পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ফ্যাসিবাদী ভারতে স্বাগত

  • 28 June, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1458 view(s)
  • লিখেছেন : সোমনাথ গুহ
বৃত্ত ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে; এখন যে কোনও দিন, যে কোনও সময়ে, যে কোনও স্থানে, বিনা কারণে অথবা মামুলি কারণে প্রতিবাদী মানুষ গ্রেপ্তার হতে পারেন এবং তাঁকে অজানা স্থানে চালান করা হতে পারে। সমাজকর্মী তিস্তা সীতলাবাদ এবং ভুয়ো খবরের পর্দা ফাঁস করার অন্যতম মুখ মহম্মদ জুবেইরের গ্রেপ্তারি তাই প্রমাণ করে। প্রতিবাদের পরিসর ক্রমশ ছোটো হয়ে আসছে, প্রতিবাদীদের হাজতে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। ঘুরে এখন দাঁড়াতেই হবে কারণ আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।

দেশ এখন আর কোনও সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে নেই। অপ্রতিরোধ্য গতিতে এবং অনিবার্য ভাবে গণতন্ত্র ফ্যাসিবাদের গহন গভীর গহ্বরে ঢুকে পড়েছে। প্রায় প্রতি দিন চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটছে। ২৭শে মে বিজেপি মুখপাত্র (ফ্রিঞ্জ!), নুপুর শর্মা হজরত মহম্মদ সম্পর্কে তাঁর বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন। এর এক মাসের মধ্যে এলাহাবাদে ওয়েলফেয়ার পার্টির জাভেদ মহম্মদ গ্রেপ্তার হলেন ও তাঁর স্ত্রীর নামে যে বাড়িটিতে তিনি বসবাস করতেন তা গুঁড়িয়ে দেওয়া হল, অগ্নিপথ প্রকল্প ঘোষিত হল এবং দেশজুড়ে ছাত্রযুবদের বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ল এবং মহারাষ্ট্রের আগাড়ি সরকার ভাঙনের সম্মুখীন হল। সুপ্রিম কোর্টের এক অভিনব রায়ে তিস্তা শেতলবাদ ও আর বি শ্রীকুমার গ্রেপ্তার হওয়ার সাথে সাথে জানা গেল ‘গুজরাট ফাইলস’ খ্যাত রানা আইয়ুবের টুইটার একাউন্ট স্থগিত করা হয়েছে ও অল্ট নিউজের মহম্মদ জুবেইর গ্রেপ্তার হয়েছেন। জুবেইর ভুয়ো খবর ফাঁস করার সংস্থার অন্যতম কর্ণধার। বিজেপি আইটি সেলের বহু মিথ্যা খবর, জাল ভিডিওর উনি পর্দাফাঁস করে দিয়েছেন। নুপুর শর্মার মন্তব্যটি তিনিই প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছিলেন। এটা এক অদ্ভুত পরিহাস যে ধর্মীয় বিদ্বেষমূলক মন্তব্য যিনি করলেন তাঁর বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হল না, অথচ যিনি সেটার প্রতিবাদ করলেন তাঁকে ২০১৮র একটি টুইটের অজুহাতে গ্রেপ্তার করা হল। বৃত্ত ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে; এখন যে কোনও দিন, যে কোনও সময়ে, যে কোনও স্থানে, বিনা কারণে অথবা মামুলি কারণে প্রতিবাদী মানুষ গ্রেপ্তার হতে পারেন এবং তাঁকে অজানা স্থানে চালান করা হতে পারে।

