যা, জীবন মরণের প্রশ্নে কোন দলের কোন হুঁশ নেই। তারা শুধু ভোটের ঘুঁটি সাজাতে ব্যস্ত। প্রকৃতি উচ্ছন্নে যায় যাক, মরুক মানুষ, বিলুপ্ত হোক বন্যপ্রাণ, বাড়ুক স্বাস্থ্যসমস্যা, বাড়ুক জলের দূষণ ও সংকট, কুচ পরোয়া নেহি। রাষ্ট্র ও সরকার পণ করেছে, কর্পোরেট বাহিনীর নয়া নয়া বিনিয়োগ ও আরও আরও মুনাফা বৃদ্ধির স্বার্থে চাই উন্নয়ন, আরও উন্নয়ন। রাষ্ট্রনায়ক ও নেতাবাবুরা হুঙ্কার ছাড়ে –চালাও উন্নয়নের রথ।

কংগ্রেস-জোট শাসিত তেলেঙ্গানা সরকার
হায়দ্রাবাদ কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস সংলগ্ন কাঞ্ছা গাছিবৌলি জঙ্গল নিলামে তুলে।  
অসংখ্য প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণীকূল নিয়ে ৪০০ একর বনাঞ্চলে ৩১ মার্চ, ২০২৫ থেকে ৫০টির বেশী মাটি কাটার যন্ত্র ও বুলডোজার চালিয়ে ধ্বংসযজ্ঞের কাজ শুরু করে দেয় সরকার। বিপন্ন প্রজাতির বহু না-মানুষ সহ এই জঙ্গল এলাকায় রয়েছে দুটি অতীব সুন্দর লেক –বাফালো ও পিকক লেক এবং অসংখ্য জলাভূমি। যা শহরের বর্জ্যজল নিষ্কাশন ও শোষণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পাশাপাশি হায়দ্রাবাদের পশ্চিম অংশের ভৌমজলের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে এদের অবদান অপরিসীম। এই বনভূমিকে ধ্বংস করা মানে শহরের সংবেদনশীল জল-বাস্তুতন্ত্রকে বিনষ্ট করা। এই বনভূমিতে রয়েছে ২২০ প্রজাতির পাখি, ৭৩৪ প্রজাতির ফুলের গাছ, ১৫টি প্রজাতির সরীসৃপ, দশটি প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং অগুনতি প্রজাপতি। রয়েছে পোকামাকড় সহ মানুষের শরীরের জন্য লক্ষ কোটি উপকারী অনুজীব। সাথে রয়েছে নানান প্রজাতির প্রায় ৪০ হাজার দুর্মূল্য গাছ।

ইট পাথর লোহা লক্করের জঙ্গলের ভিতর এই সবুজ আচ্ছাদনটি হায়দ্রাবাদের টিমটিম করে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা শহুরে জঙ্গলগুলির মধ্যে অন্যতম। স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, ভরা গ্রীষ্মে এই শহরের অন্যত্র যখন জ্বলেপুড়ে খাক হয়, তখন এই জঙ্গলের চারপাশে তাপমাত্রা তুলনায় অনেক সহনীয় থাকে। মনে রাখা দরকার, এই পৃথিবী শুধু মানুষের একার নয়। এই বাসযোগ্য পৃথিবীতে সমস্ত না-মানুষ ও উদ্ভিদের রয়েছে সমান অধিকার। মুষ্টিমেয় মানুষের স্বার্থে উন্নয়নের খুড়োর কলের পিছনে ছুটতে ছুটতে সবকিছুকে কি আমরা উচ্ছন্নে পাঠাব?

