সম্প্রতি রাজ্যের শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের এক আলোচনা সভায় জানা গিয়েছে, কোভিডে স্কুল বন্ধ থাকার জেরে বহুসংখ্যক পড়ুয়া ভাষার প্রাথমিক জ্ঞান এবং সাধারণ যোগ বিয়োগের অঙ্কও ভুলে গিয়েছে। ওই আলোচনা সভায় প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণীর সাত হাজারের উপর পড়ুয়ার উপর করা একটি সমীক্ষার কথা বলা হয়েছে যেখানে দেখা গিয়েছে ১০০ জনের মধ্যে ৯২ জনই স্কুলে শেখা প্রাথমিক ভাষার শিক্ষা অনেকটাই ভুলে গিয়েছে। ৮২ শতাংশ পড়ুয়া ভুলে গিয়েছে সাধারণ যোগ বিয়োগ।
এটা যে শুধু আমাদের রাজ্যের চিত্র তাই নয়। সর্বভারতীয় স্তরে পৃথক একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, দেশের প্রায় সর্বত্রই শিক্ষার এই হাল। শুধুমাত্র দেশের বড় শহরে বসে স্কুল শিক্ষার প্রকৃত চিত্রটা উপলব্ধি করা যায় না। কিন্তু বাস্তব হল, অতিমারীর সময় থেকে দেশের প্রায় অর্ধেক পড়ুয়া শিক্ষার পরিধির বাইরে চলে গিয়েছে। "অনলাইন শিক্ষা" বলতে যা বোঝান হয়, দৈনন্দিন তার সুযোগ খুব অল্প সংখ্যকের কাছেই পৌঁছয়।
শহরের বেসরকারি মাধ্যমের স্কুলে পড়ে যারা তাদের এই আওতায় আনলে চলবে না।দেশের জনসংখ্যার বিচার করলে বেসরকারি স্কুলের পড়ুয়ারা মোট পড়ুয়ার ১০% ও হবে কি না সন্দেহ। বেসরকারি স্কুলের সংখ্যাগরিষ্ঠ পড়ুয়া যে অনলাইন শিক্ষার আওতায় রয়েছে, তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। অনলাইন শিক্ষার আওতায় যারা রয়েছে , তারা কম বেশি লেখাপড়ার চর্চার মধ্যে রয়েছে। কিন্তু সরকারি ও সরকার- পোষিত স্কুলের একটা বড় সংখ্যক পড়ুয়াই অনলাইন শিক্ষার আওতার বাইরে।যারা অনলাইন শিক্ষার বাইরে, তাদের একটা বড় অংশ আবার পুরোপুরি শিক্ষার পরিধির বাইরে চলে গেছে। অতিমারীর পর স্কুল খুললে এই বাইরে চলে যাওয়া কোটি কোটি পড়ুয়াকে যে ফের শিক্ষার অঙ্গনে আনা কঠিন কাজ হবে, সন্দেহ নেই। যারা পুরোপুরি শিক্ষার পরিধির বাইরে না গেলেও ভাষা আর অঙ্কের স্কুলের পাঠ ভুলে গিয়েছে তাদের অতীতের জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে আসাও সহজ কাজ নয়।কীভাবে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ স্কুল পড়ুয়াকে কোভিড পূর্ববর্তী অবস্থায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে, তা নিয়ে এখন থেকেই গভীর আলাপ আলোচনা ও বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, শুধু শিক্ষকদের দিয়ে এই কাজ সম্ভব নয়। সমাজের অন্য অংশের সহযোগিতা প্রয়োজন।সেই সহযোগিতা কোন পথে আসবে,সরকারের কী ভূমিকা হবে - এগুলি এখনই ঠিক করে ফেলা দরকার। কোভিড মহামারী সামগ্রিকভাবে আমাদের জীবনে কী ক্ষয়ক্ষতি করেছে, তার হিসাব কষতে কষতে হয়ত বহু সময় লেগে যাবে। এমন কিছু ক্ষতির দিক আছে যা আগামী কয়েক প্রজন্ম কেটে যাবে পূরণ হতে। সেই রকমই একটি ক্ষতের জায়গা স্কুল শিক্ষা। গত দেড় বছর ধরে দেশে কার্যত সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। বিদেশেও বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। ভারতের মত বহু দেশে অতিমারীর জেরে এখনও অধিকাংশ ছেলেমেয়ে স্কুলে যাচ্ছে না।