পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ঘর

  • 30 January, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1814 view(s)
  • লিখেছেন : শৈলেন সরকার
বারান্দায় গ্রিলের হুক খোলামাত্র শব্দ পায় রীতি। আর তাই জুতোর ফিতে টানতে টানতে দরজার ওপাশে ওর পায়ের শব্দ অনুমান করবে অবিনাশ। অনুমান করবে ওই হালকা আর ছিপছিপে শরীরটি দরজার কাছে এসে দাঁড়াচ্ছে। হাত রাখছে ছিটকিনিতে। আর অবিনাশও এমনকী ফিতে খোলা হয়ে গেলে, একবারও রীতির নাম ধরে না ডেকেই, দরজার ছিটকিনি টানার শব্দ শোনার জন্য অপেক্ষা করবে। আর সময়টা হিসেবের বাইরে গেলে— অবশ্য ও ঘুমিয়ে থাকলেই একমাত্র হতে পারে তা, অবিনাশ বড়জোর ওর নাম ধরে ডেকে উঠবে একবার।

মোট কথা, এর বাইরে কোনও দিনই অন্য কিছু ঘটার কথা থাকে না। আর তাই আজ যেন অবাক হয়েছিল অবিনাশ। আর অবাক হয়ে হিসেবের অতিরিক্ত সময় দাঁড়িয়ে থেকেও, ছিটকিনি খোলার শব্দ না পেয়ে, আজ সে দ্বিতীয় বারের জন্যও ডেকে উঠেছিল। আর এই দ্বিতীয়বার ডাকতে হওয়ার বাড়াবাড়ির জন্য কিছু বিরক্তিও তৈরি হয়েছিল তার, যেন দরজা খোলামাত্র ধমকে উঠবে ওকে, যেন— । আর দ্বিতীয়বার ডেকেও কোনও সাড়া না-পেয়ে, একেবারে সত্যিই উত্তেজিত হল অবিনাশ। আর ওর স্বভাব অনুসারেই বলা যায়, বেশ একটা বড়সড়ো ধাক্কাই মেরে দিল দরজায়। আর সঙ্গে সঙ্গে গলা চড়িয়ে ওর নাম ধরে— । দরজাটা খুলে যাওয়ামাত্র অবাক হল অবিনাশ। কেউ নেই তো! কেউ অর্থে অবশ্য রীতিই। টিভি চলছে। ফ্যান ঘুরছে মাথার উপর।

—রীতি।

একবার ভাবল বাথরুমে, হয়তো দরজা আটকাতে ভুলে গেছে কোনও কারণে। না কি এসেছিল কেউ, হয়তো দরজা খুলে বন্ধ করতে ভুলে গেছে। খাওয়ার টেবিলের উপর দেওয়ালে ঘড়ির কাঁটা নড়ছে। পাশে ফুলদানিতে প্লাস্টিকের ফুল, লতানো গাছ। বিছানার চাদর একটু কোঁচকানো। যেন সবে এইমাত্র ও বিছানা ছেড়ে উঠে গেল কোথাও।

এর পর ডাইনিং টেবিলের পাশ দিয়ে বাঁ-দিকের দরজা পার হয়ে রান্নাঘর, ডান দিকে বাথরুম। না, নেই তো। ঘরে ফিরে টিভি-র সুইচটা টিপে বন্ধ করে দেবে ভেবেও শেষ পর্যন্ত ভুলে গেল অবিনাশ। তবে কি উপরে? বারান্দার বাইরে এসে দোতলার দিকে মাথা উঁচু করে একবার বাড়িউলি বউদিকে ডেকে জানতে চাইবে ভেবেও শেষ মুহূর্তে আটকে গেল অবিনাশ, যদি না হয়! যদি না থেকে থাকে ওখানে! আর রীতির খোঁজ করতে দেখে যদি অন্য কিছু ভেবে বসে? অন্য কিছু মানে, মানে এর পর আর কোথায় যেতে পারে রীতি? বাড়িউলি নিশ্চয়ই দরজায় তালা ছিল কি না জানতে চাইবে, জিজ্ঞেস করবে, তুমি তা হলে ঘরে ঢুকলে কী ভাবে? আর দরজা খোলা রেখে ঘরের বউ-ই বা যাবে কোথায়? এ পাড়ায় অবিনাশদের সবে দু’মাস। আশপাশের বাড়ির কারও সঙ্গে কোনও পরিচিতিই হয়নি এখনও। এমনকী পাশের কোনও বাড়ির কারও সম্বন্ধে অবিনাশ শোনেইনি কিছু রীতির মুখ থেকে। বা, আশপাশের কোনও বাড়ির কাউকে, মানে কোনও বউ বা মেয়েকে রীতির খোঁজ করতেও কোনও দিন দেখেনি। এমনকী বাড়িউলি বউদিকেও না। ভাড়া বরং অবিনাশ নিজেই ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে এসেছে।