কেন শুরু হয়েছে এই ধ্বংসযজ্ঞ? এখানে আইটি পার্ক অর্থাৎ তথ্যপ্রযুক্তি হাব হবে। ৫০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে। বরাত পাবে নিশ্চয়ই কোন কর্পোরেট হাঙ্গর। আমরা কি পাব? শত হাজার প্রবীণ বৃহৎ বৃক্ষের মৃত্যুবরণ। শতশত পশুপাখির মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া। সব মিলিয়ে প্রকৃতি ও মানবসভ্যতার চূড়ান্ত অবনমন। বুলডোজারের আওয়াজে পাখিরা কাঁদছে, বন্যপ্রাণ ও উদ্ভিদকূলের অন্তরাত্মা উদ্বিগ্ন। তবুও অধিকাংশ রাজনৈতিক দল নির্লিপ্ত নির্বিকার। আসলে উন্নয়নের প্রশ্নে আর কর্পোরেটের স্বার্থে শাসক, বিরোধী, সব দলের একই সুর। তারা চায় উন্নয়ন দিয়ে পুরো দেশের মাটি, জল, জঙ্গল, পাহাড়, নদী, জলাশয়: সবকিছুকে কংক্রিটের জঙ্গলে ভরিয়ে দিতে। আসলে বিশ্বজুড়েই ফুলেফেঁপে ওঠা ফিকটিশাস ক্যাপিটাল আজ চরম সংকটে। পুঁজির নিজস্ব জগতের সংকট কাটাতে এবং কাল্পনিক পুঁজির এই পাহাড়কে বাস্তবের জমিতে নামিয়ে বিনিয়োগ করে মুনাফা বৃদ্ধির হার বাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বার্থে সব দায় গিয়ে পড়ছে প্রকৃতি পরিবেশ ও মানুষের জীবনযাপনের ওপর। এছাড়া সংকটগ্রস্ত মুমূর্ষ পুঁজির আর বাঁচার উপায় নেই। মিডিয়ার প্রচারে গড়ে তোলা সর্বশক্তিমান (?) জায়ান্ট কর্পোরেট বাহিনীর এই দুর্বল গ্রন্থিতেই আজ সজোরে আঘাত হানতে হবে। জনগণের সচেতন প্রয়াসকে ওরা বড় ভয় পায়। তাই একতার শক্তিকে দূর্বল করতে বারবার করে আঘাত নেমে আসছে সংগ্রামী জনগণের ওপর।

আশার কথা, ভালো লাগার কথা, হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া ও শিক্ষকদের এক বড় অংশ সহ সারা দেশের প্রকৃতিপ্রেমিক মানুষেরা এই জঙ্গল উজাড়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সামিল হলেন। তাঁদের বিক্ষোভ সমাবেশে পুলিশ প্রশাসন নির্মমভাবে আঘাত হানে। বেশ কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী জখম হয়। তবুও পড়ুয়ারা দাঁত কামড়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা বলছেন –“উন্নয়নের দোহাই দিয়ে কোন অজুহাতেই বন্যপ্রাণ, পাখি, সবুজ বনানী সহ প্রকৃতি পরিবেশকে এইভাবে ধ্বংস করা অযৌক্তিক, অমানবিক।” দেশের বন ও বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সরকার প্রশাসন ও কর্পোরেট বাহিনী প্রকৃতি পরিবেশকে লুঠ করে এগিয়ে চলেছে দুরন্ত গতিতে। পড়ুয়া ও শিক্ষকরা প্রকল্পের যৌক্তিকতাকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতের দ্বারস্থ হন। আন্দোলনকারীদের দাবি, বনভূমি ধ্বংস বন্ধ করে এই বিশেষ অঞ্চলকে ‘ডিমড ফরেস্ট’ তালিকাভুক্ত করা হোক।

