‘এক অবাক-জলপান ও কলকাতার কিডনি’
১৯৮০ সালে বামফ্রন্ট সরকার দেশের প্রথম পরিবেশ দপ্তর তৈরী করেন আর সেই দপ্তরের আসেন ইংল্যান্ডের গ্লাসগো ইউনিভারসিটি থেকে এনভায়রনমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং এ ডিগ্রীধারী ডঃ ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ।শহর আরও বাড়বে, আরও জমি দরকার হবে, বৃটিশ আমলের নিকাশি ব্যবস্থারই বা কী হাল এসব ভাল করে জরিপ করে পরিকল্পনা করার ভার পড়ল ডঃ ঘোষের হাতে।
পরিবেশ বিদ্যার জ্ঞান থেকে ডঃ ঘোষ সহজেই বুঝতে পারলেন পূর্ব-কলকাতার জলাভূমি এক অতি আশ্চর্য বস্তু আর তার চাইতেও আশ্চর্য ওখানকার জেলে ও চাষি পরিবার। তারা বংশ পরম্পরায় এক জটিল প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে ব্যবহার ক’রে শহরবাসীর মুখে শুধু সস্তার মাছ আর সবজি তুলে দিচ্ছে না, শুধু নিজেদের অন্ন সংস্থান করছে না।শহরের বিপুল নোংরা জল যা ‘সোলার পন্ড’-এ পড়ে সবুজ ও প্রাকৃতিক খাবারে বদলে যাচ্ছে, তাকে মাছের খাবার হিসাবে ব্যবহার করে জলের ‘বিওডি’ ও ‘সিওডি’ (জলের অরগানিক ও বর্জ্য দূষনের মাপ) আর কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়ার নিয়ন্ত্রণ ঘটাচ্ছে।যদি যান্ত্রিক ভাবে এই প্রক্রিয়া চালাতে হত তবে কোটি-কোটি টাকা ব্যয় করেও কুলোত না।
তার উপর কলকাতা কর্পোরেশনের পাম্পিং স্টেশনগুলো এখানে যদি জল নিকাষি না করতে পারে তবে সমুদ্র তল থেকে সামান্য উঁচুতে থাকা কলকাতা বড় প্লাবন সামলাতে পারবে না।কিয়োটো চুক্তির অনেক বছর আগে বসে একজন বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার এসব ভেবেছেন।ডঃ ঘোষ উপলব্ধি করলেন পূর্বকলকাতার জলাভূমি “কলকাতার কিডনি” আর শুধু তাই নয় এটা জলবায়ু পরিবর্তন-জনিত প্লাবন থেকে বাঁচার সব চেয়ে বড় হাতিয়ার।
কিন্তু তা তো হল।তিনি এ কথা কর্তাদের বোঝাবেন কী করে।একে তো জমি মাফিয়াদের চাপ, তার উপর সরকার চায় উন্নয়ন, সবার তো এতো তলিয়ে ভাবার ইচ্ছে বা ক্ষমতা নেই।এমন-ই এক সন্ধিক্ষণে, ১৯৮৬ সালে ডঃ ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ তখনকার মুখ্যমন্ত্রির শরণাপন্ন হলেন।পরবর্তীতে তার নিজের কথায়, ‘শুধু মাত্র রাজনীতি আর ক্লাস স্ট্রাগল ছাড়া কিছু না বোঝা, বেজায় গম্ভীর ও কম কথা বলা জ্যোতি বসুকে পূর্ব কলকাতার জলাভূমির গুরুত্ব বোঝানোর জন্য বেশি সময় তিনি পাবেন না আর সুযোগ একবারের বেশিও পাবেন না একথা জানা ছিল।জ্যোতি বসু সময় দিয়েছিলেন।’
কিন্তু জ্যোতি বসুকে এই জলাভূমির জল পরিশোধনের প্রাকৃতিক ক্ষমতা বোঝাতে গিয়ে ওখান থেকে এক পাত্র জল তুলে সটান খেয়ে ফেলেন ডঃ ঘোষ।‘দেখুন কতো পরিস্কার জল’, জ্যোতি বসু নাকি চমকে গিয়েছিলেন কাণ্ড দেখে।ডঃ ঘোষের নিজের মতে এ ছাড়া তাঁর কোনও পথ ছিল না।এই ঘটনা তার মৃত্যুর পর আরও বেশি জানাজানি হয় কারণ এটা তিনি বহু জায়গায় বলেছেন।আমরা অনেকে সেভাবেই জানি।
জ্যোতি বসু কথা দিয়েছিলেন আইনি বা বেআইনি কোনও জমি অধিগ্রহনের মাধ্যমে এই জলভূমি যাতে ক্ষতিগ্রস্থ না হয় তা তিনি দেখবেন।কিন্তু পুরোটা পারেননি।১৯৯২ সালে সল্টলেকের সম্প্রসারণ ও ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের জন্য এই জলাভূমির ৮০০ একর চাওয়া হয়।হাইকোর্টে মামলা করে ‘পাবিলক’ (People’s United for Better Living) বলে একটি সিভিল সোসাইটি অরগানাইজেশন।তত দিনে পূর্ব-কলকাতার জলভূমি বাঁচাও আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে আর সেই আন্দোলন আর সেই সংক্রান্ত জনস্বার্থ মামলাকে নিজের সরকারি চাকরি বাঁচিয়ে লুকিয়ে সব রকম গোপন নথি ও পরামর্শ সরবরাহ করে চলেছেন ডঃ ঘোষ।কাজটা ঠিক কতটা কঠিন আমরা বোধ হয় কল্পনাতেও আনতে পারব না।কালজয়ী রায় দিলেন জাস্টিস উমেশ চন্দ্র চ্যাটার্জি, যার ফলে জলাভূমির বাকি এলাকা ‘নো ডেভলপমেন্ট জোন’ ঘোষিত হল আর বলা হল ২০০০০ একর এসে ১০০০০ একরে দাঁড়িয়েছে।আর নয়।
