পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

প্রধানমন্ত্রীকে শিশুদের টিকা দেওয়ার পরামর্শ কে দিয়েছিলেন?

  • 16 February, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 2072 view(s)
  • লিখেছেন : ডাঃ অমিতাভ ব্যানার্জি
আনাড়ির মতো টিকাকরণ আসলে বিপরীত ফল দেবে। এর ফলে মানুষ সত্যিকারের কার্যকর ভ্যাকসিনগুলোর ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে। যে-ভ্যাক্সিনগুলো আরও প্রাণঘাতী রোগ থেকে মৃত্যু প্রতিরোধ করে, যেমন হাম, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাফ, ইত্যাদি নানা শ্বাসতন্ত্রীয় সংক্রমণ এবং টাইফয়েড, জাপানিজ এনসেফালাইটিস, টিটেনাসও। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো কে প্রধানমন্ত্রীকে বাচ্চাদের টিকাকরণের প্রস্তাব দিলেন?

২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ভারত সরকার ১৫ থেকে ১৮ বয়সী শিশু-কিশোরদের জন্য করোনার ভ্যাক্সিন চালু করেছে। এই সিদ্ধান্ত অবাক করে দেওয়ার মতো। কারণ, ভ্যাক্সিন সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ন্যাশনাল টেকনিকাল অ্যাডভাইসারি গ্রুপ ফর ইমিউনাইজেশন (‘এনটিএজিআই’) নামে যে-সংস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল, তারই একজন সদস্য বলেছিলেন, কমিটি তো এরকম কোনও সুপারিশ করেনি! বরং বলেছে যে, ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু-কিশোরদের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার বা তাতে মৃত্যুর ঝুঁকি খুবই কম। পাশাপাশি আমাদের দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় জনস্বাস্থ্যবিদ ডা জয়প্রকাশ মুলিয়েল ২১শে ডিসেম্বর মিডিয়াকে বলেছিলেন, ‘এনটিএজিআই’ প্যানেল কেন্দ্রীয় সরকারকে পরিষ্কার জানিয়েছে যে, শিশুরা ভাল আছে, তাদের ভ্যাক্সিন দেওয়া উচিত না। তিনি আরও বলেছিলেন যে, ভারতে কোভিড১৯-এর কারণে ১২ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে একটিও মৃত্যু দেখা যায়নি। “ক্যানসার, লিউকিমিয়া এবং অন্যান্য যে-অসুখগুলো শিশুদের মধ্যে দেখা যায়, সেইসব রোগের কারণে শিশুদের মধ্যে মৃত্যুর সংখ্যা কত, সেই তথ্য আমরা সংগ্রহ করেছি। সেই মৃত্যুগুলোর জন্য কোভিড১৯ দায়ী নয়।” ২০২১ সালের অক্টোবরে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মনসুখ মাণ্ডাভিয়াও জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, শিশুদের টিকা দেওয়ার জন্য কোনও তাড়াহুড়ো করা উচিত নয়।

তাহলে হঠাৎ এমন কী হল যে, এইভাবে বিনামেঘে বজ্রপাতের মতো, প্রধানমন্ত্রী শিশুদের মধ্যে টিকাভিযানের কথা ঘোষণা করে বসলেন? আবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই, যেন নিতান্ত বাধ্য কর্মচারীর মতো, ওই এনটিএজিআই-এরই চেয়ারপারসন ডা এন কে অরোরা ঘোষণা করে দিলেন যে, ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুকিশোরদের আচরণ নাকি প্রায় প্রাপ্তবয়স্কদের মতোই; তাই ভ্যাক্সিন যেন দ্রুত হারে দেওয়া হয়! তিনি এমনকী, এও বলে ফেললেন যে, কোভিড১৯-এ যত মৃত্যু হয়েছে তার দুই-তৃতীয়াংশই নাকি এই বয়সের মধ্যেই ঘটেছে! অথচ এমন মারাত্মক মন্তব্যের সমর্থনে কোনও তথ্য নেই, হিসেব নেই। তাই এমন মন্তব্য সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, ভিত্তিহীন। আসলে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুকিশোরদের মধ্যে কোভিড১৯-এর সংক্রমণে বেঁচে থাকার হার ৯৯.৯৯৭৩%। এই তথ্য সরকারিভাবেই স্বীকৃত।

এরকম আনাড়ির মতো টিকাকরণ আসলে বিপরীত ফল দেবে। এর ফলে মানুষ সত্যিকারের কার্যকর ভ্যাকসিনগুলোর ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে। যে-ভ্যাক্সিনগুলো আরও প্রাণঘাতী রোগ থেকে মৃত্যু প্রতিরোধ করে, যেমন হাম, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাফ, ইত্যাদি নানা শ্বাসতন্ত্রীয় সংক্রমণ এবং টাইফয়েড, জাপানিজ এনসেফালাইটিস, টিটেনাসও।

