গল্পটা সবাই জানেন। তবু আর একবার বলছি। একবার এক ভদ্রলোক একটি অজগর পুষেছিলেন। ওই সেই ভদ্রলোক, যে তাঁর ছেলেবেলায় দুলে দুলে বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় থেকে পড়তেনঃ
‘অ- অজগর আসছে তেড়ে
আ- আমটি আমি খাব পেড়ে।’
সত্যিই, যিনি অজগর তেড়ে এলেও নিজেদের বাগানের আম পেড়ে খেতেন, তিনি অজগর পুষবেন না তো আর কে পুষবেন?
আজকের গল্পের ভদ্রলোক সেদিনের সেই ছোট ছেলেটি। ভদ্রলোক সম্পর্কে আর কোনও পরিচয় দেব না। না হলে তিনি লজ্জা পাবেন। আমি চাই না তিনি লজ্জা পান। কেননা, তিনি আমার পিতা হতে পারেন। পুত্র হতে পারেন। আবার রাষ্ট্রপিতাও হতে পারেন।
যাইহোক, গল্পটা আগে বলি।
ভদ্রলোক অজগরটিকে প্রচণ্ড ভালবাসতেন। অসম্ভব যত্ন নিতেন। নিজের বিছানায় নিয়ে ঘুমোতেন। অজগরটি ছাড়া এই পৃথিবীতে এমন কিছু ছিল না যা নিয়ে তিনি খুব বেশি ভাবতেন।
হঠাৎ একদিন ভদ্রলোক লক্ষ্য করলেন, তার প্রিয় অজগরটি কিছু খাচ্ছে না। আগের মতো ঘরদ্বোরে ঘুরে বেড়াচ্ছে না। কেমন মনমরা হয়ে সবসময় বিছানায় শুয়ে থাকছে। তিনি কাছে গেলে এমন ভাবে তাঁকে জড়িয়ে ধরছে, যেন বলছে, আমার প্রচণ্ড অসুখ। পারলে আমাকে বাঁচাও বাবা!
তা দেখে ভদ্রলোকের কান্না পায়। একজন পিতা যেমন তার একমাত্র সন্তানকে অসুস্থ দেখে অসহায় হয়ে পড়ে ভদ্রলোকেরও সেই অবস্থা হয়। অগত্যা তিনি ডাক্তারের স্মরণাশ্রিত হন।
ডাক্তার সব শুনে অজগরটিকে পরীক্ষানিরীক্ষা করে বললেন, আপনি যে অজগরটিকে সন্তান স্নেহে পালন করেন সেটা বুঝতে পারছি। কিন্তু আপনার বোঝা উচিত ছিল অজগর কখনও মানুষের সন্তান হয় না। আপনি ভাবছেন ওর অসুখ বলে আপনার বিছানায় শুয়ে থাকছে, তা নয় কিন্তু। ওর ওভাবে শুয়ে থাকা মানে আপনাকে কিভাবে গিলে খাবে তার ছক কষা। আর সে খাচ্ছে না দাচ্ছে না মানে নিজের উদর ফাঁকা করছে যাতে আপনাকে খুব সহজেই গিলতে পারে।
এরপর ভদ্রলোকের কী অবস্থা হয়েছিল, গল্পে তার উল্লেখ নেই। তবে অনুমান করতে অসুবিধা হয় না যে, অজগরটিকে ফেলে সেখান থেকে তিনি প্রাণ বাঁচাতে সটান ছুট লাগিয়েছিলেন। আর অজগরটি তাঁর পিছু ধাওয়া করেছিল। আগে আগে ভদ্রলোক পিছে পিছে অজগর!
লকডাউনে পড়ে আমাদের অবস্থা এখন ওই ভদ্রলোকের মতো। আমরা আমাদের ঘরে লুকিয়ে বসে আছি। আর করোনারূপী অজগর আমাদেরকে সারা পৃথিবী জুড়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
কিন্তু যাদের ঘর নেই। আসুন দেখে নিই তাদের নিয়ে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কী বলছেন, ‘তিস্তামুখ ঘাটে নেমে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি ফুলছড়ি হাটের দিকে, ওখান থেকে রিকশা করে যাবো ভরতখালি। যমুনায় তখন বাৎসরিক ভাঙন শুরু হয়েছে, পাটখড়ির বেড়া দেওয়া খড়ের চালওয়ালা সারি সারি ঘর নদীর তীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কাঁপছে, যে কোনো সময় স্রোতের একটি ছোবলে অতল জলে তলিয়ে যেতে পারে। এইসব ঘরকে ঘর বলা মুশকিল, জন্তু জানোয়ারের গর্তেও এর চেয়ে নিরাপত্তা ও আরাম অনেক বেশি। বাসিন্দারা মহা নির্লিপ্ত চোখে যমুনার ঢেউ দেখছিল, রোগা চেহারায় লাবণ্যের নামগন্ধ মাত্র নেই। ... এরই মধ্যে আমার চোখে পড়ল পাটখড়ির ভাঙাচোরা বেড়ায় শুকোতে দেওয়া ছেঁড়া কয়েক টুকরো কাঁথার দিকে। আক্ষরিক অর্থে ছেঁড়া; মলিন ও নোংরা কাঁথায় লাল ও নীল সুতোর অপূর্ব কারুকাজ, কাঁথার প্রত্যেকটি টুকরায় নকশা, ফুলের নকশা, মাছের নকশা, নৌকার নকশা। ঐ মেঘলা আকাশের নিচে, নির্বোধ, হতকুচ্ছিৎ, ব্লান্ট চেহারার অনাহারক্লিষ্ট ভাঙাচোরা শরীরের এই সব মানুষের ঝোপড়ির বেড়ায় এই শিল্পকর্ম দেখে আমি খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ... কিন্তু বেখাপ্পা লাগেনি, অনন্ত কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারি যে এতো জুলুম আর শোষণের পর এই জানোয়ার সুলভ জীবনযাপন করেও এরা যে মানুষ রয়ে গেছে তারই নিশান টাঙিয়ে রেখেছে নুয়ে পড়া বেড়ার গায়ে। এটুকু চোখে পড়লেও মানুষের সম্ভাবনা সম্বন্ধে আশা করা যায়।’