অনেক খারাপের মধ্যেও আপাত খুশির খবর লড়াকুদের মনোবল চাঙ্গা করেছে। তেলেঙ্গানা হাইকোর্ট রায় দিয়েছে (২/৪/২৫) –“অসংখ্য পশুপাখি, বৃহৎ বনানী, জীববৈচিত্র্য সম্বলিত ৪০০ একর বনভূমিকে এইভাবে ধ্বংস করা যায়না।” তেলেঙ্গানা ইন্ডাস্ট্রিয়াল কর্পোরেশনকে হাইকোর্টের স্পষ্ট নির্দেশ –পরবর্তী শুনানির আগে কোনভাবেই বনাঞ্চল সাফ করা চলবে না। এই বনাঞ্চলকে ডিমড ফরেস্ট হিসেবে ঘোষণা করা সম্পর্কে আদালত অনুসন্ধান করবেন এবং নিশ্চিত হয়ে রায় দেবেন। আদালতে সরকারের আইনজীবীর ভূমিকা কী ছিল? অ্যাডভোকেট জেনারেলের বক্তব্য –এই বনভূমি ২০০৪ সালে ‘আইএমজি একাডেমিক’কে দেওয়া হয়। কিন্তু তারা কাজ শুরু করতে না পারায় সরকার জমি ফিরিয়ে নেয়। তিনি বলেন –“জঙ্গল এলাকা বলে এই জমি চিহ্নিত নয়। বনভূমি সংলগ্ন অঞ্চলে রয়েছে অনেক বহুতল বিল্ডিং এবং একটি হেলিপ্যাড।” আহা, কী অপূর্ব যুক্তি! শহর সংলগ্ন এলাকায় বনভূমি আছে বলে তা নিয়ে যা খুশি করা যায়? সুস্থ প্রকৃতি পরিবেশ পাওয়া যে নাগরিকের একটি সাংবিধানিক অধিকার, সেই ধারণাও কি আপনার নেই বাবু এডভোকেট জেনারেল? আপনারা বুঝি কংক্রিটের জঙ্গল বানানোর নীল নকশা তৈরি করা ছাড়া প্রকৃতি ও সমাজ থেকে আর কোন শিক্ষা পাননি? সবুজ দেখলে কি আপনাদের চোখ করকর করে? তাই হয়তো আপনি সদর্পে বলতে পারেন –“অসংখ্য সরীসৃপ প্রজাতি, ময়ূর, হরিণ থাকলেই একটি বনাঞ্চল সংরক্ষিত হয়ে যেতে পারেনা।”

বিভিন্ন রাজ্যের পরিবেশ-কর্মী, প্রকৃতি-প্রেমীরা সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব হলেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষোভ প্রতিবাদ সংঘটিত হয়। বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ও রাজনৈতিক দলগুলোকে চিঠি দিয়ে এই প্রাণঘাতী প্রকল্প আটকানোর প্রক্রিয়াও চলতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৫ মে সুপ্রিম কোর্ট এক কঠোর রায় দিয়েছে। তেলেঙ্গানা সরকারের কর্মকর্তাদের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ –কাঞ্ছা গাছিবৌলি অঞ্চলে ধ্বংসপ্রাপ্ত বনভূমি দুই মাসের মধ্যে পুনরুদ্ধার করতে হবে। এই নির্দেশনা অনুযায়ী, বনভূমিতে পুনরায় বৃক্ষরোপণ ও পরিবেশ পুনর্বাসনের কাজ সম্পন্ন করতে হবে; অন্যথায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কারাদণ্ডের মুখোমুখি হতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত ‘সেন্ট্রাল এমপাওয়ার্ড কমিটি’ তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে জানিয়েছে, প্রায় ১০৫ একর বনভূমি অবৈধভাবে পরিষ্কার করা হয়েছে, যেখানে ৬০-৭০% অঞ্চল মাঝারি থেকে ঘন বনভূমি হিসেবে চিহ্নিত। এই অঞ্চলকে বনভূমি হিসেবে ঘোষণা করে তেলেঙ্গানা বন বিভাগের অধীনে আনা হোক এবং বর্ষাকালে স্থানীয় প্রজাতির গাছপালা রোপণের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করা হোক।”

সুপ্রিম কোর্টের এই রায় পরিবেশ সংরক্ষণে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগতভাবে দায়বদ্ধ করে তুলেছে এবং পরিবেশ আইন লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। ভারত রাষ্ট্র সমিতি (BRS) তথা সাবেকি তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি বনভূমি ধ্বংসের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত সেন্ট্রাল এমপাওয়ার্ড কমিটির কাছে তেলেঙ্গানা সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন করেছে। BRS নেতা কে টি রামা রাও বলেছেন –“সুপ্রিম কোর্টের রায় পরিবেশবাদীদের উদ্বেগকে বৈধতা দিয়েছে এবং সরকারের পরিবেশবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।”