কেউ ধাক্কা দিচ্ছে না দরজায়? কে? উঠে গিয়ে দরজাটা খুলতে গিয়েই টের পেল, দরজার ছিটকিনি খোলা। তাড়াহুড়োয় লাগাতে ভুলে গিয়েছিল অবিনাশ। না, কেউ নেই তো। ঘরের বাইরে ছোট একফালি বারান্দা। দরজার নড়তে থাকা পর্দা। পর্দার নকশায় নড়তে থাকা কোনও শরীর, শরীরের যাওয়া-আসা।

ফের ঘরে ঢুকল অবিনাশ। ছিটকিনি টেনে এবার সত্যি-সত্যিই দরজাটা বন্ধ করল। ফের একবার ঘরের ভেতরটা ভাল করে লক্ষ করল সে। খাট, খাটের কোণে দেওয়ালের গায়ে ছোট টেবিলে বসানো টিভি, ডান দিকে আলমারি। আলমারির পাশে জানালা। জানালার পর্দা, পর্দার লাল-হলুদ নকশা। নকশার মজা করে আঁকা খরগোশ, সবুজ আর বেগুনির কিছু পাতা বা লতা। এর পর ডাইনিং টেবিল। ডাইনিং টেবিলের ফুলদানি। প্লাস্টিকের ফুল। আর একবার সব ক'টা ঘর ভাল করে দেখতে চাইল অবিনাশ। রান্নাঘর, ওভেন। ওভেনের সুইচ ঘুরিয়ে গ্যাস খোলা কি বন্ধ, যেন দেখে নিল অবিনাশ। আলোটা জ্বালাল একবার। ওভেনের গায়েই জানালা, জানালার কাচ, বেসিন। বেসিনের কলটা খুলতেই জল গড়িয়ে পড়ল। আর হঠাৎ করে প্যাঁচের অনেকটা ঘুরিয়ে ফেলতেই, জল একেবারে কলের মুখ থেকে ছিটকেই বেরোল। আর জলের শব্দ হওয়ামাত্রই যেন কোথাও রীতিই জেগে উঠল, যেন এই ওর ঠিক পিছনে দাঁড়িয়েই হেসে উঠবে মেয়েটি। যেন এই পিঠে হাত পড়বে। পিছন থেকে জড়িয়ে ধরবে কেউ। পিছন ফিরে তাকাল অবিনাশ। না, কেউ নয়। অবশ্য অবিনাশ কি সত্যিই কাউকে দেখবে বলে আশা করেছিল? কলটা বন্ধ করে অলোটাও নেভাল সে। এর পর বাথরুম। বাথরুমে কমোড, কমোডের ফ্ল্যাশ। ফ্ল্যাশটা একবার টানল সে। আর অমনি অহেতুক ঝরঝর শব্দে জলের স্রোত এসে ভাসিয়ে দিয়ে গেল ফাঁকা বেসিনটাকে। বেসিনটাকে ভাল করে দেখল অবিনাশ। সাদা। প্রায় পুরোটাই। এর পর কমোডের সংলগ্ন ট্যাঙ্কের জল ভর্তি হতে থাকার শব্দ। একবার তাকাল অবিনাশ। কেমন শোঁ-শোঁ শব্দে কোথাও জল ঢুকছে দেখ। কিন্তু অবিনাশ কি ফাঁকা বেসিন দেখতেই এল, না কি দাঁড়িয়ে কোনও গোপনীয়তায় জলের প্লাবনের শব্দই শুনবে? সুতরাং সে পিছিয়ে এল। পিছিয়ে শাওয়ার দেখল। শাওয়ারের ঝারি। সে কি প্যাঁচটা ঘুরিয়ে দেবে? সে কি দেখে নেবে? জল আছে কি নেই জানার খুব কি প্রয়োজন আছে? সে কি স্নান করবে? আর তাই তো করে অবিনাশ। সারাদিন এখানে-ওখানে ঘুরে বাড়ি ফিরে অবিনাশ তো এই শাওয়ারের নীচেই— । প্যাঁচটা ঘোরানো মাত্রই ছিটকে পিছনে সরে এল অবিনাশ। সে তো জামা-প্যান্ট খোলেইনি এখনও। বাথরুমের বাইরে বেরিয়ে সে টের পেল, সন্ধে হয়ে আসছে। জানালা দিয়ে আলো ঢুকছে রাস্তার। দেওয়ালে এখানে-ওখানে হালকা হলুদ। পকেট থেকে একবার ফোনটা বের করল অবিনাশ। নম্বরে অঙুল রাখল। কিন্তু কাকে ফোন করবে সে? কোথায়? সে কি অপেক্ষা করবে? হয়তো কোথাও যায়নি রীতি। হয়তো কাছেই কোনও দোকান কিংবা বাজারে। হয়তো অবিনাশের জন্য কিছু কিনবে বলেই, বা সংসারের জন্যই। হয়তো চা ফুরিয়ে গেছে বা চিনি। হয়তো সাধারণ কিছুই। ফিরবে এক্ষুনি। দরজাটা বন্ধ করে যেতে জাস্ট— । বাইরে একটা শব্দ হল না? কে যেন হাঁটতে হাঁটতে থেমে গেল। বারান্দার গ্রিলে হাত দিল না কেউ? উঠে দাঁড়াল অবিনাশ, ছিটকিনিতে হাত রেখে তাকাল একবার ঘরের দিকে, টিভিতে নাচছে কে যেন। ঠোঁটে রং, ঘাঘরা চোলি। না, কেউ নেই তো। তবে কি কোনও অ্যাক্সিডেন্ট? ওকে কি কেউ ঘর থেকে। মানে, বাইরে থেকে দরজায় নক করল কেউ? দরজা খুলতে বলল, এর পর— । কিন্তু চিহ্ন থাকবে না কোথাও ? অন্তত কোনও ধ্বস্তাধ্বস্তি। আর চিৎকার তো থাকতই। তবে কি চেনা কেউ? পুলিশে খবর দেবে অবিনাশ? আর পাঁচটা দিন হলে এ সময় টিভির সামনে বসে থাকত সে। বা বের হত রীতিকে নিয়ে, ছোটখাটো কিছু কেনাকাটা, বা অবিনাশ একাই, বড়জোর কিছু কিনতে হবে কি না জিজ্ঞেস করে— ।

