আমি তখন স্কুল-ছাত্র, আমার এক আত্মীয় আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম জানিস?’
বলেছিলাম, ‘জানি।’
বল তো, ‘কে?’
‘একজন পুরো দস্তুর সাহিত্যিক।’
আত্মীয় জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘পুরো দস্তুর ব্যাপারটা আবার কী?’
বলেছিলাম, ‘পুরো দস্তুর মানে সাহিত্যের এমন কোনও শাখা নেই যেখানে তাঁর উপস্থিতি নেই।’
আত্মীয় খুব অবাক হয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘একটু ব্যাখ্যা করবি।’
ব্যাখ্যা করেছিলাম। ‘ছোট খোকা বলে অ আ / শেখেনি সে কথা কওয়া’ থেকে শুরু করে ‘অমল’ ও ‘দইওয়ালা’, ‘কাবুলিওয়ালা’র কষ্টের পাশাপাশি ‘রতন’-এর কষ্ট। গান তো ছিলই, রাত করে বাড়ি ফেরার জন্য আমাকে রোজ রাত্রে গাইতে হত, ‘খোল খোল দ্বার রাখিও না আর বাহিরে আমায় দাঁড়ায়ে ...’। উপন্যাসের কথা জানতাম। তখনও পড়া হয়নি। তবে তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’ পড়েছিলাম। বাড়ি ভর্তি মানুষের মধ্যে একজন শিশু কত অসহায়! অনুভব করেছিলাম।
জীবনের এমন কোনও অনুভব নেই যা রবীন্দ্রনাথকে ছুঁয়ে যায়নি। সেটা তাঁর কবিতায় হোক কিংবা গানে, ছোটগল্পে হোক কিংবা উপন্যাসে, নাটকে হোক কিংবা প্রবন্ধে ব্যক্ত হয়নি। তাঁর সেই অনুভব কোথাও আরোপিত মনে হয় না। আর আরোপিত মনে হয় না বলেই সেই স্কুল-জীবন থেকে আজ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথেই আস্থা রাখি। এমন কোনও দিন নেই যেদিন রবীন্দ্রনাথ আমাকে ভরসা জোগায় না। মানবতাবোধে উজ্জীবিত করে না।
সেই কারণেই হয়ত কোনও এক রবীন্দ্র-জয়ন্তীতে লিখেছিলাম এই কবিতাটিঃ
জন্মদিনে রবীন্দ্রনাথকে
মিনির জন্য আজ পিতা রহমতের মন খুব কাঁদছে।
দেশের অবস্থা দেখে নিখিলেশের চোখে ঘুম নেই,
বন্ধু সন্দীপ স্বাদেশীকতার নামে যা খুশি তাই করে বেড়াচ্ছে।
গোরা চাইছে প্রতিটি নাগরিকের মধ্যে জাতীয়তা বোধ জাগিয়ে তুলতে।
নন্দিনী চাইছে যক্ষপুরীতে যন্ত্রবদ্ধ মানুষ যাতে মুক্তি পায় -
সে যক্ষপুরীর রাজাই হোক কিংবা প্রজা!
রতন অভিমান করে বসে আছে তার মনিব পোস্টমাস্টার ঘরের ছেলে ঘরে চলে যাবে বলে।
এদিকে অমল খুবই অসুস্থ, সে ঘরবন্দি হয়ে মুক্তির পথ খুঁজছে।
আজও কোনও কিছু বদলায় নি রবীন্দ্রনাথ, সব যেমনকার তেমনিই আছে ...
এই প্রসঙ্গে সৈয়দ মুজতবা আলী বর্ণিত ভাণ্ডারের গল্পটি স্মরণ করি -
“ আশ্রমে মারাঠী ছেলে ভাণ্ডারের উদয়।
ইস্কুলের মধ্য বিভাগে বীথিকা-ঘরে ভাণ্ডারে সীট পেল। এ ঘরটি এখন আর নেই তবে ভিতটি স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। তারই সমুখ দিয়ে গেছে শালবীথি। তারই এক প্রান্তে লাইব্রেরি, অন্য প্রান্তে দেহলী।
দেহলী থেকে বেরিয়ে, শালবীথি হয়ে গুরুদেব চলেছেন লাইব্রেরীর দিকে পরনে লম্বা জোব্বা, মাথায় কালো টুপি। ভাণ্ডারে দেখামাত্রই ছুটলো তাঁর দিকে। আর সব ছেলেরা অবাক। ছোকরা আশ্রমে এসেছে দশ মিনিট হয় কি না হয়। এর মধ্যে কাউকে কিছু ভালো-মন্দ না শুধিয়ে ছুটলো গুরুদেবের দিকে!
আড়াল থেকে সবাই দেখলে ভাণ্ডারে গুরুদেবকে কি যেন একটা বললে। গুরুদেব মৃদু হাস্য করলেন। মনে হল যেন অল্প অল্প আপত্তি জানাচ্ছেন। ভাণ্ডারে চাপ দিচ্ছে। শেষটায় ভাণ্ডারে গুরুদেবের হাতে কি একটা গুঁজে দিলে। গুরুদেব আবার মৃদু-হাস্য করে জোব্বার নিচে হাত চালিয়ে ভিতরের জেবে সেটি রেখে দিলেন। ভাণ্ডারে এক গাল হেসে ডরমিটরিতে ফিরে এল। প্রণাম না, নমস্কার পর্যন্ত না।
সবাই শুধালে, ‘গুরুদেবকে কি দিলি?’
ভাণ্ডারে তার মারাঠী-হিন্দীতে বললে, ‘গুরুদেব কৌন্? ওহ্ তো দরবেশ হৈ।’
‘বলিস কি রে, ও তো গুরুদেব হায়!’
‘ক্যা “গুরুদেব” “গুরুদেব” করতা হৈ। হম্ উসকো এক অঠন্নী দিয়া।’
বলে কি? মাথা খারাপ না বদ্ধ পাগল? গুরুদেবকে আধুলি দিয়েছে!
জিজ্ঞেসাবাদ করে জানা গেল, দেশ ছাড়ার সময় ভাণ্ডারের ঠাকুমা তাকে নাকি উপদেশ দিয়েছেন, সন্ন্যাসী দরবেশকে দানদক্ষিণা করতে। ভাণ্ডারে তাঁরই কথামতো দরবেশকে একটি আধুলি দিয়েছে।”
দুঃখের বিষয় দিন দিন ওই ছাত্র ভাণ্ডারের মতো আমরাও রবীন্দ্রনাথকে সন্ন্যাসী দরবেশ বানিয়ে ফেলছি। শুধু ২৫ শে বৈশাখ এলেই তাঁকে আমাদের মনে পড়ে। ‘কবিপ্রণাম’ করেই দায় সারি। তাঁর মানবতা বোধে দীক্ষিত হই না।