২০০১ সালের নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে প্রিমিয়ার ইনফোটেক বলে একটা ছোট কোম্পানি এক সাংবাদিককে ডেকে পাঠায় তাঁদের ব্যাঙ্গালোরের অফিসে। তখন কোম্পানিটি সবে কাজ শুরু করেছে। ফলে উৎসাহ প্রচুর, গুজরাটে সদ্য মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। মোদীর একটি ই-গভরনেন্স প্রজেক্ট সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য তাঁরা ওই সাংবাদিককে ডাকেন। তাঁরা বলেন,“মোদী একজন অত্যন্ত প্রগতিশীল এবং প্রযুক্তি নির্ভর বা বলা যায় টেক স্যাভি মুখ্যমন্ত্রী, উনি চাইছেন সমস্ত গুজরাটবাসীর জন্য একটা চিপ লাগানো স্মার্ট কার্ড তৈরি করতে, যার মধ্যে সেই ব্যক্তির সমস্ত তথ্য, মানে নাম,“ঠিকানা,বয়স, রক্তের গ্রুপ ইত্যাদি থাকবে। এই কার্ডটি খুব তাড়াতাড়ি মানে আগামী দুমাসের মধ্যে তৈরি করে ফেলতে হবে, সেই জন্যই এই মিটিং।” তাঁরা সেই সাংবাদিককে আরও বলেন যে গুজরাটের অফিসারেরাও দিন রাত এক করে কাজ করছেন। সরকারী সুযোগ সুবিধা কিভাবে মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে এই কার্ডটির মাধ্যমে সেটা পরিষ্কার বোঝা যাবে। ২০০১ সালের অক্টোবর মাসে মোদী মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন এবং তার পর তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এই কাজটা শুরু হয়েছে।এটা তাঁর স্বপ্নের প্রকল্প।
এর ঠিক ৩ মাস পর গোধরায় ট্রেনে অগ্নিকান্ড। অযোধ্যা ফেরত ৫৪ জন করসেবকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার ঘটনা ঘটে। সেই দিনটা ছিল ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারির ২৭ তারিখ। তারপর সেই ৫৪ জন করসেবকদের দেহ নিয়ে গুজরাটের আহমেদাবাদ শহরে মিছিল হয়। ঠিক তার পরের দিন থেকে শুরু হয়ে যায় “গুজরাট দাঙ্গা”। কিছু কিছু জায়গায় তাণ্ডব চলে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ধরে। যার বিভিন্ন ছবি অনেকেই হয়তো দেখেছেন। হাত জোর করে একজন প্রাণ ভিক্ষা চাইছেন— এই ছবি দেখে অনেকেই হয়তো শিউড়ে উঠেছেন। যে সমস্ত মিডিয়া এই বিষয়টা রিপোর্ট করেছে এবং যতগুলো তদন্ত কমিশন বসেছে প্রত্যেকেই বলেছে যে কিভাবে তালিকা ধরে ধরে মিলিয়ে, বাড়ি থেকে টেনে বার করে মারা হয়েছে। বাড়ি থেকে টেনে বের করে ধর্ষণ করা হয়েছে এবং তারপর সেই বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রথমে মুসলমানদের বাড়ির দরজায় ঢ্যাঁড়া চিহ্ন দেওয়া হয় তারপর দিন সেই বাড়িগুলোকে ধরে ধরে আক্রমণ করা হয়। কিভাবে মানুষকে জ্যান্ত পোড়ানো হয়েছে তা আমরা দেখেছি। বাকিটা ইতিহাস। নরেন্দ্র মোদী হয়ে উঠলেন “হিন্দু হৃদয়ের সম্রাট”। সারা পৃথিবীতে চরম নিন্দিত হয়েও কিভাবে হয়ে উঠলেন “বিকাশ পুরুষ”, কিভাবে হয়ে উঠলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী তা আমরা এখন সবাই জানি। এটা যদিও জানা যায় না যে স্মার্ট কার্ডগুলো জরুরি ভিত্তিতে বানানো হয়েছিল সেগুলো এই দাঙ্গা এবং হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়েছিল কিনা। কিন্তু এই ধরনের ঘটনা যে ঘটানো যায় তার ইতিহাসে তার নজির কিন্তু আছে। কিভাবে ইহুদিদের চিহ্নিত করে মারা হয়েছিল হলেরিথ মেশিনের কার্ডের সাহায্যে ১৯৩০ সালে সেটা কারও অজানা নয়। ওই মেশিন বানাতে সাহায্য করেছিল আইবিএম। আরও কিছু বিষয় অনেকেই জানেন না যে, ফেব্রুয়ারির ২৭ তারিখটা কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ। ওই দিন থেকেই জার্মানিতে হিটলার সমস্ত রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল শুরু করেন। ১৯৩৩ সালে হিটলার ক্ষমতায় আসেন আর ওই ২৭শে ফেব্রুয়ারিই জার্মানির সংসদ রাইসট্যাগে আগুন লাগায় কিছু অজ্ঞাত পরিচয় মানুষ , হিটলার সঙ্গে সঙ্গে ঘোষণা করে দেন এটা কমিউনিস্টদের কাজ, তারপরেই সারা জার্মানিতে জরুরি অবস্থা জারি করেন এবং সমস্ত ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নেন। তারপর জন্ম হয় সেই একছত্র অধিপতির, যার নির্দেশে ৬ লক্ষ ইহুদি এবং কমিউনিস্টদের হত্যা করা হয়। ইউরোপের ধ্বংসের রূপকার অ্যাডলফ হিটলার।
হিটলারের একটা উক্তি দিয়ে এই লেখার ইতি টানা যায়, কেউ যদি আজকের সময়ের সঙ্গে কোথাও কোনও মিল পান তার জন্য লেখক দায়ী নন।
“যদি কাউকে আপনি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করতে চান তাহলে তাঁর কাছ থেকে ধীরে ধীরে তাঁর স্বাধীনতা একটু একটু করে হরণ করতে হয়, একটু একটু করে তাঁর অধিকার হরণ করতে হয় এবং এই প্রক্রিয়া এমন ভাবে করতে হয় যাতে সেটা তাঁর চোখে না পড়ে। এবং যখন সেটা চোখে পড়বে সেখান থেকে ফেরার কোনও পথ আর সেই মানুষটির কাছে না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হয়”।
আজকের দিনে আধার বুঝতে কি আর কোনও উদাহরণ লাগে?