টিভিটা বন্ধ করতেই একেবারে একা হয়ে গেল অবিনাশ। আর এই প্রথম টের পেল, সারাদিন কিছু খায়নি সে, স্নান হয়নি, বরাবরের অভ্যাসগুলির সব ক'টাই কেমন ভুলে মেরে দিয়েছিল সে। আর অভ্যাসের কথা মনে পড়তেই রীতির অভ্যাসগুলির কথা মনে পড়ল ফের। ওর ঘুম, ঘুমের মধ্যে কথা বলা, ছিটকিনি খুলতে ওর তাড়াহুড়ো, এর পর ‘দেরি করলে কেন এত’ বলা। আর রীতির এই সব অভ্যাসের স্মৃতি তাকে এক অদ্ভুত কথা মনে পড়াল, ছিটকিনি খুলে যদি তাকে দেখতে না পেত রীতি, তা হলে কেমন হত। মানে, বাইরে পায়ের আওয়াজ শুনে অবিনাশ এসেছে ভেবে— আর ও তো পায়ের আওয়াজ শুনে অবিনাশের বলে চিনতে পারার কথা বলতই— এর পর যদি না দেখতে পেত অবিনাশকে? ভাবতেই মজা পেল অবিনাশ, বেচারি হয়তো ‘ভুল হয়েছে’ ভাবত, হয়তো হয়েছেও এমন ভুল, হয়তো অন্য কেউ— । অন্য কেউ কেন? কে আসবে এখানে? এখানে ওর থাকার কথা কে জানে অবিনাশ ছাড়া? শুধু অবিনাশই যদি বলে থাকে কাউকে, আর কেনই বা বলবে সে? আর রীতি তো স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়ে এই অবিনাশের জন্য মাত্র মাস দুয়েক হল এখানে। তবু, যদি হতও এমন, বারবার দরজা খুলে কাউকে না দেখতে পেয়ে একসময় হতাশ রীতি হয়তো দরজা খুলেই দাঁড়িয়ে থাকত। আর অবিনাশই বা তখন থাকত কোথায়? কিন্তু থানায় যাওয়াটা কি ভাল হবে? হয়তো জানতে চাইবে, ছিলেন কোথায় আগে, বা মেয়েটির বাড়ি কোথায়? ক’দিন হল বিয়ে হয়েছে? না কি খবর দেবে রীতিদের বাড়িতেই? কিন্তু ও-বাড়িতে কেন যাবে রীতি? যাবেই বা কী ভাবে? আর গেলেও একবার অন্তত বলে নেবে না অবিনাশকে? জামা খুলল অবিনাশ। গেঞ্জি, শর্টস। একেবারে ন্যাংটো হয়েই বিছানায় বসল। উল্টোদিকে আয়নায় দেখল নিজেকে। কেমন অন্য একজন লোক না? অবিনাশ ভাল করে খুঁটিয়ে দেখল লোকটাকে। লোকটার চোখ, নাক, ভাঙা চোয়াল। গলা, বুক, পেট। নাভি, তলপেট। ফের তাকাল আয়নার দিকে। এই লোকটাকে কোনও দিন কি দেখেছে রীতি? একটা কুচকুচে ছোট চোখওয়ালা, ধূর্ত ও ক্রিমিনালও হতে পারে। হয়তো বউকে মার্ডার করে— । হতেও তো পারে। থানায় যাওয়ামাত্রই বা, রীতিদের বাড়িতেই খবর পাওয়ামাত্র— । আর যদি সত্যি-সত্যিই কিছু— । না, কিছু না, কেনই বা অজেবাজে ভাবছে সে। আর একবার আয়নায় চোখ রাখল অবিনাশ। আবার সেই লোক, ধূর্ত, কুচকুচে চোখের ক্রিমিনাল একটা। এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল সে, অলোটা বন্ধ করল। অন্ধকার। এখন শুধুই অবিনাশের মন। আর কিছু না। কোথাও কেউই নেই আর। এখন শুধুই অবিনাশ। আন্দাজে বাথরুমের দরজাটা পেয়ে গেল সে। বাথরুম, টাওয়াল, শাওয়ার এবং কমোড। কমোডে বসে চোখ বন্ধ করল অবিনাশ। ফের সেই অন্ধকার। ফের সেই থানার কথাই ভাবল সে। অফিসারকে সে যদি বলে, যদি বলে, কেউ এসে হয়তো ওকে— । হতেও তো পারে। বাড়ি ফেরার মেয়ে নয় রীতি। অবিনাশকে বা বলতে গেলে একেবারে অচেনা একটি ছেলেকে কী ভাবে এত ভালবেসে ফেলল মেয়েটি! ভাবো, আর ভালবেসে নিজের বাবা-মাকে পর্যন্ত— । অবিনাশ কি পারত? ও কি একটা মেয়ের জন্য— | অবিনাশ বুঝতে পারে, কমোডে বসার দরকার নেই আর। উঠে দাঁড়িয়ে ফ্ল্যাশ টেনে সাবান হাতে নেয় সে। আর এই অন্ধকারেই রীতির নিজের পছন্দে কেনা সাবানের ঘ্রাণ টের পায় অবিনাশ। আর এই ঘ্রাণে ঘ্রাণেই কেমন চলে আসে দেখো মেয়েটি। আর বাথরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে ‘কী হল’ বলে কেমন ডেকে ওঠে।

