করোনা করোনা করোনা। আর বাবা পারিনা। অনেক হল লক-আপ, লক-ডাউনের লুকোচুরি। “Containtment Zone”-এর তিন ভাগের এক্কাদোক্কা। ব্যাপার টা একটা ফ্লু ভাইরাসকে নিয়ে। এতো আমাদের গা সওয়া। তৃতীয় বিশ্বের দেশে আমাশা, কলেরা, সর্দি, কাশি, জ্বর এগুলোর তো ছড়াছড়ি। পোলিও-য় পঙ্গু কিম্বা প্রোটিন- ক্যালোরি Malnutrition এর ফসল কয়ারসিওকর অথবা ম্যারাসমাস তাকালেই চোখে পড়ে। কঙ্কালসার দেহ……মৃত্যু হলে আমলাশোলে হামলা হয়; অনাহারে না অসুখে নাকি অতি ভোজনে! তা এ হেন দেশে বর্গীর হামলার মতো হামলে পড়ল কভিড-১৯। এল, দেখল, জয় করল………রাম রাজত্ব (?) বলে কথা! ১৩০ কোটির দেশে শতাংশের হিসেবে মৃত্যু হার যে ভয়ানক তা নয়। তবু যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, কলেরা এইসব রোগের সংক্রমণে মৃত্যু হার অনেক বেশি। ভারতে কিছু রোগ হল “Balcony Class Disease”, যেগুলো শুধু নাকি বড়লোকদের হয়। সংক্রমণযোগ্য ছোঁয়াচে রোগ বস্তিবাসী, গরিব গুরবোদের। ওরাই Third Class Citizen, তাই ওদেরই ওই সব নোংরা রোগ হয়! ওই রোগগুলো ঝুপড়ি, বস্তি কিম্বা ফুটপাতবাসীদের। আর এই সব ছোঁয়াচে রোগের মৃত্যু হার অনেক অনেক বেশি। করোনা হল So Called “Balcony Class Disease”, বিদেশজাত; বিদেশ বাহিত। যেকোনো রোগের প্রতিকারে সাধারণ কিছু বিধি নিষেধ মেনে চললে সেই রোগের কবল থেকে দূরে থাকা যায়। হাত ধোওয়া, থুথু না ফেলা ইত্যাদি সামাজিক স্বাস্থ্যবিধি। এতদিন অবধি Communicable Disease রুখতে এই সব নিয়ম কার্যকর করা যায়নি। মাস্ক কিম্বা বারে বারে হাত ধোয়ার অভ্যেস, বাধ্যতামুলক করা গেলো না কেন? কারন ওগুলো তো ছোটলোকের অসুখ! তাই ওয়াক থু করা যায় রাস্তা ঘাটে, চলন্ত ট্রামে বাসে; মেট্রোয়, পেচ্ছাপখানার দেওয়ালে …… সর্বত্র। দেওয়ালে আঁকা মনিষী কিম্বা রাজনৈতিক দাদা দিদিদের মুখেও! মুখে তাতেও কুলুপ। এখন খুলল। ইস্কুলে ‘নির্মল বিদ্যালয়’ প্রকল্পে হাত ধোয়ার নিয়মবিধির গান শেখানো হয়। খাবার আগে হাত পরিষ্কার, কিম্বা হাঁচি কাশির সময় মুখে আড়াল করা সাধারণ স্বাস্থ্য বিধির মধ্যে পড়ে, কৃমি জনিত অসুখ থেকে মুক্তিও ঘটে। করোনার দাপটে মুখ মাস্ক বদ্ধ হলে থুথু ফেলাটা কমিয়ে দেওয়া যাবে নিসন্দেহে। অনেক অসুখের প্রকোপ যাবে কমে। অবাক বিস্ময়ে দেখবেন দেওয়ালের নেতাজি, গান্ধীজি কিম্বা রবীন্দ্রনাথ গুটখা বর্জিত হয়ে নির্মল সহানুভুতির মুচকি হাসি হাসছেন।
