মার্কিন দখলদারদের দেশছাড়া করে আফগানিস্তানের যারা দখল নিয়েছে তারা সেই বিশ বছর আগের খারাপ তালেবান নয়— আমাদের পরিচিত মানুষজন অনেকেই বলছেন এ কথা। দুই দশক পেরিয়ে তারা এখন সংশোধিত পরিশীলিত ভাল তালেবান। কাবুলে বসে তালেবানরাও সেই প্রচারটাই করে চলেছে। বিনাযুদ্ধে প্রেসিডেন্টের প্রাসাদের দখল নেওয়ার দশ দিন পরেও একটা সরকার গঠন করতে পারেনি তালেবান। গোটা দেশজুড়ে চলছে নৈরাজ্য, অনিশ্চয়তা, মারদাঙ্গা, খুন আর লুটপাট। আইনের শাসন বলে সে দেশে এখন কিছুই নেই।
তালেবান একটা অতীতমুখী ইসলামি সংগঠন। আরবি তালেব হল ছাত্র। আর তালেবান-এর অর্থ ছাত্রদল। পাকিস্তানের মাদ্রাসায় আফগান শরনার্থী ছাত্রদের অস্ত্রশিক্ষা দিয়ে তালেবান আন্দোলন গড়ে তোলা হয়। তারা ইসলাম আর অস্ত্রের বাইরে খুব একটা কিছু বোঝে না। পাকিস্তানে সেনা প্রশিক্ষণের মধ্যে বেড়ে ওঠার ফলে তরুণ তালেবান যোদ্ধাদের অধিকাংশই আফগানিস্তানের প্রধান ভাষা পুস্তু বা কাবুলের প্রধান ভাষা ফারসি বলতে বা বুঝতে পারে না। তাতে ওদের অসুবিধে নেই, কারণ তালেবান যোদ্ধারা সাধারণত কথা বলে অস্ত্রের ভাষায়। সোভিয়েত আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আমেরিকা ও পাকিস্তানের আর্থিক ও সামরিক সহায়তায় তালেবান বাহিনীর বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়েছিল ১৯৯৪ সালে। তারা আফগানিস্তান শাসন করেছে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত। আমেরিকায় টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পরে আল কায়দার নেতা ওসামা বিন লাদেনকে খোঁজার নামে ২০০১ সালে মার্কিন সেনা বাহিনী আফগানিস্তান দখল করে একটা পুতুল সরকার বসিয়ে দেয়।
আবারও আফগানিস্তানে ক্ষমতায় ফিরেছে তালেবান আমেরিকার সঙ্গে একটা আপসরফা করে। এখন তারা নাকি আর আগের মতো খারাপ নেই— তারা এখন ভাল তালেবান। ওই পাঁচ বছরে তালেবান শাসন কেমন ছিল সেটা একবার দেখে নিলে আমরা হয়তো আন্দাজ করতে পারব কতটুকু বদলানো সম্ভব ধর্মাশ্রয়ী ওই কট্টর যুদ্ধবাজদের পক্ষে। তালেবানরা আফগানিস্তানকে বিশ্বের বিশুদ্ধতম ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে গড় তুলতে চেয়েছিল। রাষ্ট্রের সর্বস্তরে ইসলামকে বিশুদ্ধভাবে প্রয়োগ করতে তারা দেশের সিনেমা, টেলিভিশন এবং সব রকমের সঙ্গীত নিষিদ্ধ করেছিল। ইসলামে সুদ নিষিদ্ধ বিধায় দেশের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা ভেঙে দেয়। অপরাধের শাস্তি হিসেবে শরিয়ত (ইসলামি আইন) মেনে প্রকাশ্যে হাত কেটে দেওয়া, চাবুক মারা বা গুলি করে হত্যার নীতি চালু করে। মেয়েদের স্কুল কলেজে যাওয়া এবং বাইরের যাবতীয় কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যায়। ষষ্ঠ শতকে বামিয়ান পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা ১২৫ থেকে ১৭৪ ফুট উঁচু বুদ্ধমূর্তিগুলো কামান দেগে গুঁড়িয়ে দেয়। তদানীন্তন তালেবান প্রধান মোল্লা ওমর ২০০১-এর মার্চে এক সরকারি ফরমান জারি করে, কাবুল সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত মূর্তিগুলো সমেত দেশে যত মূর্তি আছে ধ্বংস করো। কারণ মানুষের প্রতিরূপ তৈরি ইসলাম বিরুদ্ধ। তালেবান ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে, মেয়েদের স্বাধীনতা দেওয়া হবে শরিয়ত মেনে। আগের শাসনামলেও তালেবান মেয়েদের ঘরবন্দী করেছিল শরিয়ত মেনেই। মধ্যযুগের শরিয়তি অনুশাসনের বাইরে তারা একটি পা ফেলে না।
তালেবান নিছক কোনও সামরিক বা রাজনৈতিক শক্তি নয়, তালেবান একটা মৌলবাদী তত্ত্বও বটে। সামরিক অভিযান দিয়ে তাকে সাময়িক উৎখাত করা গেলেও মূলোচ্ছেদ করা যায়নি। তাই ২০০১-এ পরাজয়ের পাঁচ বছরের মধ্যে তারা আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রান্তে মাথা চাড়া দেয়। কিন্তু কীভাবে তারা বিশ বছর ধরে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে এবং শক্তি বৃদ্ধি করেছে? পাকিস্তান, চিন বা রাশিয়ার আর্থিক ও সামরিক সহায়তা অবশ্যই ছিল, কিন্তু তালেবানের উপার্জনের সবচেয়ে বড় উৎস ছিল পপি চাষ এবং তা থেকে তৈরি আফিম ও নানা প্রকার মাদক পাচার।
জাতিসংঘের ২০১৭-র তথ্য অনুযায়ী, আফগানিস্তানে গত চার বছরে গড়ে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে পপি চাষ হয়েছে। দেশটির ৩৪টি প্রদেশের ১২টি ছাড়া সব কটিতে আফিম চাষ হয়। বিশ্বের প্রায় ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ আফিম আফগানিস্তনে তৈরি হয়। পশ্চিমী দেশগুলোর পাশাপাশি রাশিয়া, ইরান, পাকিস্তান ও চীন মাদক পাচারের গুরুত্বপূর্ণ রুট এবং আফগান মাদকের বিশাল বাজার। ২০০২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত— পনেরো বছরে মাদক বাণিজ্যের বিরুদ্ধ লড়াইয়ে আমেরিকা ৮৬০ কোটি ডলার খরচ করেছে। কিন্তু পপি চাষ এবং মাদক উৎপাদন বন্ধ করতে দেশের যে প্রত্যন্ত অঞ্চলে মার্কিন সেনাকে হানা দিতে হত সেখানে পৌঁছনোর ক্ষমতা তাদের ছিল না, সেখানে ছিল তালেবানের একাধিপত্য।
কিন্তু গত দুই দশকে তালিবানের শরিয়তি শাসনের দুঃস্বপ্ন মুছে ফেলে জন্ম নিচ্ছিল এক নতুন আফগানিস্তান। সেখানে আর পাঁচটা উন্নয়নশীন দেশের মতোই শিক্ষায় সংস্কৃতিতে খেলাধুলোয় আফগানরা নিজেদের প্রমাণ করছে বিশ্বের কাছে। সেখানে পপ গায়ক, চিত্রশিল্পী, ফ্যাসন ডিজাইনার, মহিলা ফুটবল দল, মহিলা চলচিত্র পরিচালক, মহিলা অ্যাথলিট, চিকিৎসক, স্থপতি, ইঞ্জিনিয়ার এমনকী সমাজে তাদের হিস্যাটুকু বুঝে