উল্লেখ্য, বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া বনাঞ্চল রক্ষার ক্ষেত্রে একই দিনে সুপ্রিম কোর্ট আর একটি ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে। উড়িষ্যার এক বনভূমি এবং পুনের কন্ধা বুদ্রক সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ১২ হেক্টর জমি এক প্রোমোটারকে বিক্রি করে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তকে সম্পূর্ণ বেআইনি অ্যাখা দিয়ে সমস্ত রাজ্য সরকারের মুখ্যসচিব ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের প্রশাসনিক মহলকে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ –“মোট কত বনভূমি বেসরকারি মালিকানার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে তা খুঁজে বের করতে হবে। তাঁরা যেন বিশেষ তদন্ত দল গঠন করে পরীক্ষা করেন যে, বন বিভাগের অধীনে থাকা কোন সংরক্ষিত বনাঞ্চল বনায়ন ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা রিয়েল এস্টেট ডেভেলপারদের কাছে বরাদ্দ করা হয়েছে কিনা।” এই রায়ে (১৫ মে, ২০২৫) বলা হয়েছে, এই বনভূমি পুনরুদ্ধার করতে হবে। যদি কোন কারণে জমি পুনরুদ্ধার সম্ভব না হয়, তবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে সমপরিমাণ অর্থ আদায় করে বিকল্প জমিতে বনায়নের জন্য ব্যবহার করতে হবে এক বছরের সময়সীমার মধ্যে। আদালতের এইসব রায়ে পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী সহ বনবাসীরা সত্যিই উচ্ছসিত আনন্দিত। আদালতের সদর্থক ভূমিকাকে কাজে লাগিয়ে তীব্র গণ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকারগুলোকে বাধ্য করতে হবে তথাকথিত উন্নয়নের নামে বনভূমি ধ্বংস, নদী দখল, জলাভূমি বোঝানোর চক্রান্ত বন্ধ করতে। মেকি উন্নয়নকেই চ্যালেঞ্জ করতে হবে। এটাই সময়ের দাবি।

হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের আশি শতাংশের বেশি পড়ুয়া অন্য রাজ্যের হলেও আন্দোলনে সামিল হয়েছে জঙ্গলকে ভালোবেসে প্রকৃতিকে রক্ষা করার তাগিদে। নিজেদের কোন ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়, তারা লড়াইয়ে নেমেছে অসংখ্য বন্যপ্রাণ ও উদ্ভিদকূলকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে। হায়দ্রাবাদের ফুসফুস বলে পরিচিত এই বনভূমিকে টিকিয়ে রেখে বাতাসকে নির্মল রাখার লক্ষ্যে। প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ রক্ষার লড়াইয়ের সমর্থনে পথে না নামলে শেষ গোলাপটিও যে গ্রেফতার হয়ে যাবে। হাতে আর সময় নেই বন্ধু। ভয়ংকর ভবিষ্যতের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে দোরগোড়ায়। এইবেলা সচেতন না হলে, রুখে না দাঁড়ালে আমাদের অস্তিত্বই এক বড়সড় প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ে যাবে। উন্নয়নের প্রবল বেগে হাঁসদেও অরণ্য, গড়চিরৌলি, দেউচা পাঁচামি, পুরুলিয়ার ঠুগরা, বান্দু সহ দেশের প্রায় সব প্রান্তে প্রকৃতি পরিবেশ ভয়ঙ্করভাবে বিপন্ন হচ্ছে। বিস্তৃর্ণ বনভূমি ও খনিজ সম্পদ দখল করার নীল চক্রান্তে বস্তার অঞ্চলের আদিবাসীদের ভারত সরকার নির্বিচারে হত্যা করছে। সরকার বাহাদুর ও কর্পোরেট পোষিত মিডিয়া বাহিনী মাওবাদী জুজুর কথা প্রচার করছে। গোপন কথাটি গোপনেই রয়ে যাচ্ছে। বাস্তবে দেশের আজ সব বনাঞ্চল কর্পোরেটের শ্যেনদৃষ্টির কবলে।

