পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

মাতৃবন্দনা ১

  • 21 October, 2020
  • 1 Comment(s)
  • 1924 view(s)
  • লিখেছেন : শামিম আহমেদ
বাংলা হল কৃষিপ্রধান দেশ। এবং এই দেশ মাতৃবন্দনা করে, অন্য ভাষায় শক্তির আরাধনা করে। মা, শক্তি (এনার্জি) বা প্রকৃতির সঙ্গে যে প্রত্যয় ওতোপ্রোতোভাবে যুক্ত তা হল প্রযতি বা ইমপালস। প্রযতি বাদ দিয়ে সৃষ্টি সম্ভব নয়। এই প্রযতি হলেন শিব আর মাতৃকা, প্রকৃতি বা শক্তি হলেন কালী। মাতৃবন্দনা নিয়ে আজ প্রথম পর্ব।

শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর সারা জীবনে ভারতীয় পুরাণের দর্শনকে আঁকড়ে থেকেছেন। তাঁর জন্মের পূর্বে মা চন্দ্রমণি দেবী যখন সন্তানসম্ভবা তখন তিনি দেখেছিলেন শিবলিঙ্গ থেকে একটি অপূর্ব জ্যোতি তাঁর গর্ভে প্রবেশ করছে। এই হিসাবে দেখলে রামকৃষ্ণকে শিবের অবতার বলতে হয়। কিন্তু তাঁকে বিষ্ণুর অবতার এবং অবতারসমূহের মধ্যে বরিষ্ঠ বলা হয়ে থাকে। তাঁর জন্মের আগে পিতা ক্ষুদিরাম গয়ায় তীর্থ করতে গিয়ে গদাধর বিষ্ণুকে স্বপ্নে দেখেন। সেই কারণে তিনি পুত্রের নাম রাখেন গদাধর। কিন্তু এই গদাধর কি শ্রীকৃষ্ণ? মহাভারতে গদা হাতে বলরাম বেশি পরিচিত, কৃষ্ণ নন; কৃষ্ণের হাতে সুদর্শন চক্র অথবা তীরধনুকই দেখা যায়। বলরামও বিষ্ণুর অবতার। অধিকাংশ বৈষ্ণব শাখাসম্প্রদায় বলরামকে বিষ্ণুর অবতার বলে মানেন। দক্ষিণ ভারতে বলরামকে দশাবতারের তালিকায় রাখা হয়েছে। কোনও কোনও গ্রন্থে কৃষ্ণকে অবতার-তালিকার বাইরে রাখা হয়েছে, সেখানে তিনি স্বয়ং ভগবান। এই ভাবে বিবেচনা করলে শ্রীরামকৃষ্ণকে শিবের অবতার কেন বলা যাবে না সেই প্রশ্ন ওঠে। আবার ‘যিনি রাম যিনি কৃষ্ণ তিনিই ইদানীং রামকৃষ্ণ’ বাক্যটির মধ্যে রাম নিশ্চয় দাশরথি রাম, বলরাম নন; কিন্তু গদাপাণি হলায়ুধকে কেন বিবেচনায় আনা হবে না, সেই কথাও উত্থাপিত হওয়া দরকার। কৃষ্ণ যেহেতু ভাগবতে স্বয়ং ভগবান, ফলে ভাগবত পুরুষ গদাধরকে কৃষ্ণ বলতে কোনও আপত্তি থাকার কথা নয়।

শিবের প্রসঙ্গ উঠল এই কারণে যে বাংলা হল কৃষিপ্রধান দেশ। এবং এই দেশ মাতৃবন্দনা করে, অন্য ভাষায় শক্তির আরাধনা করে। মা, শক্তি (এনার্জি) বা প্রকৃতির সঙ্গে যে প্রত্যয় ওতোপ্রোতোভাবে যুক্ত তা হল প্রযতি বা ইমপালস। প্রযতি বাদ দিয়ে সৃষ্টি সম্ভব নয়। এই প্রযতি হলেন শিব আর মাতৃকা, প্রকৃতি বা শক্তি হলেন কালী। শিব দক্ষযজ্ঞে দক্ষ বা শিক্ষিতদের মস্তক কর্তন করে তাতে ছাগমুণ্ড বসিয়ে দিয়েছিলেন। ঊনবিংশ শতকের শেষে যে নবজাগরণ বাংলায় হয়েছিল তার প্রাণপুরুষ ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। তথাকথিত শিক্ষিত বড়লোকদের দক্ষযজ্ঞ তিনিই পণ্ড করেছিলেন সদর্থক অর্থে। দক্ষ বা পণ্ডিতদের মস্তক কর্তন করে তাতে ছাগমুণ্ড বসিয়ে দিয়েছিলেন। কথাগুলি আলঙ্কারিক অর্থে বললাম।