নিতে সমকামী বা ট্রান্সজেনডার সংগঠন গড়ে উঠেছে। চাষ-আবাদে, রফতানিতে, বহির্বাণিজ্যে আফগানরা পিছিয়ে নেই। আজ এতসব অর্জন আর অগ্রযাত্রা থমকে যাবে না তো তালেবানের শরিয়তি শাসনে? নাকি তারা এখন ভাল তালেবান। আফগান জাতীয় পতাকা বর্জন করেছে আল কায়দা, আইসিস বা অন্যান্য ইসলামি জঙ্গি সংগঠনগুলোর মতো কলেমা সংবলিত তালেবানি পতাকা নিয়ে এসেছে তারা।
তালেবানের শরিয়তি অনুশাসন আসলে একটা বিশাল ধাপ্পা। অন্য সব ধর্মে যেমন মিথ্যাচার আর তঞ্চকতা থাকে ইসলামও তার ব্যতিক্রম নয়। কেবল তালেবান নয়, বিশ্বের সব মুসলমানেরই শরিয়ত মেনে জীবনযাপন করার কথা। বলা হয়ে থাকে ইসলাম হল সম্পূর্ণ জীবন-বিধান। শরিয়ত তার পথ নির্দেশক। তালেবানও কিন্তু সেই কথাই বলে। এখন বিশ্ব আর্থিক কাঠামো যেভাবে চলে সেখানে শরিয়তে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ সুদভিত্তিক ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে এড়িয়ে জীবনযাপন প্রায় অসম্ভব। মানুষ তার সুবিধা মতো ধর্মকে একটু বাঁকিয়ে চুরিয়ে সহজ ব্যবহারযোগ্য করে নেয়। তালেবানও তার ব্যতিক্রম নয়। আফগানদের ধর্মের নামে ভয় দেখিয়ে মধ্যযুগীয় শাসন কায়েম রাখতে, নিজেদের বিশুদ্ধ ইসলামি ভাবমূর্তি বজায় রাখতে শরিয়তকে তারা তাদের মতো ব্যবহার করেছে এবং করবে। সৌদি আরবে মেয়েদের ভোটাধিকার ছিল না কিংবা পুরুষ সঙ্গী ছাড়া বাইরে বেরনো নিষেধ ছিল শরিয়ত মোতাবেক। আবার সেই বিধিনিষেধ প্রত্যাহার হয়েছে শরিয়তকে মান্যতা দিয়েই।
আমাদের দেশের প্রায় সমস্ত সংবাদমাধ্যম আমেরিকা এবং ন্যাটো সেনাদের প্রত্যাবর্তণের শোকে কেঁদে ভাসাচ্ছে। আবার কেউ কেউ অতিশক্তিধর সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধবাজ আমেরিকার আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার সঙ্গে ভিয়েতনামে কমিউনিস্ট গেরিলা যোদ্ধাদের কাছে পরাজিত হয়ে আমেরিকার সাইগন থেকে পালানোর তুলনা করছেন। সেটা করতে গিয়ে তালেবানকে মুক্তিযোদ্ধাও বলা হচ্ছে। তাঁদের অনেকে আবার নানা কিসিমের বাম রাজনীতির কর্মী সমর্থক। তেমনই কেউ আবার মুসলিম জাহানে আরও একটা ইসলামি আমিরশাহী গড়ে উঠছে বলে বেজায় পুলকিত উৎফুল্ল।
ইসলামি মৌলবাদীদের শরিয়তি শাসনের আকাঙ্ক্ষা আর আরএসএস-এর মনুবাদী রাষ্ট্র নির্মাণের ধারনায় কি খুব একটা ফারাক আছে? না, নেই। কারণ শরিয়তের মতোই মনুসংহিতাকেও অনেকে সম্পূর্ণ জীবন-বিধান মনে করে। আরএসএস এবং তার রাজনৈতিক মুখ বিজেপি দেশকে ঠেলতে ঠেলতে মনুবাদী শাসনের দিকে নিয়ে চলেছে। আমেরিকা তথা পশ্চিমী মহাশক্তির পরাজয় আর আফগানিস্তানে তালিবানের প্রত্যাবর্তন নিয়ে দেশ জোড়া তুমুল হট্টগোলের মধ্যে আমাদের ঘরের বিপদটা যেন ভুলে না যাই।