স্নান সেরে অন্ধকারেই লুঙ্গিটা হাতড়ে বের করে অবিনাশ এবং আলো জ্বালে। এই এতক্ষণে খিদেটা যেন জানান দিতে শুরু করল নিজেকে। আর ফের সেই মেয়েটি কেমন হাজির হল দেখো। রান্নাঘরে ভাত, মাছ, তরকারি যেমন যেখানে থাকার, ঠিকই পেয়ে গেল অবিনাশ। শুধু রীতিকেই— ।

অফিসার অবশ্য বিশ্বাস করবে কি না কে জানে! কিন্তু বিশ্বাস করার মতো কী আছে অবিনাশের মধ্যে? রীতিকে একদিন জিজ্ঞেসও করেছিল অবিনাশ, আমাকে কী দেখে তুমি, আমার সম্বন্ধে কতটুকু— । ভাত মাখতে মাখতেই যেন মেয়েটির আঙুলের স্পর্শ পেল অবিনাশ। ফের। ফের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। সত্যি। ফের আয়নার দিকে তাকাল সে। সেই লোকটাই। তফাতের মধ্যে নগ্নতার পরিবর্তে পোশাক। মুখের হাঁ-এর ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে পড়া দাঁত। যেন লালা ঝরছে ঠোট বেয়ে। ঠেলে বেরিয়ে অসতে থাকা চোখ। রীতিদের বাড়িতে খোঁজ করে, না পেয়ে পুলিশ জানতে চাইতে পারে, লিখে গেছে কিছু? খুঁজে দেখেছেন? খুঁজে অবশ্য দেখেনি অবিনাশ। তবু, না-ই করতে হবে তাকে। কিছু লিখে যায়নি নিশ্চয়ই মেয়েটি? অফিসার হয়তো বলবে কিছু মানে, সুইসাইড নোট? হতেও তো পারে, হয়তো ঝগড়া করলেন বছরভর, বা অশান্তি বা টর্চার করলেন দিনের পর দিন। ঠিক এখানে এসেই আইনের কথা মনে পড়ল অবিনাশের, কী যেন আছে আইনে? বিয়ের ক’বছরের মধ্যে স্ত্রীর অ্যাক্সিডেন্টাল ডেথ হলে স্বামীকে— । সেক্ষেত্রে অবিনাশকেই— । না না, অবিনাশ খুন করলে সে নিজেই বা যেচে পুলিশকে বলতে যাবে কেন? সে তো কাউকে কিছু না জানিয়ে এমনিই চলে যেতে পারত। কে-ই বা চেনে তাকে? এমনকী রীতির মা-বাবাও নয়। বাড়িওয়ালা বা এ পাড়ার কেউ তো নয়ই। তবে? কাকে ভয় অবিনাশের? সে তো অনায়াসেই— । ফের টিভি চালাল অবিনাশ। খবর। কোনও এক লোক বক্তৃতা দিচ্ছে জনসভায়। ভিড় উপচে পড়ছে। চিৎকার করছে লোকটা। যেন ধমকাচ্ছে। কাকে ধমকাচ্ছে রে বাবা। চোখ দুটো একেবারে ফেটে বেরোচ্ছে দেখো। দেখতে না দেখতেই বিজ্ঞাপন। একটি মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। না, যেন উড়েই যাচ্ছে হালকা হাওয়ায়, উড়ছে ওর ওড়না, গাছ থেকে ঝরে পড়ছে পাতা। মেয়েটি সাবান মাখছে বা যেন আলতো করে ছোঁয়াচ্ছে নিজের ত্বকে। খালি পিঠ, কাঁধ, মেয়েটির নগ্ন পা। আহ। কেমন উত্তেজিত হয়ে উঠল দেখো অবিনাশ। নগ্ন পায়ের এত উত্তেজনা থাকে? দেখতে না দেখতেই চারটে শিশু হেঁটে যাচ্ছে, ওদের পায়ে আছড়ে পড়ছে সমুদ্রের ঢেউ, বেলাভূমি। এর পর? অবিনাশ রিমোট টিপল। রীতি বিরক্ত হত খুব। ও হয়তো সিরিয়াল দেখবে কোনও, অমনি অবিনাশ— । হয়তো খবর বা গান— । রীতিকে খ্যাপাবার জন্যই, আর এ ভাবেই কখন যেন রীতি আবার— ।