করোনার সাম্প্রতিকতম ফল অনুযায়ী গত ১১ই মে, পশ্চিমবঙ্গে ৪২০১ টি নমুনায় ১২৪ জন পজেটিভ; আর ১৭ই মে, ৮৬৬৮ টি নমুনায় ১০১ টি। অর্থাৎ বলাই বাহুল্য করোনা করায়ত্ত। তার জন্যে দশ আঙ্গুলে দশটা পাথর, শিকড় বাকড় আটকে গ্রহ নক্ষত্রকে ধরতে হয়নি।মন্দির মসজিদ গির্জায় ধন্না দিতে হয়নি। সাধারন স্বাস্থ্য বিধি আর ডাক্তার, নার্সের পরিচর্যায় এটি সম্ভবপর হয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে আমাদের দেশে শিক্ষা ও গবেষণাখাতে ন্যূনতম রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ; প্রতিরক্ষায় সর্বাধিক। ধিক সেই মিসাইল, ক্ষেপণাস্ত্র, ট্যাঙ্ক, কামান, গোলা-বারুদ; সে সব কি পারল মহামারিকে প্রতিরোধ করতে! যদিও করোনার কামড় এখনও কমেনি। চলছে লক ডাউনও। কর্মহীন বহু, অনাহার অভুক্ত আশ্রয়হীন বহুতর। এই আবহে উঠে এল কয়েকটি নতুন শব্দ: পরিযায়ী শ্রমিক, আত্মানিরভর ভারত, “লোকাল-পে-ভোকাল” ইত্যাদি। ত্রাণ শব্দের অনুকম্পার ইঙ্গিত অনেক চাহিদাসম্পন্ন মানুষকেও রেশন পাওয়া থেকে বঞ্চিত করল। আসলে মহামারির সময় খাদ্যের জোগান রাষ্ট্রের কর্তব্য, এটা অনুকম্পা বা দয়ার দান নয়, সেটা সাধারন মধ্যবিত্ত মানাসিকতা মেনে নিতে পারল না। এরই মধ্যে মাঝে দুদিন থালা বাসন বাজিয়ে, মোমবাতি, পিদিম জ্বালিয়ে একদিকে চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী বা মহামারি মোকাবিলায় প্রথম সারিতে থাকা জনগণের মনোবল বাড়ানোর কাজ, অন্য দিকে সঠিক PPE, Sanitizer, মাস্ক ইত্যাদি চাওয়ায় পুলিশি অত্যাচার চলল। কেন্দ্রীয় সরকারের ২০ লাখ কোটির ভারত নির্মাণের এক বকচ্ছপ সুলভ অনুদান, জনগণকে অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড় করালো। বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায় কে কোভিড ছড়ানোয় জন্য দায়ী করার সুচতুর পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। প্রকট হল Social Distancing এর ব্যাঞ্জনা। রোগ ছেড়ে রোগীর সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণকে কি Social Distancing বলে? আক্ষরিক বাংলা করলে দাঁড়ায় সামাজিক দূরত্ব, সেটা কি আমাদের ভাবনার দীনতা প্রকাশ করল না? শারীরিক দূরত্ব বা Physical Distancing/Isolation যে কোনও ছোঁয়াচে রোগেরই বিধি। এ তো নতুন কিছু নয়! যে দেশের মানুষ সবাই পানীয় জল পায়না সেখানে বার বার হাত ধোওয়া যে বিলাসিতা সেটা ভাবার সময় এসেছে। আর জায়গার অপ্রতুলতার জন্যে ঝুপড়ি বা বস্তিবাসীদের পক্ষে পারস্পরিক শারীরিক দুরত্ব বজায় রাখাও কঠিন। তাই তা দ্রুত সংক্রমিত হয়। এই অসুখ ও তার প্রতিরোধ পন্থা একটা অদৃশ্য পৃথকীভবনের সুত্র দিয়ে যেন ধনী ও দরিদ্রকে স্পষ্ট দুটি ভাগে আলাদা করে দেয়।