কিন্তু এর পরেও চ্যালেঞ্জ ছিল এই রায়কে আইনে পরিণত করা ও কাজে লাগানো আর এলাকার ম্যাপ বানানো।তাই থেমে থাকার সময় ছিল না।তাঁর অসাধারণ ধৈর্য আর বৈজ্ঞানিক পারদর্শিতা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে ডঃ ঘোষ রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ক্রমাগত দর কষাকষি করতে করতে বানিয়ে গেছেন নথি যা ভারত সরকারের পরিবেশ ও বন দপ্তর ঘুরে চলে গেছে ‘রামসার’ সংস্থার কাছে, যারা আন্তর্জাতিক ভাবে জলাভূমিকে স্বীকৃতি দেয়।সেই স্বীকৃতি আসে ২০০২ সালে।রামসার জানায়, পূর্ব-কলকাতার জলাভূমি পৃথিবীর পরিবেশে এক বিরল দৃষ্টান্ত যেখানে শহরের নোংরা জল মানুষকে খাদ্য ও জীবিকা দিচ্ছে, শহর ও প্রকৃতিকে পরিস্কার রাখছে।পূর্ব-কলকাতার জলভূমি প্রাকৃতিকভাবে বর্জ্য-জল বা ওয়েস্ট-ওয়াটার পরিশোধনের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এক জলাভূমি। (Wetland of International Importance for Natural Treatment of Waste Water)।এটি-ই পূর্ব-কলকাতার জলাভূমির পরিচয়।এই জলাভূমি আন্তর্জাতিক হয়ছে জলের পাখি বা গাছপালার জন্য নয়, বরং জলাভূমি কী করে নোংরা জলকে শুদ্ধ ক’রে জীবন ও জীবিকা রক্ষা করে তার জন্য।
তবে রামসার একটা স্বীকৃতি মাত্র।এর কিন্তু কোনও প্রোটেকশন ফ্যাক্টর বা রক্ষা কবচ নেই।যা করার রাজ্য সরকারকেই গাইড লাইন মেন করতে হবে।ফলে একটি ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান বানাতে হবে যা আজও হয়নি।স্বয়ং ডঃ ঘোষও এই কাজে ব্যর্থ হয়েছেন।
যদিও ‘East Kolkata Wetland Authority’ এবং ‘East Kolkata Wetlands (Conservation and Management) Act, 2006’ তৈরি হয়েছে, কিন্তু ডঃ ঘোষকে দেখে যেতে হয়েছে কী করে ধীরেধীরে নোংরা জলের পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে, ট্যানারি আর প্লাস্টিক কারখানার দূষণে ভরিয়ে দেওয়া হচ্ছে এই ভেড়ি, দেখতে হয়েছে স্বয়ং মেয়র বলছেন জলাভৃমির ওপর দিয়ে উড়ালপুল নির্মাণ হবে।২০১৬-তে ডঃ ঘোষ ভুবন-বিখ্যাত ‘লুক হফম্যান’ পুরস্কার পান।অকাল মৃত্যুর কিছু দিন আগেও তিনি পূর্ব কলকাতার জলাভূমি ও তার ভবিষ্যত নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে গেছেন।সব চেয়ে বেদনার একটি লেখায় তিনি নিজেকে ব্যর্থ ইকোলজিষ্ট বলেছেন, যিনি এই অসাধারণ প্রাকৃতিক সৃষ্টিকে পুরোপুরি বাঁচিয়ে যেতে পারছেন না।
কিন্তু এখন এ কথা জানা, ডঃ ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ না থাকলে, তাঁর হার-না-মানা জেদ, নমনীয়তা আর অবাক জলপান না থাকলে এই জলাভূমির এতটুকুও অবশিষ্ট থাকত না।রামসারের টেবিলে তার নথি পৌছানোর আগেই কলকাতার বুক থেকে জলাভূমি চিরতরে হারিয়ে যেত।
আমরা যারা পরিবেশ নিয়ে কাজ করি, জলাভূমি গাছ নদী প্রকৃতিকে বাঁচাতে চাই, তাদের কাছে ডঃ ধ্রুবজ্যোতি ঘোষের কাজ এক মস্ত বড় শিক্ষা।পরিবেশ ও প্রকৃতিকে রক্ষার করার কাজে আমরা যেকোনও কিছু করতে রাজি থাকব, যেকোনও বাজি ধরতে রাজি হব, তবে প্রকৃতির মতোই উদার আর নমনীয়ও হব।এটাই হবে আমাদের রাজনীতি।আমরা ‘কগনিটিভ অ্যাপারথেড’, যা ড: ঘোষ সবচেয়ে অপছন্দ করতেন, সেই জ্ঞানের দম্ভ আর পৃথকীকরণ করব না।আত্তীকরণের অভ্যাস আমাদের মন্ত্র হোক।
0 Comments
Post Comment