বেশ কিছু বেসরকারি স্কুল মালিক স্কুল বন্ধ রেখে,পড়ুয়াদের থেকে পুরো মাইনে এমনকি বাস, এয়ারকন্ডিশন, লাইব্রেরি-সহ সমস্ত টাকা আদায় করছেন। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফল যে এত ভয়াবহ হতে পারে তা এবার একটু একটু করে আমাদের সামনে প্রকাশ্যে আসছে। এন্থনী ফাউচি সহ আরও বহু প্রখ্যাত অতিমারী বিশেষজ্ঞ বারবার বলেছেন অতিমারীতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের পড়াশোনা। বোঝাই যাচ্ছে অতি সত্বর স্কুল খোলা দরকার। কিন্তু সব পড়ুয়ার টিকাকরণ সম্পুর্ন হওয়া স্কুল খোলার একমাত্র শর্ত হতে পারে না। স্কুল খোলার প্রথম ও প্রধান শর্ত যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সমস্ত শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর টিকাকরণ।স্কুলের ঘর হতে হবে খোলামেলা, থাকতে হবে হাওয়া চলাচলের সুবন্দোবস্ত। এসবের অভাবেই যেখানে যেখানে অপরিকল্পিত ভাবে স্কুল খুলেছে, সেখানেই করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় আবার বন্ধ করে দিতে হয়েছে স্কুল।একটি সাম্প্রতিক গবেষণা জানাচ্ছে যে কোভিডকালে ১১-২১ বছর বয়সী পড়ুয়াদের আত্মহত্যার চেষ্টার প্রবণতা বিগত বছরগুলোর তুলনায় বেড়ে গেছে দ্বিগুণেরও বেশি। বয়সন্ধিকালের যারা তাদের নিঃসীম একাকিত্বে শ্বাসরোধ হওয়ার জোগাড়। স্কুল কি শুধুই লেখাপড়ার জন্য? কর্মদক্ষতা আর প্রতিযোগিতার হাতেখড়ি হয় স্কুলেই।সামাজিক অনুশাসনের প্রয়োজন এবং অপরিহার্যতা বোঝায় স্কুল। বাড়ির চারদেওয়ালের কড়া নজরদারির ঘেরাটোপের বাইরে স্কুলই সেই আনন্দনিকেতন যেখানে শিশু প্রকৃত অর্থে মুক্ত ও গণতান্ত্রিক। পড়ুয়াদের স্বাধীন সত্তার শত পুষ্প বিকশিত হয় স্কুলের উর্বর মাটিতে। বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েদের চোখের ইশারা, হাতে হাত, গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে করা প্রাকটিক্যাল ক্লাস, ছুঁড়ে দেওয়া কবিতা, স্কুলের শেষে অনেকক্ষন ধরে একসঙ্গে বাড়ি ফেরা -এসবের নামও কিন্তু স্কুল।
স্কুল নতুন করে খুললেও যে সব পড়ুয়া স্কুলে ফিরবে এমনটা নয়। যেসব জায়গায় স্কুল খুলেছে দেখা গেছে সেখানে ৪২% পড়ুয়া স্কুলে যেতে চাইছে না, কারণ স্কুলে যাওয়ার অভ্যাস তাদের ত্যাগ করেছে। এখন বাড়িতে শুয়ে বসে ক্লাস করতেই তারা অভ্যস্ত হয়ে গেছে!এছাড়াও দৈনন্দিন পড়াশোনা ও পরীক্ষার আশঙ্কায় তারা বিপন্ন, বিপর্যস্ত। চিরস্থায়ী স্কুলছুটের দলে নাম লেখানোর প্রতীক্ষায় তারা দিন গুনছে।যে প্রত্যয়ে কোভিড মহামারীর বিরুদ্ধে গোটা বিশ্ব এককাট্টা হয়ে লড়াই চালিয়েছে বা চালাচ্ছে সেই দৃঢ় প্রত্যয়ই শিশু-কিশোর-কিশোরীদের লেখাপড়ার মুলস্রোতে ফেরানোর চাবিকাঠি। কেবল ওষুধ পথ্য নয়, কমবয়সী পড়ুয়াদের সমব্যথী হওয়াটাও সমান জরুরি। দেখা গেছে কোভিড কালবেলায় প্রাপ্তবয়স্কদের প্রায় সব কৃতকর্মের দায়ভার এসে বর্তেছে শিশুদের উপর। বড়দের সঠিক কোভিডবিধি মেনে চলাই সুরক্ষিত রাখতে পারত শিশুদের।সেই কোভিডবিধি পালনে চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছেন বড়রা। তার ফল ভুগতে হয়েছে শিশুদের। ভ্যাকসিন প্রথমেই বরাদ্দ হয়েছে প্রাপ্তবয়স্কদের জীবনদানে।