এদেশে শিশুদের অপুষ্টি ভয়ঙ্কর। এই অপুষ্টির আঙিনায় আছে ডায়ারিয়া সমেত অন্যান্য প্রতিরোধযোগ্য অসুখ-বিসুখ। তাতে প্রতিদিন ভারতে দুহাজারেরও বেশি শিশু মারা যায়। ওদিকে ‘এনটিএজিআই’-এর চেয়ারপার্সনের বিভ্রান্তিকর বিবৃতি সত্ত্বেও কোভিড১৯-এ একটি শিশুর মৃত্যুও বিরল। এই অবস্থায় দেশের অর্থ এবং অন্যান্য সংস্থান শিশু-কিশোরদের মধ্যে গণ-টিকাকরণের জন্য লাগিয়ে দেওয়ার যে কর্মসূচী নেওয়া হল, তা জনস্বাস্থ্য এবং স্বাস্থ্যের আর্থিক ব্যবস্থাপনার যাবতীয় নীতির বিরুদ্ধে যায়। সব ভ্যাক্সিনেরই কিছু না-কিছু ঝুঁকি থাকে, তাই তা দীর্ঘ দিনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে অনুমোদিত হয় আর তারপরে তা সার্বজনিকভাবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু করোনার ভ্যাকসিন এখনও পরীক্ষামূলক স্তরেই রয়েছে। ভ্যাকসিনের স্বল্পমেয়াদী বা দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকি যা আরও জরুরি, সেগুলিকে উপেক্ষা করেই সার্বজনিক প্রয়োগ শুরু করে দেওয়া হয়েছে। একটা কৌতূহলের ব্যাপার হল, ‘এনটিএজিআই’-এর চেয়ারপার্সন নিজেই গত বছরের শুরুর দিকে এই মত প্রকাশ করেছিলেন যে, শিশু এবং তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের টিকা দেওয়াটা ঠিক হবে না; কারণ, তারা কোভিড১৯-এ ভুগছে না। ভ্যাক্সিন সংক্রমণ রোধ করে না, সংক্রমণের বিস্তারও রোধ করে না; বরং গণটিকাকরণ ভাইরাসের নতুন নতুন ‘মিউট্যান্ট স্ট্রেন’-এর উত্থানকে উৎসাহিত করতে পারে।

শিশুদের অভিভাবক আর যারা নীতিনির্ধারক তাদের উদ্বেগকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। ঝুঁকি আছে তিনটি স্তরে - ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং গোষ্ঠীগত। এ-প্রসঙ্গে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে “নেচার” পত্রিকায় একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয় যা সুস্থ শিশুদের জন্য ভরসা যোগায়। “নেচার” পত্রিকা ইংল্যান্ডের শিশুদের মধ্যে কোভিড সংক্রান্ত তথ্যগুলো সংকলন করেছে। মার্চ ২০২০ থেকে ফেব্রুয়ারী ২০২১ পর্যন্ত সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ওই এক বছরের মধ্যে ১৮ বছরের কম বয়সী ৯৯.৯৯৫% শিশু এবং তরুণ প্রাপ্তবয়স্ক, যারা করোনায় সংক্রমিত হয়েছিল তারা কেউ মারা যায়নি। বিরল মৃত্যু যা ঘটেছিল তা ছিল প্রান্তিক এশীয় এবং কৃষ্ণাঙ্গ জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে, পাশাপাশি যাদের অন্যান্য অসুখ-বিসুখ রয়েছে।

যে-সুইডেন সমগ্র অতিমারীকাল জুড়ে স্কুলগুলি খোলা রেখেছিল সেখানে শিশুদের মধ্যে বা স্কুলের শিক্ষক কর্মীদের মধ্যে কোনও অসুখ বা মৃত্যু দেখা যায়নি। নিউইয়র্কে প্রকাশিত “নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন”-এ প্রকাশিত একটি সমীক্ষা জানিয়েছে যে, সুইডেনে শিশুদের মধ্যে কোভিড১৯-এ গুরুতর অসুস্থতার ঘটনা বিরল ব্যতিক্রম। সেখানে একলক্ষ তিরিশ হাজার শিশুর মধ্যে একটিমাত্র শিশু ‘আইসিইউ’তে ভর্তি হয়েছিল এবং ৪ মাস পর্যবেক্ষণের সময় একটিও মৃত্যু দেখা যায়নি। তাহলে ব্যক্তিগত স্তরে ঝুঁকি কোথায়? পারিবারিক স্তরে এবং গোষ্ঠী স্তরেই বা কী ঝুঁকি রয়েছে? শিশুরা পরিবারের বয়স্কদের মধ্যে এবং গোষ্ঠীর মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে দেবে?

