‘চৌকী’ শব্দের অর্থ হল—যেখানে আশ-পাশ রক্ষা করার নিমিত্ত সিপাহী থাকে ( হরিচরণ)। চৌকী আসলে প্রহরীর কার্য বা পাহারা—চমকিত চৌকিতে চঞ্চল চৌকী থানা, তেমনি গৌণ অর্থে চৌকী প্রহরী—দ্বারে চৌকি কত জনা!
দস্যু, চোর বা ডাকাতকে প্রতিহত করতে চৌকিদার লাগে। মহাকাব্যে ‘চৌকিদার’, ‘ ডাকাত’ শব্দ খুঁজে পাওয়া যায় না কিন্তু ‘ দস্যু’ শব্দ মহাভারতে পাওয়া যায়। চোর-ডাকাতের পরিবর্ত শব্দ হিসাবে ‘দস্যু’-কে গ্রহণ করা যেতে পারে যদিও শাব্দিক দিক থেকে দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।
যুবনাশ্বের পুত্র মান্ধাতা দেবতাদের রাজা ইন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, প্রভু, আমার রাজ্যে বহু যবন, কিরাত, গান্ধার, চীন, শবর, শক, কঙ্ক, রমঠ প্রভৃতি প্রজা আছেন—এঁদের ভিতর ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এবং সকল জাতির মানুষ আছেন, অনেক দস্যুও আছেন এই রাজ্যে, দস্যুদের ধর্ম কী হবে? দস্যুদেরও ধর্ম হয় না কি? হ্যাঁ, হয়। ইন্দ্র সেই উত্তর দিলেন। দেবরাজের উত্তরে যাওয়ার আগে দেখে নেওয়া যাক, মহাভারতে ডাকাতি বা দস্যুবৃত্তি কোথায় কোথায় আছে?
মহাভারতের শান্তিপর্বে ঋষি কৌশিকের আশ্রমে এক বার একদল দস্যু এসে উপস্থিত হয়। তারা একজন পথিককে খুঁজতে এসেছিল।সেই পথিকের সর্বস্ব কেড়ে তাঁকে হত্যা করে চলে যাবে দস্যুরা।পথিক ঋষির আশ্রমে এসে আত্মগোপন করেছিলেন। কৌশিক মুনি সদা সত্য কথা বলেন।তাঁকে দস্যুরা পথিকের খবর জিজ্ঞাসা করলে ঋষি পথিকের আত্মরক্ষার স্থান বলে দিলেন। দস্যুরা পথিককে মেরে তাঁর সর্বস্ব লুট করে নিয়ে চলে গেল। যথার্থ বলার পাপে কৌশিক অনন্ত নরকে নিমজ্জিত হলেন।আবার মৌষল পর্বে দেখা যায়, অর্জুন যাদব নারীদের উদ্ধার করে ফিরছেন, সেই সময় দস্যুরা ওই নারীদের অপহরণ করে নিয়ে গেল। অর্জুনের গাণ্ডীব কাজ করল না। কোনও কোনও নারী স্বেচ্ছায় দস্যুদের সঙ্গে চলে গেল।অনেককে দস্যুরা বলপূর্বক অপহরণ করে নিয়ে গেল।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এই দস্যুদের শাস্তি কী? ধর্মশাস্ত্র অনুযায়ী, চোর বা ডাকাতের হাত কেটে ফেলা হত, যাতে সমাজের আর কেউ চুরি করতে সাহস না পায়। নিবৃত্তিমূলক শাস্তিবিধান ছিল। এমনকি দস্যুদের মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দেওয়ার বিধান ছিল। দস্যুদের ধর্ম সম্পর্কে মহাভারতে দেবরাজ ইন্দ্র মান্ধাতাকে বলছেন, দস্যুরা মাতাপিতার শুশ্রুষা করবে, সত্যবচন ও নির্ভরশীলদের ভরণপোষণের পাশাপাশি সাধুভাবে জীবন নির্বাহ করবে।আপদ্ধর্মপ্রকরণে বলে হয়েছে, দস্যুরা অযুধ্যমান পুরুষকে হত্যা করবে না, স্ত্রীলোকদের ধর্ষণ করবে না, কারোর সর্বস্ব হরণ করবে না।কোনও জনপদ সম্পূর্ণরূপে লুন্ঠন করবে না।
অযুধ্যমানস্য বধো দারামর্ষঃ কৃতঘ্নতা।
ব্রহ্মর্বিত্তস্য চাদানাং নিঃশেষকরণং তথা।। (শান্তিপর্ব)
কায়ব্য নামের এক ডাকাত ডাকাতি ধর্মের দ্বারা সিদ্ধ হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ডাকাতদের আদর্শস্বরূপ। তাঁর মতে, মহিলা, শিশু, তপস্বী, ভীরু প্রমুখকে বধ করতে নেই। যারা সাধু পুরুষদের কষ্ট দেয় শুধু তাদের ধন হরণ করবে। যাদের সম্পদ সৎ কাজে ব্যয় হয় না তাদের অর্থ এবং অসৎ ব্যক্তির সম্পদ ডাকাতি করলে কোনও পাপ হয় না। অসাধুর ধন নিয়ে সাধু পুরুষের পোষণ হল আদর্শ ডাকাতের কাজ।
অসাদুভ্যোহর্থমাদায় সাধুভ্যো যঃ প্রযচ্ছতি।
আত্মানাং সংক্রমং কৃত্বা কৃৎস্নধর্ম্মবিদেব সঃ।। (শান্তিপর্ব)
অধার্মিক রাজার রাজ্যে দস্যুধর্ম বৃদ্ধি পায় কারণ যে রাজ্যে শাসক স্বয়ং দস্যুধর্মের অনুসারী সেখানে ত্রয়ী (জ্ঞান), বার্তা ( অর্থশাস্ত্র), দণ্ডনীতি ( রাজনীতি) ও আন্বীক্ষিকী (যুক্তিবিদ্যা)—এই চার বিদ্যার কদর থাকে না।দস্যুপরিবৃত শাসক যে রাজ্য শাসন করে, সেই রাজ্যের মানুষ নিশ্চিন্তমনে ধর্মচর্চা করতে পারেন না, কারণ দস্যুরা সর্বদা নানা রকমের উৎপাতের দ্বারা মানুষের ধনপ্রাণকে অতিষ্ঠ করে তোলে, তাই লোকসমাজকে কখনও অরাজক অবস্থায় রাখতে নেই।
অরাজকেষু রাষ্ট্রেষু ধর্ম্মো ন ব্যবতিষ্ঠতে।
অরাজক রাষ্ট্রে মাৎস্য-ন্যায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রত্যেককে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে হয়ে কালযাপন করতে হয়, নিশ্চিন্তমনে কিছুমাত্র করবার উপায় থাকে না।কেবল ‘জোর যার মুলুক তার’ এই অবস্থা দাঁড়ায়। তাই রাষ্ট্রকে অরাজক রাখা কিছুতেই যুক্তিসঙ্গত নয়, এই হল মহাভারতের সিদ্ধান্ত।