এই প্রসঙ্গে পিপলবাবা কী বলছেন শোনা যাক। দেশের ১৮টি রাজ্যের দুইশোর উপর জেলায় নিজের টিমকে সঙ্গী করে ২ কোটির বেশি গাছ লাগিয়েছেন যে মানুষটি তিনি বলছেন –“যে দেশ পাহাড়, ঝর্ণা, জঙ্গলকে আগলে রাখতে পারেনা, যে দেশ এইসব কিছুকেই ধ্বংস করতে চায়, যে দেশ বনভূমিকে সম্মান করেনা, জঙ্গলের গুরুত্ব বোঝেনা,বনভূমি সংরক্ষণ করতে জানেনা, সেই দেশের কোন উন্নতি হবে না। দেশের মানুষের সত্যিকারের কোন কল্যাণও হবে না। দেশের নদী, জলাভূমি, জঙ্গল, পাহাড়, সবকিছুকে আগলে রেখে, প্রকৃতি পরিবেশকে রক্ষা করে সত্যিকারের উন্নতির পথে কি এগোনো সম্ভব নয়?”

আর এক প্রথিতযশা মানুষ প্রয়াত মহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলের জীবনদর্শন –“মানুষের লেখা ধর্মগ্রন্থের পরিবর্তে প্রকৃতিই (nature) ঈশ্বরের প্রকৃত প্রকাশ।” প্রাকৃতিক জগত তার নিজস্ব রূপ, রস,গন্ধ, সৌন্দর্য, মাধুর্য বিলিয়ে প্রকৃতির সন্তান মানুষকে প্রাকৃতিক করে। ধর্মীয় কর্তৃত্বের প্রতি অন্ধবিশ্বাস থেকে বেরিয়ে এসে মানুষকে স্বাধীন অনুসন্ধানে ব্যাপ্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বারংবার। তাই তিনি বলতেন, নিজের ক্ষুদ্র গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে প্রকৃতিকে অন্বেষণ করো। আর প্রকৃতিপ্রেমিক রবীন্দ্রনাথ বলেন –“আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া। বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া।”

আশার কথা, ভরসার কথা –প্রকৃতিপ্রেমিক মানুষ, বিজ্ঞান ও পরিবেশ কর্মীরা একজোট হচ্ছেন প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে। সুস্থ পরিবেশে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার সাংবিধানিক অধিকার ফিরে পাওয়ার দাবিতে। এটাই নদীমাতৃক, শস্যশ্যামলা, সুজলা সুফলা ভারতবর্ষের প্রকৃত ঐতিহ্য। এই দেশের মানুষের জীবনযাপন এবং সাহিত্যচর্চা ছিল প্রকৃতিমুখীন। কালিদাস, জীবনানন্দ, বিভূতিভূষণ, রবীন্দ্রনাথ, মনোজ বসুর মতো সাহিত্যকার বারবার করে প্রকৃতি প্রেমের কথা বলে গেছেন। তাঁদের সাহিত্যে প্রকৃতির পূজা করেছেন। প্রকৃতিতে মানুষকে ফিরে যেতে বিশ্বকবি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।

স্পষ্ট বুঝে নেওয়ার সময় এসেছে –প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন আজ অঙ্গাগীভাবে যুক্ত হয়ে গেছে সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকারের সাথে। গরীব মানুষের সুস্থ সুন্দর পরিবেশ পাওয়ার দাবির সাথে। পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য করে রাখার এবং মানব সভ্যতাকে এই নীল গ্রহে টিকিয়ে রাখার কাজের সাথে। পুঁজির সাথে প্রকৃতির দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে সম্মিলিত হতে হবে গরীব মানুষের বেঁচে থাকার স্বার্থেই। আগামী প্রজন্মকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে। বুকভরা শুদ্ধ বাতাস টেনে নিয়ে, বিষহীন সবুজ সতেজ খাবার খেয়ে, বিশুদ্ধ জল পান করে, নির্মল আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে, প্রকৃতির কোলে মাথা রেখে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার স্বার্থে, সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার স্বার্থে। পথে নামতেই হবে সম্মিলিত শক্তির ওপর ভরসা করে, সহযোগিতা ও বন্ধুত্বের ওপর ভর করে। আসুন, হাতে হাত রেখে, পায়ে পা মিলিয়ে পথ হাঁটি।
 

0 Comments

Post Comment