২০২১ এর আগস্ট মাসে শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতি মানবাধিকার লঙ্ঘিত হওয়ার বিপদ সম্পর্কে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন পুলিশের অতি সক্রিয়তা রোধ করার জন্য সংবিধান স্বীকৃত আইনের অধিকার সম্পর্কে তাঁদের সচেতন করতে হবে। তারপরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বহু ঘটনা ঘটে গেছে, লিখতে গেলে ইতিহাস হয়ে যাবে। ২৫শে জুন বিকেল ৫টা ২০ মিনিটে তিস্তা শীতলবাদ লিখছেন গুজরাট এটিএস বাহিনীর সশস্ত্র লোকেরা কোনও এফআইআর বা ওয়ারেন্ট ছাড়াই হুড়মুড় করে তাঁদের বাড়ির চৌহদ্দিতে ঢুকে পড়ে। তাঁকে তাঁর আইনজীবীকে ফোন করতে বাধা দেওয়া হয়, যে কারণে তাঁর হাতে চোট লাগে। হাতে লেখা দরখাস্তে তিনি অভিযোগ করেছেন যে তিনি জীবনহানির আশঙ্কা করছেন। মাননীয় প্রধান বিচারপতি নিশ্চয়ই ইতিমধ্যেই পুলিশের এই অতি আগ্রাসী ভূমিকা সম্পর্কে অবহিত হয়েছেন। তাঁর জ্ঞাতার্থে জানানো দরকার যে ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেপ্তার করা এখন মান্যতা পেয়ে গেছে, এটা যে সম্পূর্ণ বেআইনি সেটাই মানুষ ভুলে যাচ্ছে। জুবেইয়ের ক্ষেত্রেও এফআইআরের কোনও নোটিশ দেওয়া হয়নি, কোনও কপিও দেওয়া হয়নি। দ্বিতীয়ত একটি রাজ্য থেকে আরেকটি রাজ্যে গিয়ে গ্রেপ্তার করাও এখন রেওয়াজ হয়ে গেছে, এর জন্য সেই রাজ্যের পুলিশ প্রশাসনের সম্মতির কোনও দরকার নেই। স্মরণ করুন দিশা রবিকে কীভাবে দিল্লি পুলিশ ব্যাঙ্গালোরে উড়ে গিয়ে, তাঁর স্বজনদের অন্ধকারে রেখে, তাঁকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে এসেছিল। কিংবা সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীকে মামুলি সমালোচনার জন্য কীভাবে আসাম পুলিশ জিগ্নেশ মেওয়ানিকে গুজরাট থেকে ধরে নিয়ে এসেছিল! তৃতীয়ত গুজরাট এটিএস (অ্যান্টি টেরোরিজম স্কোয়াড) কেন তিস্তাকে গ্রেপ্তার করবে? এটিএস তো সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করার জন্য গঠন করা হয়েছে। তিস্তা কি কোনও সন্ত্রাসবাদী?

গুলবার্গ সোশাইটিতে এহসান জাফরি ও আরও ৬৩ জনের মৃত্যু সংক্রান্ত মামলার রায় তো এক কথায় নজিরবিহীন! জাকিয়া জাফরির অভিযোগ এই গণহত্যা প্রশাসনের মদতে এবং এক বৃহৎ ষড়যন্ত্রের কারণে হয়েছে। ২০১২ সালে বিশেষ তদন্তকারী দল (সিট) রায় দেয় তৎকালীন রাজ্য সরকার এবং মুখ্যমন্ত্রী এই গণহত্যার জন্য কোনভাবেই দায়ী ছিলেন না। জাকিয়া সুপ্রিম কোর্টে যান। সম্প্রতি শীর্ষ আদালত সিটের রায়কে মান্যতা দেয় এবং জাকিয়ার অভিযোগ খারিজ করে দেয়। এই পর্যন্ত ঠিকই আছে, কেউই আশা করেননি যে রায় রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে যাবে। এরপরেই আদালত অভাবনীয় ভাবে তাঁর এক্তিয়ারের বাইরে চলে গিয়ে অভিযোগকারীদেরই দোষি সাবস্ত্য করে। রায়ে বিচারকরা সিটের তদন্তের ভূয়সী প্রশংসা করেছে। তারপরেই তাঁরা বলছেন গুজরাটের কিছু বিরাগভাজন অফিসার অন্য কয়েকজনের সাথে জেনে বুঝে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছেন। গত ১৬ বছর ধরে তাঁরা নাকি দুরভিসন্ধিমূলক উদ্দেশ্যে তাওয়া গরম করে রেখেছেন। অভুতপূর্ব ভাবে আদালত নিদান দিচ্ছে যাঁরা এইভাবে আইনি প্রক্রিয়ার অপব্যবহার করেছেন তাঁদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এরপরে অমিত শাহের বিবৃতি। তাঁর নিজের কথাতেই তিনি রায়টি পুরো পড়েও দেখেননি, কিন্তু তিস্তা শেতলবাদের নাম দেখেছেন, তাঁর এনজিওর নাম দেখেছেন, যেটাও তিনি ভুলে গেছেন এবং তারপরেই তড়িৎগতিতে তিস্তা ও শ্রীকুমার গ্রেপ্তার। এরপরেও কি কোনও সন্দেহ থাকতে পারে যে এটি একটি পুরোপুরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রায়!