রিং হল একটা। টেবিলের ওপর থেকে ফোনটা তুলল অবিনাশ। নম্বরটা দেখল। ফের। হয়েই যাচ্ছে। ওদিকে অধৈর্য কেউ। ফোনটা কি ধরবে অবিনাশ? ধরে কী শুনবে বলে ভাবছে সে? হাতটা কাঁপতে থাকে, অবশ হয়ে আসে শরীরটা। সে বরং পুলিশের কাছেই যাবে। বলবে, বিকেলে বাড়ি ফিরে দেখি। দেখি মানে, এমনিতে পায়ের আওয়াজ পেলেই ছিটকিনিতে হাত দিত মেয়েটি, বড়জোর বাইরে থেকে ওর নাম ধরে একটিবার ডেকে ওঠা, বড়জোর এর পর আলতো করে টোকা মারা। অবিনাশ বলবে, আলতো টোকাতেই দেখি দরজা খোলা। একেবারে হা-হা করা— টিভি চলছে, ফ্যান, ডাইনিং টেবিলে প্লাস্টিকের ফুলদানি, বিছানার চাদরেও ভাঁজ নেই কোনও, এমনকী খাওয়ার ভাত, তরকারি, মাছ। শুধু মেয়েটিই উধাও। অফিসার হয়তো বলবে, বলেন কী, অচেনা কেউ নিয়ে গেলে চিৎকার হবে না কোনও? বা আপনি নিজেই— । যদি নিজের থেকে না গিয়ে থাকে, তবে আপনার নাম করেই আপনার বা ওর বিশ্বাসী কেউ, কী বলেন? অফিসার হয়তো ওকেই সন্দেহ করে বসবে। আলমারি খুলল অবিনাশ। রীতির শাড়ি, ব্লাউজ, হুকে ঝোলানো ব্রা, শর্টস। শাড়িগুলো নামাল অবিনাশ। ব্লাউজ, ব্রা, শর্টস। ঘ্রাণ নিল। রীতি আছে এখনও। সব কিছুতেই ওর ঘ্রাণ স্পষ্ট লেগে আছে। নীচের তাকে ওর সাজার জিনিস। সামান্যই। তবু টেনে নামাল অবিনাশ। বলতো, সময় হলে হবে সব। বলতো, আগে তো ঘর বাঁধা। মেয়েটি কথা বলতে পারত। অবিনাশের কানের পাশে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে এমন সব কথা, এত সুন্দর সব কথা, এখনও মনে করতে পারে অবিনাশ। এত সব সুন্দর কথা যে থাকতে পারে পৃথিবীতে, তা জানতই না সে। আর এই সব কিছুই কিন্তু বলতে পারবে অবিনাশ, বলতে পারবে আমরা কিন্তু দুজন দুজনকেই— । সেই অফিসার তবু কি অবিশ্বাস করবে?

পাড়ার লোক ভাববে, অবিনাশ নিশ্চয়ই নিজের বউকে মেরে, হয়তো কোথাও কোনও অ্যাক্সিডেন্টের ছল-ছুতো করে— । কিন্তু তা-ই যদি হবে, তবে ফিরবে কেন সে? কেন? সে তো তার ভালবাসার ঘরেই ফিরছে, যেখানে ওর পায়ের আওয়াজ শুনে, ওর ছোট ডাক শুনে দরজা খুলে দেবে মেয়েটি, যেখানে সারাদিনের শেষে অবিনাশ খাবে বলে ভাত বেড়ে রেখেছে সে, অবিনাশ তা দেখাতেও পারবে, তবে? তবু, তবু লোকগুলি তো ওকে পুলিশের হাতেই তুলে দেবে। আর লোকগুলি তুলে না দিলেও অবিনাশ নিজে যাবে। বলবে, বিশ্বাস করুন, কিছু একটা করুন। প্লিজ, ও আমাকে— । আমি এই ছোট্ট ঘরটা, এই ভাড়া করা খাট, আলমারি, টিভি— শুধু বেঁচে থাকার জন্যই।

