অনুকূলদের বাড়িতে ঘড়ির ছড়াছড়ি। ওর ঘরে, বাবা-মার ঘরে, ঠাকুরদার ঘরে সর্বত্র। সেদিন অনুকূলকে ভোরে উঠিয়ে পড়তে বসিয়ে দিয়ে গেলেন ওর বাবা দিগম্বর পাল। চোখ তুলে দেখে নিলেন পাঁচটা বারো বেজেছে। সাড়ে দশটা পর্যন্ত পড়তে হবে বাছাধনকে। মাঝখানে শুধু চা-জলখাবার। অন্তত চারঘন্টা পড়া ঠেকায় কে! পড়তে বসতে হলেই ছেলের যত যন্ত্রণা। আজ একেবারে সুদে-আসলে উশুল সব। মনের সুখে বাথরুমে ঢুকে বহু দিন পরে ভাঙা গলায় রবি ঠাকুরের গান ধরলেন, মায়াবন বিহারিণী হরিণী ইত্যাদি। এই চার ঘন্টায় টেন্স তৈরি হয়ে যাবে নির্ঘাত। যতই হোক ইংরেজির ভিত তো ওটাই। আনন্দে আত্মহারা পালমশাই ছেলের আসন্ন বন্দীদশা ও পরবর্তী পাঠনিমগ্নতার ফল ভাবতে ভাবতে গায়ে মগের পর মগ জল ঢালতে লাগলেন। হঠাৎ মূর্তিমতী বাধাস্বরূপা সুগৃহিনীর চিৎকার বাইরে, কী ব্যাপার আজ যে চান শেষ-ই হয় না পালবাবুর। এ দিকে ছ'টা যে বাজতে চলল।
শিউরে উঠলেন দিগম্বর। এ কী কথা শুনি আজ মন্হরার মুখে! এমন গোলমাল তো হবার কথা নয়। প্রায় বুফে কায়দায় খাওয়া শেষ করে দৌড়তে দৌড়তে স্টেশনে এসে যা দেখলেন তাতে চক্ষু চড়কগাছ। ট্রেন যথারীতি সময়ে চলে গেছে এবং প্ল্যাটফরমের ঘড়িতে প্রায় সাতটা। পরের ট্রেন পনের মিনিট পর। শুরু থেকেই আজ গণ্ডগোল। কী ভাবে হল এমন চিন্তা করতে করতেই নতুন বস সায়ন্তন গুপ্ত-র দাঁত খিঁচুনি। কী হচ্ছে পালবাবু! সামান্য একটা স্টেটমেন্ট তাও এত ভুল! একে তো এলেন লেটে তারপর এই সব চাইল্ডিশ ভুল। রিটায়ার বলে তো আর সব মেনে নিতে পারি না!"
লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল পালবাবুর। বাচ্চা ছেলেমেয়েদের সামনে কী অপমান!
সন্ধেবেলা তাঁকে অন্যমনস্ক হয়ে বাড়ি ঢুকতে দেকে রুমা বুঝলেন ডাল মে কুছ কালা। হাত পা ধুয়ে আসার পর স্বামীর সামনে সুজি আর চা এগিয়ে দিয়ে কেবল জানতে চাইলেন, শরীর ঠিক আছে তো?
জবাবে কিছু না বলে খাওয়া শেষ করে ছেলের ঘরে ঢুকলেন পালবাবু। একটু পরেই তার পরিত্রাহী চিৎকার এবং স্বামীর গর্জন শুনে বিস্মিত রুমা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলেন মেঝেতে বাবার মারের হাত থেকে বাঁচবার জন্য লুটোপুটি খাচ্ছে অনুকূল আর ওর সঙ্গে সঙ্গে পালবাবুও বেত হাতে এদিক ওদিক করছেন।
কী করছ - ছেলেটাকে মেরে ফেলবে নাকি? রুমা স্বামীর হাত থেকে বেত কেড়ে নিতে যেতেই চিৎকার করে উঠলেন দিগম্বর, ও কী করেছে জানো?
- কী করেছে?
- কী করেনি তাই বল?
- মানে? অবাক গলায় জানতে চাইলেন রুমা।
- যাতে দেরিতে উঠতে হয় সেই জন্যে ওর ঘরের ঘড়ির কাঁটা পিছনে করে রেখেছে। মাঝখান থেকে অফিসে আমার বেইজ্জতি হল খুব।
কথা শেষ করেই সপাং করে আর এক ঘা বেত বসিয়ে দিলেন ছেলের পিঠে। কুঁকড়ে গেল অনুকূল।
থাক আর মারতে হবে না। খুব শিক্ষা হয়েছে ওর। কথা শেষ করে ছেলেকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন রুমা।
এখনও ঘড়িগুলো আছে। তবে আগের মতো নয়। আসলে, তিরিশ বছর সময় তো বড় কম কথা নয়। মাকড়সার ঝুল আর ধুলোর পুরু আস্তর ঢেকে রেখেছে ঘর ও ঘড়ির অন্দর আর বাহির। পরিস্কার করার কেউ নেই। ভূতুড়ে বাড়ির মতো দাঁড়িয়ে আছে এক সময়ের রমরম করতে থাকা বাড়িটি তালাবন্ধ অবস্থায়। গভীর রাতে বাড়িটির প্রথম দুই পুরুষ গৃহলক্ষ্মীকে সঙ্গে নিয়ে নেমে আসেন এই পৃথিবীতে। ওঁদের পায়ের দাগ পড়ে না মাটির পৃথিবীর বুকে । এই পৃথিবীতে বড় মায়া। ওঁরা আর সেই বাঁধনে বাঁধা পড়তে নারাজ। শুধু অপেক্ষা করতে থাকেন কবে বেঙ্গালুরু থেকে আসবে ডক্টর অনুকূল পাল। সঙ্গে নিয়ে আসবে লক্ষ্মীমন্ত বৌ শ্রবণা আয়ার আর টুকটুকে লাল জ্যান্ত একটা পুতুল।
ওদের মুখ দেখেই ওঁদের কাজ শেষ। ঘড়িগুলোরই মতো। তারপর অনুকূল হয়ত ঘড়িগুলোর সঙ্গে বাড়িটাই আর রাখবে না।ওঁরা সেসব আর জানতে চান না।