আদালত বলছে যে জাকিয়া জাফরি তিস্তার কথা মতো কাজ করেছেন, তাঁকে নাকি তোতা পাখির মতো তিস্তা শিখিয়েছেন,পড়িয়েছেন, তাঁর আবেগ বেদনার সুযোগ নিয়েছেন। জাকিয়া কিন্তু এরকম কোনও অভিযোগ করেননি। আদালত তাঁর মনের ভিতরে ঢুকে এটা কী ভাবে জানল সেটাই আশ্চর্যের! আর দাঙ্গাপীড়িতদের সাহায্য করাই তো একজন আইনজীবী বা মানবাধিকার কর্মীর কাজ। আমরা সাধারণ মানুষ তাঁদের কাছে কেন যাই? যাতে আইনি লড়াইয়ে তাঁরা আমাদের পরামর্শ দিতে পারেন। তিস্তা বা হর্ষ মান্দারের মতো নিবেদিত কর্মীরা গত কুড়ি বছর ধরে পাহাড়প্রমাণ ধৈর্য ও সাহসের সঙ্গে গুজরাট গণহত্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করার চেষ্টা করেছেন। এঁদের এই নিরলস প্রচেষ্টার কারণেই ১৮৪ জন গণহত্যার জন্য দোষী সাবস্ত্য হয়েছেন। এঁদের জন্যই তৎকালীন মন্ত্রী মায়া কোদনানি, বাবু বজরঙ্গিকে নারোদ পাটিয়া মামলায় যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়েছে, বেস্ট বেকারি মামলাতেও চারজনের সাজা হয়েছে, নৃশংস ভাবে ধর্ষিতা বিলকিস বানোকে সরকার ক্ষতিপূরণ ও চাকরি দিতে বাধ্য হয়েছে যে কারণে তিনি নতুন করে জীবন শুরু করতে পেরেছেন। শীর্ষ আদালতের এই রায় পুলিশ, প্রশাসন, শাসক দ্বারা নিপীড়িত মানুষদের কাছে একটা হুমকি স্বরূপ। রায় যেন বলছে সুবিচারের জন্য মানবাধিকার কর্মী, ‘যাঁরা ঠাণ্ডা ঘরে আরামদায়ক পরিবেশে বসে থাকে’, তাঁদের কাছে গিয়ে তোমার কোনও লাভ হবে না, এঁরা তোমাদের সমস্যার সুরাহা করতে পারবে না। মানবাধিকার কর্মীদের অবদানকে এই রায় হেয় করেছে এছাড়াও সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করাকে নিরুৎসাহিত করছে। এরপরে বিচারব্যবস্থার ওপরে মানুষের আদৌ কি আর কোনও ভরসা থাকবে?

