২০১৪ সালের আগে, বিজেপি তখনও ক্ষমতায় আসেনি, তখন আমরা কী দেখেছিলাম। দেখেছিলাম, কংগ্রেসের অসফল গর্ভন্যান্সের বিরুদ্ধে, তাঁদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটা ন্যারেটিভ তৈরী হয়েছিল। কে বা কারা, সেই ন্যারেটিভ তৈরীর পিছনে ছিল, সেই বিতর্কে না গিয়েও বলা যায়, দীর্ঘ গবেষণার পরে, মানুষ কোন প্ল্যাঙ্কে বিজেপিকে ভোট দিতে পারে, তা বিজেপির হয়ে যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁরা বুঝেছিলেন। সেই জন্যেই বিভিন্ন ঘটনায়, বিজেপির শ্লোগান তৈরী হয়েছিল, ‘বহুত হুয়া ভ্রষ্টাচার, আবকি বার মোদী সরকার’, কিংবা নারী সুরক্ষার প্রশ্নে তৈরী হয়েছিল, ‘বহুত হুয়া নারী পর বার, আবকি বার মোদী সরকার’।
এগুলো তো হলো নেগেটিভ শ্লোগান, তাঁরা কিন্তু পজিটিভ শ্লোগানও দিয়েছিল, যাতে বহু মানুষ আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তাঁরা ‘আচ্ছে দিন’ বলে একটি কয়েনেজকে সামনে এনেছিলেন, যা শুনে বহু মানুষ হয়তো ভেবেছিলেন, হয়তো বিজেপি আসলে, তাঁর ব্যক্তিগত কিছু ভালো হবে। আসলে প্রতিটি শ্লোগানের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ মানুষ, প্রতিটি মানুষ যাতে নিজের ভালোটুকু ভাবতে পারেন। ২০১৪ সালের পরে, দশ বছর হয়ে গেছে। আচ্ছে দিন না আসলেও, বিজেপি কিন্তু সেই পজিটিভিটি থেকে নিজেদের সরিয়ে আনেনি, বরঞ্চ আচ্ছে দিন, আজ না হলেও ২০৫০ সালে আসবে বলে ভোটারদের বোঝাতে পেরেছে।
সুতরাং বিজেপিকে হারাতে গেলে, শুধুমাত্র তাঁদের অনাচার, অত্যাচারের কথা বললে হবে না। এমন কিছু পজিটিভ শ্লোগান তুলে আনতে হবে, যাতে প্রতিটি ভোটার ভাবতে বাধ্য হয়, হয়তো বিরোধী ‘ইন্ডিয়া জোট’কে ক্ষমতায় আনলে, তাঁর ও ভালো হতে পারে, ব্যক্তিগত স্তরে। ‘জুড়েগা ভারত, জিতেগা ইন্ডিয়া’ ভালো শ্লোগান, কিন্তু সেটা মুষ্টিমেয় মানুষের জন্য, যাঁরা গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে ভাবিত, সংবিধান নিয়ে ভাবিত, ভারতের হিন্দু রাষ্ট্র হয়ে যাওয়া নিয়ে ভাবিত, তাঁদের জন্য। যে শ্লোগান সমস্ত স্তরের মানুষকে ছুঁতে পারে না, সেই শ্লোগান বা কয়েনেজ দিয়ে নির্বাচনী সাফল্য আসেনা। যে লড়াইতে সাধারণ মানুষ জিততে পারে, সেই লড়াইটাই সাধারণ মানুষ করতে চায়। গত দশ বছরে, একমাত্র একটা লড়াইতেই সাধারণ মানুষ বিজেপিকে পরাজিত করতে পেরেছে, তা হলো, হার না মানা, কৃষক আন্দোলন, যেখানে কৃষকেরা মোদীর বিরুদ্ধে লড়াই আর একচেটিয়া পুঁজির বিরুদ্ধে লড়াইটাকে সামনে নিয়ে এসে, একসঙ্গে লড়েছিলেন। মাথা নত করতে হয়েছিল, প্রবল পরাক্রমী মোদী সরকারকে।
বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কিন্তু জানে, তাঁরা কোথায় হেরেছিল। বিরোধী দলের কেউ কেউ আদানির দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেছেন, কিন্তু তাঁদেরই পরিচালিত বেশ কিছু রাজ্য সরকার আদানিকে জায়গা দিয়েছে। স্বভাবতই সাধারণ মানুষ দ্বিধায় ভুগেছেন। আরো একটা কথা বিজেপি যেহেতু কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আছে, সুতরাং তাঁদের পক্ষে ডোলের রাজনীতি করা অনেক সোজা। তার সঙ্গে কি বিরোধী দলগুলো পাল্লা দিয়ে পারে? এবার আসা যাক হিন্দুত্ব প্রসঙ্গে। মানুষের কাছে যদি এই বার্তা পৌঁছনোর চেষ্টা হয়, আমরাও কম হিন্দু নই, বিজেপির উগ্র হিন্দুত্বের বদলে আমাদের নরম হিন্দুত্ব একটু বেশী ভালো, মানুষ কেন তা মেনে নেবে? বেশীরভাগ মানুষকে তো এটা দশ বছরে বোঝানো গেছে, যে মুসলমানরা দেশের শত্রু, সুতরাং যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বেশী ঘৃণা ছড়াতে পারবে, তাকে তাঁরাই বেছে নেবে। কমলনাথ থেকে শুরু করে ছত্তিশগড়ের মুখ্যমন্ত্রী সবাই ভেবেছিলেন, এই প্ল্যাঙ্কে খেললে হয়তো হিন্দু ভোটে ভাগ বসানো যাবে, কিন্তু বাস্তবে হয়েছে উল্টো। সুতরাং বিরোধী ‘ইন্ডিয়া জোট’কে ভাবতে হবে, ভবিষ্যতে এই লাইনে আর ভোটে লড়াই করা উচিৎ হবে কি না। সামনে রামমন্দিরের উদ্ধোধন, বিজেপি আরো বেশী করে এই লাইনে দেশের মানুষকে টানার চেষ্টা করবে, শুধু তাই নয়, তাঁরা বিরোধী দলগুলোর নেতাদেরও ঐ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাবে। তাঁরা কি সেই আমন্ত্রণ রক্ষা করবে, না ফিরিয়ে দেবে, তা তাঁরাই ঠিক করবে। এটা অনেকটা শাঁখের করাতের মতো, আসতেও কাটবে, যেতেও কাটবে। জাতি গণনার তাসও যে কাজে আসেনি, তাও এই নির্বাচন দেখিয়ে দিয়েছে। যে মণ্ডল রাজনীতির বিরোধিতা একসময়ে কংগ্রেস করেছিল, তাঁরাই যদি আজকে জাতিগত জনগণনার কথা বলে, তাহলে সেটা বিশ্বাসযোগ্য হয় কি? হয়তো কোনও একটি রাজ্যে জাতিগণনা কাজে দিতে পারে, কিন্তু তাও সেটা পরীক্ষিত হয়নি এখনো। এই বিধানসভা নির্বাচনের ফল কিন্তু আবারও দেখিয়ে দিল, যখন সামনে কোনও কিছুই কাজ করে না, তখন আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হয়, আবার স্বরবর্ণ বা ব্যঞ্জনবর্ণ দিয়ে শুরু করতে হয়। যখন আদানির দুর্নীতির কথা বলা হবে, তা কীভাবে সাধারণ মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তা সহজ করেই বুঝতে এবং বোঝাতে হবে। শ্রেণীর রাজনীতি, গরীব মানুষের কথা বলা, কৃষকের অসুবিধার কথা বলা, শ্রমিকদের মজুরী সংক্রান্ত দাবী, গিগ শ্রমিকদের কাজের নিরাপত্তা, এই সমস্ত কিছুর কথাই বলা জরুরী। খুব দ্রুত পজিটিভ কিছু শ্লোগান যা মানুষের মনে আশার আলো দেখাতে পারে,তীব্র বেকারত্ব, দারিদ্র এবং অন্য সব কিছু নিয়ে তৈরী না করতে পারলে সামনে সমূহ বিপদ তা বলাই বাহুল্য।