তাহলে দেখুন। “কোভিড১৯ সংক্রমণের বিস্তার – এর জন্য শিশুদেরকে দোষারোপ করা যায় না”, এই শিরোনামে “পেডিয়াট্রিক্স” পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধের সিদ্ধান্ত ছিল, পরিবারে বয়স্করা সংক্রমিত হয়ে অসুস্থ হওয়ার পরই শিশুরা সংক্রমিত হয়, উলটোটা না। তাই কোভিড সংক্রমণ ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে শিশুদেরকে দায়ী করা চলে না। ওই প্রবন্ধের সারসংক্ষেপ হল, স্কুল খোলার কারণে কোভিড১৯-এর গোষ্ঠী সংক্রমণ হয় না। বরং ইনফ্লুয়েঞ্জায় দেখা গেছে, স্কুলের বাচ্চারা গোষ্ঠী সংক্রমণ ছড়ায় বেশি। তার মানে, ব্যক্তিগত, পরিবারগত আর গোষ্ঠীগত করোনা সংক্রমণ, এই তিন প্রসঙ্গেই শিশুরা নিরপরাধ।

দেশের অনেক জায়গায় ‘সেরোসার্ভে’ করে দেখা গেছে যে, ১৮বছরের কম বয়সী ৮০% এরও বেশি শিশুকিশোর ইতিমধ্যেই নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রামিত হয়েছে যাদের বেশিরভাগই উপসর্গহীন। ইজরায়েলের তথ্য থেকে গবেষণায় সন্দেহাতীতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, প্রাকৃতিক অনাক্রম্যতা বা সংক্রমণের ফলে স্বাভাবিকভাবে অর্জিত প্রতিরোধ ক্ষমতা ভ্যাকসিনের চেয়ে ১৩ গুণ বেশি শক্তিশালী। তাহলে শিশুদের মধ্যে ব্যাপক টিকাকরণ স্রেফ অপচয় ছাড়া কিছু নয়। বরং তা শিশু এবং তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে অন্য ব্যাধির ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলবে। যেসব দেশে এই গণটিকাকরণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং ঝুঁকির ওপর নজরদারির বন্দোবস্ত ভাল, সেইসব দেশে ইতিমধ্যেই ‘মায়োকার্ডাইটিস’-এর মতো প্রতিকূল ঘটনা লক্ষ্য করা গেছে। এছাড়াও এই টিকাকরণের অজানা, দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব হয়ত অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে পারে। ভবিষ্যতের সেই অনাগত ঝুঁকি তো থেকেই যাচ্ছে।

কেন্দ্রীয় সরকার টিকাকরণ বাধ্যতামূলক করেনি, ঠিক কথা। কিন্তু বেশিরভাগ রাজ্য সরকার টিকাপ্রাপ্ত এবং যারা টিকা নেয়নি তাদের মধ্যে তুমুল বৈষম্য সৃষ্টি করে কার্যত টিকা নেওয়া বাধ্যতামূলক করে ফেলেছে। ভ্যাক্সিনের সঙ্গে স্কুলে উপস্থিতি, বিনোদন, মল, চাকরি এবং ট্রেন এবং বাসে যাতায়াতের ক্ষেত্রে এই বৈষম্য প্রকট। ভ্যাক্সিন না-নেওয়া নাগরিকদের অপবাদের শিকার হতে হচ্ছে, অশিক্ষিত বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাদের সঙ্গে এমন আচরণ করা হচ্ছে যেন তারা শিশু, অবোধ, তারা বোঝেই না কীসে তাদের ভাল, কীসে মন্দ।

এইভাবে ভ্যাক্সিন নিয়ে কেন্দ্র এবং রাজ্য, দুয়ে মিলে এক মজার খেলা শুরু করেছে। সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা পেশ করে কেন্দ্রীয় সরকার বলছে, আহা, টিকা তো আর বাধ্যতামূলক না; নিতেও পার নাও নিতে পার, তোমার ইচ্ছে! ওদিকে রাজ্য সরকারগুলি নাগরিকদের ধমক দিচ্ছে, টিকা তো নিতেই হবে! হাতে লাঠি নিয়ে, সামনে গাজর ঝুলিয়ে বলছে, খাও, খেলে এটা পাবে, ওটা পাবে! আর যদি না-খাও তাহলে জুটবে লাঠির বাড়ি। বাবা-কেন্দ্র আর মা-রাজ্যের এই যৌথ, ধূর্ত খেলাই এখন চলছে।

(এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে ৬-ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ই-পেপার ন্যাশনাল হ্যারল্ড ইন্ডিয়াতে। লেখক প্রথিতযশা জনস্বাস্থ্যবিদ, পুনের ডি ওয়াই পাতিল মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন-এর বিভাগীয় প্রধান। লেখাটির ভাষান্তর করেছেন অরূপশঙ্কর মৈত্র)

0 Comments

Post Comment