সুপ্রিম কোর্ট গুলবার্গ সোসাইটির হত্যাকান্ডে কোনও বৃহৎ ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব খারিজ করে দিয়েছে। এটা করে পূর্বে গুজরাট ‘দাঙ্গা’ সম্পর্কে তাঁদের এবং অন্যান্য আদালতের বিভিন্ন মন্তব্যের তাঁরা বিরোধীতা করেছেন। ২০০৪য়ে এই আদালতেরই একটি বেঞ্চ বলছে, আধুনিক যুগের নিরোরা অন্যত্র তাকিয়ে ছিল যখন বেস্ট বেকারি এবং নিরীহ নারী ও শিশুরা দগ্ধ হচ্ছিলেন। ২০১২ সালে একটি নিম্ন আদালত ষড়যন্ত্রের তত্ত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে মায়া কোদনানি ও বাবু বজরঙ্গিকে দন্ডিত করেছিল। শ্রীকুমার নানাবতি কমিশনের কাছে ‘দাঙ্গা’য় সরকারের মদত সম্পর্কে হলফনামা দিয়েছিলেন। নির্বাচনের প্রস্তুতির সময় ইলেকশন কমিশনারকে জানিয়েছিলেন যে রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় আইন শৃংখলার অবস্থা ভোটের পক্ষে অনুকূল নয়। এর জন্য তাঁর পদোন্নতি আটকে দেওয়া হয়েছিল। অবসর গ্রহণের পরেও তিনি আইনি লড়াই চালিয়ে যান এবং ২০০৮ সালে ডিআইজি পদে উন্নিত হন। ‘দাঙ্গা’ সম্পর্কে তাঁর অবস্থান যদি আইনের চোখে মিথ্যা হতো তাহলে কী করে তাঁকে পরবর্তি কালে প্রোমোশন দেওয়া হল? এসবই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে তিস্তা, শ্রীকুমার, সঞ্জীব ভাট প্রতিহিংসার শিকার।

অতীতের মামলার রায় সম্পর্কে বিস্মৃত হওয়াটাও ইদানিং একটা রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৯১ সালে সংসদে আইন পাস হয়েছিল যে বাবরি মসজিদ ছাড়া দেশের আর কোনও ধর্মস্থানের স্টেটাস পরিবর্তন করা যাবে না। বিজেপি সেই আইনের তোয়াক্কা না করে কাশী, মথুরা সহ বিভিন্ন জায়গায় মসজিদের স্থানে মন্দিরের সন্ধানে মরীয়া হয়ে পড়েছে। শীর্ষ আদালত এটা নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করছে না। সামগ্রিক ভাবে বিচারব্যবস্থার ভূমিকা হতাশজনক। এলাহাবাদে আমরা জানি জাভেদ মহম্মদকে শহরের গন্ডগোলের জন্য দায়ী করে তাঁর স্ত্রীর বাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। শীর্ষ আদালত শুধু বলে আইন মেনে উচ্ছেদ অভিযান চালাতে হবে এবং কোনও বাড়ি ভাঙ্গার আগে নোটিশ জারি করতে হবে। এইটুকু বলে তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে। এই ভয়ঙ্কর কান্ড যারা ঘটিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, পরিবারটিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া, এসব ব্যাপারে তাঁরা নিশ্চুপ। কর্ণাটকের ছাত্রীরা যখন যুক্তি দিলো যে হিজাব পরা সংবিধান অনুযায়ী তাঁদের মৌলিক অধিকার, আদালত তখন বিষয়টাকে ঘুরিয়ে দিয়ে বলে দিলো যে কোরানে বলা আছে হিজাব পরা বাধ্যতামূলক নয়। এটা উদ্ধৃত করে তাঁরা স্কুল কলেজে হিজাব পরা নিষিদ্ধ করে দিল।

মাঝেমধ্যে মনে হয় আমরা যেন একটা দীর্ঘায়িত দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিয়ে পরিব্রাজন করছি। এই দুঃসময় তাড়াতাড়ি শেষ হওয়ার নয়। প্রতিবাদের পরিসর ক্রমশ ছোটো হয়ে আসছে, প্রতিবাদীদের হাজতে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। ঘুরে এখন দাঁড়াতেই হবে কারণ আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।

0 Comments

Post Comment