শিশুরা থেকে গেছে ব্রাত্য। আজ ভ্যাকসিনের তাড়া খেয়ে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত করছে শিশুদের। আগস্টের আমেরিকায়, একলাফে ২২% শিশু সংক্রমণ বৃদ্ধি তারই অশনি সংকেত। ৫-১৮ বছর বয়সীদের ভ্যাকসিনের ট্রায়াল বিশ্বের কোথাও যথাবিধি মেনে হয়নি, কারণ ট্রায়ালে অগ্রাধিকার পেয়েছেন বয়স্করা। আগামী বিশ্বের জন্য কাদের বাঁচা বেশি জরুরি - এখন কোভিডের তৃতীয় ঢেউয়ের সামনে দাঁড়িয়ে যখন শিশুরা আক্রান্ত, তখন এই প্রশ্ন উঠছে। একদলের মত এই যে প্রথমে বড়দের সুরক্ষিত রেখে, আসলে শিশুদেরই সুরক্ষিত করা হয়েছে। গন্ডগোল হয়েছে অন্য জায়গায়, আসলে যে গতিতে বড়দের পুরো জনসংখ্যাকে ভ্যাকসিন দেওয়ার দরকার ছিল, ভ্যাকসিন প্রক্রিয়া সেই গতি রক্ষা করতে পারে নি। ভ্যাকসিন চলেছে গদাই লস্করি চালে। ফলে আজ শিশুরা বিপদের তালিকায় উঠে এসেছে। এর মধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে ম্যাকিনসে-র সাম্প্রতিক রিপোর্ট। সেখানে বলা হয়েছে খোদ আমেরিকাতেই কিন্ডারগার্টেন থেকে বারো ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা বিজ্ঞানে পাঁচ মাস ও অন্যান্য বিষয়ে চার মাস পিছিয়ে রয়েছে। এই অসমাপ্ত লেখাপড়ার কারণে পড়ুয়ারা ভবিষ্যতে কম রোজগার করবে। এর ফলে মার্কিন অর্থনীতিতে বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১৮৮ বিলিয়ন ডলার। তড়িঘড়ি স্কুল খুলে, পড়াশোনা চালু করেও এই বিপুল ক্ষতি সামাল দেওয়া কার্যত অসম্ভব। এই "আনফিনিশড লার্নিং"-এর ক্ষত মেরামতে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপাতে হবে। শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, শিক্ষা প্রশাসক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক সবাইকে মাঠে নামতে হবে এই ক্ষত মেরামত করতে গেলে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই ক্ষত মেরামতে আনতে হবে বিশেষ উপযোগী "লার্নিং এপ"। যা কাজে লাগাতে হবে অসম্পূর্ণ শিক্ষাকে সম্পুর্ন করতে। মার্কিন সরকার অসম্পূর্ণ শিক্ষার কৃষ্ণগহ্বর থেকে শিক্ষাকে টেনে বের করে আনতে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ২০০ বিলিয়ন ডলারের "আমেরিকান রেসকিউ প্ল্যান" চালু করেছেন। এছাড়াও ঠিক হয়েছে শিক্ষার মানোন্নয়নে আরও ৭৫০ বিলিয়ন ডলার প্রতি বছর ব্যয়িত হবে। আমেরিকা লড়াই শুরু করেছে, আমরা কি করছি? আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার "মনিটাইজেশন পাইপলাইন"-এর মৌতাতে মজে আঁচই করতে পারছেন না যে ভারতেও পড়ুয়াদের এই অসম্পূর্ণ শিক্ষার ক্ষতির মাশুল গুনতে গোটা দেশটাকেই একদিন বন্ধক রাখতে হবে।
সামনেই শীতকাল আসছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন ইনফ্লুয়েঞ্জা আর কোভিডের "টুইনডেমিক"-এর প্রভাবে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা বাড়বে শিশুদের। তাই এক্ষুনি স্কুল খোলা নিয়ে সিদ্ধান্ত স্থির করা মুশকিল।তাই আপাতত "টু বি অর নট টু বি"- হ্যামলেট-এর এই দ্বিধা, সংশয়ই স্কুলের ভবিতব্য।