বাংলার যে কৃষিভিত্তিক দর্শন, তার থেকে তন্ত্রের উদ্ভব। ‘তন্ত্র’ শব্দের প্রাথমিক অর্থ হল সন্তান বা অপত্য। মাতৃবন্দনার মূলে রয়েছে সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা। কূল, বংশ, শ্রেণি এবং শাস্ত্রীয় বিধিপরম্পরাকেও তন্ত্র বলে। এই দেশে সন্তানদায়িনী দেবীর নাম ষষ্ঠী, তিনি শিশুদের প্রতিপালনকারী। আবার এই দেশে সাংখ্য দর্শন ষষ্ঠীতন্ত্র বলে কথা। বঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় ষষ্ঠীতলা আছে। ষষ্ঠী সন্তানদায়নী দেবীর নাম। তিনিই মাতৃকা দেবী।

ভারতের সর্বপ্রাচীন সাংখ্য দর্শনকে ষষ্ঠীতন্ত্র বলা হয়। সাংখ্য দর্শনের মূলে আছে এই প্রকৃতি ও পুরুষ। মহাভারতে সাংখ্য দর্শন হল সিদ্ধান্তী, অবশ্য সেই সাংখ্য কাপিলম্ থেকে কিঞ্চিৎ ভিন্ন। তন্ত্র সাধারণত শাক্ত সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত, তার পরে শৈব সম্প্রদায়ও তা গ্রহণ করেছে। শক্তি আরাধনা বা তন্ত্র সবেতেই আছে মাতৃ আরাধনা।

সাংখ্য ও তন্ত্রের মূল তত্ত্ব হল- প্রকৃতি-পুরুষ। শংকরাচার্য সাংখ্যবাদীদের ‘তন্ত্রান্তরীয়া’ বলে উল্লেখ করেছেন। শঙ্করাচার্য শুধুমাত্র সাংখ্যকে বোঝানোর জন্যই ‘তন্ত্র’ শব্দের উল্লেখ করেছেন। অন্য দর্শন প্রসঙ্গে তিনি তা করেননি। ফলে বুঝতে হবে, তন্ত্র বলতে তত্ত্ব বা বাদকে বোঝানো হয়নি। এছাড়া সাংখ্যকারিকার লেখক ঈশ্বরকৃষ্ণ সাংখ্য দর্শনকে তন্ত্র বলে উল্লেখ করেছেন। সাংখ্যের ষাটটি তত্ত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। সেই কারণেই ‘ষষ্টিতন্ত্র’ নামে সাংখ্যকে অভিহিত করা যায়। তবে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, ষষ্টী এই দেশে সন্তানদায়িনী দেবীর নাম। ‘ষষ্টিকা’ বলতে ধানকে বোঝায়। সেই জন্য তিনি অনুমান করেছেন, ‘ষষ্টিতন্ত্র’ নামের পেছনে কৃষিভিত্তিক ধ্যান ধারণার বা তন্ত্রের আভাস খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। লোকায়ত, তন্ত্র এবং সাংখ্যের ধ্যানধারণার উৎস কৃষিকেন্দ্রিক জাদুবিশ্বাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। লোকায়ত মতকে যেমন জনসাধারণের মধ্যে পরিব্যাপ্ত মনে করা হয়, তেমনি লোকায়ত দেহাত্মবাদও একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ব। অনুরূপভাবে তন্ত্রের দেহতত্ত্ব ও সাংখ্যের প্রকৃতিবাদ লোকায়ত মত থেকে খুব একটা পৃথক নয়। তন্ত্র, প্রকৃতিবাদ সব তত্ত্বই মাতৃ আরাধনার কথা বলে।

শিল্পী -- আনখ সমুদ্দুর।

লেখকের মাতৃবন্দনা দ্বিতীয় পর্ব পড়তে পারবেন এই সুত্রে--- https://www.sahomon.com/welcome/singlepost/worshipping-the-mother-part-2

লেখকের মাতৃবন্দনা তৃতীয় পর্ব পড়তে পারবেন এই সুত্রে---https://www.sahomon.com/welcome/singlepost/worshipping-the-mother-part-3

লেখকের মাতৃবন্দনা চতুর্থ পর্ব পড়তে পারবেন এই সুত্রে----https://www.sahomon.com/welcome/singlepost/worshipping-the-mother-part-4

1 Comments

Soumitra Bose

22 October, 2020

মাতৃবন্দনা নাস্তিক কারণ তা বেড বিরোধী , ভাগবতগীতা বিরোধী , দেবী ভাগবতেও কালী পূজিতা নন, তবে শক্তি বটেই, মাতৃ বন্দনা পশুপালক ও অরণ্য ধ্বংসকারী পত্র পুষ্প শস্প ধ্বংসকারী (অ)সভ্যতা বিরোধী তাই মাতৃসাধক রা নাকি আর্য্য পুরুষশাসিত "স্বর্গ" এ পৌঁছতে পারে না। মাতৃ ও তন্ত্র সাধকরা ওই সব বিশ্বাসের ধরে কাছে নেই , তাঁরা নিজেরাই মাতৃতান্ত্রিক। লেখক "তন্ত্র" শব্দের ব্যাখ্যা ও ব্যুৎপত্তি দিয়েছেন , তা অনুসরণ করেই বলা যায় মাতৃতন্ত্র, মাতৃপথীক এবং মাতৃআরাধোনা নাস্তিক ও প্রকৃতির এবং , সেটাই বাংলার ঐতিহ্য।

Post Comment