প্রথম বিশ্বের দেশও যখন এই ভাইরাসের খপ্পরে পড়ে তখন তড়িঘড়ি তা সংবাদ শিরোনামে; তাই ঘটেছে এবারেও। এই মুহূর্তে পরিযায়ী, কাজহীন শ্রমিকের ঢল রাজ্যে রাজ্যে; তারা অনেকেই এই রোগে আক্রান্ত; নিভৃত গৃহবাস ক’জনের সম্ভব তা অনুমেয়। ১০০০-১৫০০ কিলোমিটার পথ গোরুর মতো গাদাগাদি করে ট্রাকে, পায়ে হেঁটে, সাইকেলে, অভুক্ত আর অনাহারে থেকে স্বাভাবিক Immunity-ই তলানিতে। চলতে গিয়ে মারা গেলো কত, পথে শিশু প্রসব করলেন মা, কাঠের পায়ে ভর করে এগিয়ে চললেন কেউ বা; এক কুয়োতে মরণ ঝাঁপ দিয়ে ৯ জন সব জ্বালা জুড়োলেন। কিভাবে মানবে তারা শারীরিক এই ব্যবধান! কাতারে কাতারে শ্রমিকের ঢল দেখে মধ্যবিত্ত বিরক্ত। ওই শ্রমিকগুলোই রোগ ছড়াচ্ছে। প্রমানিত হল ছোঁয়াচে রোগ সেই ছোটলোকদেরই হয়! যেন একটা সুরাহা হল।চলল শ্রমিক স্পেশাল ট্রেন! যা “আজি হতে শত বর্ষ পরে……” হতে পারে গবেষণার বিষয়!
এর মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যপালের মন কষাকষি, দিস্তে দিস্তে চিঠি চাপাটি, রেশন ত্রাণের দুর্নীতি, কেন্দ্র রাজ্যের বঞ্চনার আকচা-আকচি……সবই চলছে। ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী COVID-19 এর গ্রাফ। যদিও মৃত্যুর শতাংশ জন ঘণত্বের নিরিখে নগণ্য। এই রোগ বিশ্বের প্রথম শ্রেণির সাদা চামড়াদের ধরাশায়ী করেছে। অতি উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সত্ত্বেও পশ্চিমি দেশগুলো আক্ষরিক অর্থে নাস্তানাবুদ; ভাইরাসটি নাকি চীনা জাতের। খুব অল্প দিনেই বিভিন্ন রূপে এর মিউটেশান হল। রোগের লক্ষণ পালটিয়ে কিম্বা আদৌ কোনও লক্ষণ না দেখিয়েও বিভ্রান্তি তৈরি করতে সক্ষম এই প্রবল পরাক্রমশালী চীনা ভাইরাস। ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্য কর্মীদের সঙ্গে চু কিতকিত খেলা। এই অদৃশ্য শত্রুর মোকাবিলায় প্রয়োজন কিছু সরঞ্জামের। যেগুলো ছাড়া কিছুতেই এই যুদ্ধে জেতা সম্ভব নয়। আশ্চর্য লাগে ভাবতে যে ভারতের মত উপক্রান্তীয় অঞ্চলে (উষ্ণ ও আর্দ্র), যেখানে সংক্রামক রোগ প্রতি পদে; সেখানে কেন এই ধরণের সরঞ্জামের অভাবে সংক্রমিত হতে হবে চিকিৎসক ও নার্স কিম্বা স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য কর্মীদের? এমন কি মাস্ক, স্যানিটাইজার, PPE, এর মানের সঙ্গে আপস করতেও পিছপা হল না প্রশাসন! Ventilation এর নামে অন্য যন্ত্র সরবরাহ! এও দেখল 'আত্মানিরভর' ভারত। একই ভারত এর বুকে Balcony Class আর সতরঞ্চি ক্লাস COVID-19 কে সঙ্গে নিয়ে ভেদাভেদহীন ভারত নির্মাণ করল।
ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন, ঘরে থাকুন (আদৌ যদি থাকে)।