এ সব থানার অফিসাররা, অবিনাশ জানে, ঘুঘু খুব। অবিনাশকে দেখেই হয়তো বলে বসবে, চেনা মুখ মনে হচ্ছে খুব। তুমি বেলেঘাটার চন্দন না? বা সোনারপুরের ইকবালের সঙ্গে কারবার করতে না তুমি, বা— । হয়তো এ সবই অনুমানের, হয়তো শুধুমাত্রই অন্ধকারে ঢিল ছুড়ে মারা, তবু— । অবিনাশ তখন বলতে পারবে, তা হলে বিয়ে করতে যাব কেন বলুন? বা, এতগুলি দিন একসঙ্গে ঘর করা, ঘর ভাড়া করা, খাট, আলমারি, টিভি। অবিনাশ রীতির শাড়িগুলি দেখাবে। ওর শাড়ি, ব্লাউজ, ব্রা। ঘ্রাণ নিতে বলবে, বলবে শুঁকে দেখুন, ওখানে কিন্তু ভালবাসাই। ওকে না ভালবাসলে— । অফিসার হয়তো বলবে, এটা হয় কখনও কখনও। কখনও হঠাৎ তোমাদের মতো কেউ ভালই বেসে ফেলল একটি মেয়েকে, এমনকী সিনেমাতেও— ।

কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল অবিনাশ। বা আদৌ ঘুমিয়েছিল কি না, কে জানে? আচমকাই ধড়মড় করে উঠে পড়ল সে। বাইরে চলে যেতে থাকা কোনও সাইকেলের ঘণ্টা কানে আসল। হয়তো খবর কাগজের। দূরে হর্ন পড়ল কোথাও। কোনও ট্রেন। ট্রেনই। স্টেশনে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে এই এতক্ষণে যেন হুঁশ ফিরল।

আলমারি থেকে নামিয়ে রাখা শাড়ি, ব্লাউজ বা রীতির ব্রা বা শর্টস ফের আলমারিতেই তুলে রাখল সে। একেবারে যেমন ছিল, ঠিক তেমনি করেই। যেন না ধরতে পারে মেয়েটি। ওর সাজার জিনিস, এমনকী চলতে থাকা টিভি-টাও চালু করল। একেবারে আগের সেই চলতে থাকা চ্যানেল। জামাটা পরে নিল। এর পর শর্টস, প্যান্ট। এর পর কাকে উদ্দেশ্য করে কে যেন বলে উঠল— আমার দেরি হতে পারে কিন্তু একটু। এর পর দরজার ছিটকিনি খুলে বাইরে পা দিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দেওয়ার কথাও বলল। এর পর রোজকার মতো ‘আমি ফোন করে না জানালে কারও সঙ্গে যাবে না কিন্তু কোথাও— ।’ এর পর জুতোর ফিতে, গ্রিলের হুক।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে আর একবার ঘরটাকে দেখল অবিনাশ। দরজাটা নড়ে উঠল না একটু। কেউ কি আছে? থাকবেই, ঘর থেকে টিভির আওয়াজ, কেউ নির্ঘাত শুয়ে-বসে কোনও সিরিয়াল বা গান, এমনকী বাইরে থেকে রীতি বা এমনকী অবিনাশ বলে ডাকলেও হয়তো ঘরের মধ্যে থাকা কারও কানে যাওয়ার কথা নয়। গলি থেকে বড় রাস্তায় পা দিয়ে ফের তাকাল অবিনাশ। কেউ থাকতেও তো পারে, হয় রীতি বা অবিনাশ। বা দু’জনেই। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আলতো টোকা দেওয়ার পর সাড়া না পেলে একমাত্র তখনই নাম ধরে ডাকতে হবে তোমাকে। আর তবুও দরজা কেউ না খুললে, হালকা ধাক্কা দেবে তুমি। আর হালকা সেই ধাক্কায় দরজা খুলে যাওয়ার পর খোলা দরজার ওপাশে ঘরের ভিতর ডেকে-ডেকেও কাউকে না পেয়ে অবাক তুমি নিশ্চয়ই ভাববে তাহলে বাইরে গেছে কোথাও, ফিরবে এক্ষুনি। ওদের যে-কোনও একজনের ঘরে ফেরার জন্য অপেক্ষা তোমাকে করতেই হবে।

0 Comments

Post Comment