ডাক নাম তানি। পুরো নাম তানিলউয়া আদেউমি। ২০১৭ সালে নাইজেরিয়ায় যখন ইসলামি জঙ্গী গোষ্ঠী বোকো হারাম-এর অত্যাচার তুঙ্গে তখন ছ’বছর বয়সি তানি আর তার দাদাকে নিয়ে তাদের বাবা-মা আমেরিকায় পালিয়ে যান। ম্যানহাটন শহরের উপান্তে একটি শরণার্থী শিবিরে ঠাঁই হয় তাদের। মূলত আফ্রো-এশিয়ানদের জন্যই এমন সব শরণার্থী শিবির।
স্থানীয় একটি প্রাথমিক স্কুলে ২০১৮-র গোড়ায় যাতায়াত শুরু হয় তানি ও তার দাদার। ওই স্কুলে অন্যান্য খেলার সঙ্গে দাবা খেলা শেখার চল ছিল এবং দাবা শেখাতে আসতেন আংশিক সময়ের একজন শিক্ষক। তানির খেলা শেখার আগ্রহ লক্ষ্য করে তার মা ওলুয়াটয়িন এক দিন স্থানীয় একটি দাবা ক্লাবকে ইমেল করেন। তিনি জানান, তাঁর ছেলেকে ওখানে দিতে চান এবং এও জানান যে ক্লাবের ফি জমা দেওয়ার আর্থিক সঙ্গতি তাঁদের কোনও ভাবেই নেই। রাসেল্ নামের যিনি স্কুলে ও ক্লাবে দাবা খেলার বিষয়টি দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন তিনি টাকা ছাড়াই তানিকে ভর্তি করে নেন এবং একেবারে শুরুর দিকে স্থানীয় স্কুল পর্যায়ের যে প্রতিযোগিতা হয় তাতে তানির র্যাঙ্কিং হয় সবার শেষে।
তানির বাবা নিউইয়র্ক এলাকায় উবের চালান। তার মা ছোট একটি প্রশিক্ষণের পর বিভিন্ন বাড়িতে আয়া হিসাবে কাজ পেয়েছেন। বাবা মা-র কেউই দাবা জানেন না। কিন্তু প্রতি শনিবার মা তানিকে ক্লাবের তিন ঘন্টার ফ্রি প্রাকটিসে নিয়ে যেতে থাকেন। তানির বাবা বাড়িতে একা অভ্যাস করার জন্য সন্ধেবেলা নিজের ল্যাপটপটি ছেলেকে ব্যবহার করতে দেন।
তানির দাবা খেলায় আগ্রহ বাড়তে থাকে। বেশ তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায় সে। এক বছরের মধ্যেই তার উন্নতি প্রায় বিস্ময়কর পর্যায়ে পৌঁছয়। এ বছরে নিউইয়র্কে স্কুল পর্যায়ের দাবা প্রতিযোগিতায় তানি তাদের গ্রুপে সর্বোচ্চ খেতাব জয় করে ফেলেছে। তার আগে গত কয়েক মাসে কম বয়সিদের প্রতিযোগিতায় আরও সাতটি ট্রফি লাভ করেছে সে।
এ বছর মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে তানির সাফল্যের খবর বেরোতেই সেটি বিশ্বময় ছড়িয়ে যায়। ক্ষুদে দাবাড়ুটির জন্য সাহায্যের হাত যেমন এগোয় তেমনি অস্থায়ী শিবিরে বাস করে তার এই সাফল্য অনেককেই বেশ নাড়া দেয়। বিশ্বের নানা প্রান্তে থাকা প্রাক্তন গ্র্যান্ডমাস্টারেরা তানি ও তার পরিবারের জন্য আর্থিক সহযোগিতা শুরু করেন। ট্রাম্পের নতুন শরণার্থী নীতির কারণে তানির বাবা মাকে বছর খানেকের মধ্যে নাইজেরিয়ায় ফিরে যেতে হত। পরিবর্তে, পরিবারটিকে স্থায়ী আমেরিকান নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যাপারে বিভিন্ন মহল থেকে দাবি উঠে আসে।
তানির সাফল্য থেকে দুটি বিষয় লক্ষ্য করার মতো।
এক, শরণার্থী মানে শুধু আরেক দেশে আশ্রয়প্রার্থী নয়, শরণার্থীরা কেবল বাসস্থান ও খাদ্যের সংকট তৈরি করতেই আসে না। পরিবর্তে তারা আশ্রয়দানকারী সমাজের জন্য নতুন মেধার সম্ভাবনাও সঙ্গে করে আনে। জিন বাহিত হয়ে সেই মেধা এক দিন নতুন দেশ আর তার সমাজকে বর্ণময় ও উজ্জ্বল করে। ঐতিহাসিক ভাবে শরণার্থীদের দেশ আমেরিকা। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার আগে পর্যন্ত সে দেশে বাণিজ্যিক কারণে হলেও মেধার যাত্রা অব্যাহত ছিল।
দুই, তানি যাদের প্রতিযোগিতায় হারিয়েছে আমেরিকার সেই সব সাদা চামড়ার পরিবারে অনেক দিন ধরে দাবার প্রচলন। প্রতিযাগীরা অনেকেই বাড়িতে প্রশিক্ষকের কাছে দাবার প্রশিক্ষণ নেয়। আফ্রিকান পরিবারের শিশু তানি এটিই প্রমাণ করে দেয় যে মেধা কখনও দেশ, জনগোষ্ঠী বা বিত্তের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। মেধা জন্ম নেওয়ার ক্ষেত্রে নাইজেরিয়া, আফগানিস্তান বা ছত্তিশগড়ের আদিবাসী সমাজ, কিছুই কোনও বাধা নয়। প্রাকৃতিক ভাবে তার অগাধ আগমন। দেশ কাল সমাজ ও পরিবার মেধাকে লালন করে যায়।