এতদিনে হয়ত সবাই জেনেছেন, যে, হঠাৎ কলকাতার প্রথম এফ এম সম্প্রচারের চ্যানেল ১০৭ মেগাহার্টজ, যা বর্তমানে এফ এম রেনবো, তার এফ এম সম্প্রচারের ঐতিহাসিক সাফল্য ও ঐতিহ্যের ধরণ পাল্টে, গীতাঞ্জলি চ্যানেলের সাথে মিশে যেতে চলেছে। এই পটপরিবর্তনের সম্পূর্ণ চেহারা এখনও অস্পষ্ট। যেটুকু বোঝা যাচ্ছে, তাতে মনে হয়, প্রথমতঃ এতে সামগ্রিকভাবে সদস্যদের কাজের সুযোগ ও পরিমাণ কমার আশু আশংকা আছে, কেন না, দুটি চ্যানেল মিশে গেলে এয়ারটাইম কমতে বাধ্য, দ্বিতীয়ত, চ্যানেলের এই চরিত্রবদল সদস্যদের অনেকেরই জীবনের দীর্ঘ সময়ের অনেক পরিশ্রমের ফলে বেতারের যে জনপ্রিয়তা ফিরে আসার ইতিহাস, তাকে ম্লান ও ক্রমে বিলুপ্ত করে দিতে পারে। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে অস্বাভাবিক দ্রুত।
সেটা ছিল ১৯৯৬ সালের জানুয়ারি মাস।
আকাশবাণী কলকাতা বেতারের এফ এম চ্যানেলে "টক শো" অনুষ্ঠানে নিয়মিত অস্থায়ী উপস্থাপক হিসেবে কাজ করার সুযোগ এল একঝাঁক তরুণ-তরুণী এবং বিশিষ্ট বিদ্বজ্জনের কাছে। তখন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া রেডিয়োর পুনর্জন্ম ঘটল যেন। এফ এম চ্যানেলের তদানীন্তন প্রোগ্রাম এক্সিকিউটিভ ছিলেন স্বাতী দাস চট্টোপাধ্যায়। এর আগে ছিল কলকাতা-ক, বিবিধ ভারতী, কলকাতা-খ ইত্যাদি। অনুরোধের আসর, ছায়াছবির গান, গীতিনাট্য, বেতার নাটক, মন চাহে গীত, ছায়াগীত এসব অনুষ্ঠানের সময় নির্ঘন্ট একেবারে ঠোঁটস্থ ছিল শ্রোতাদের। কিন্তু টিভির বাক্স শ্রোতাদের করে তুলেছিল দর্শনপ্রিয়, রেডিয়ো তখন আর্কাইভে। সেসবের মধ্যে এই "এফ এম" ব্যাপারটা মেট্রো সিটিতে আনকোরা নতুন।
তারপর ১৯৯৬ থেকে শুরু হল আকাশবাণী কলকাতার ১০৭ মেগাহার্তজ এফ এম চ্যানেলে ‘লাইভ’ ফোন-ইন বাংলা টক শো। সংস্কৃতিসচেতন মানুষের কাছে টাটকা বাতাস, বিনোদনপ্রিয় মানুষের কাছে খোলা হাওয়া।
শুরুর দিকে সবাই আকাশবানীর নাটক বিভাগ থেকে এফএমে প্রোগ্রাম করা আরম্ভ করেছিলেন। বেতার নাটকের অভিনেতা অভিনেত্রীদের দিয়েই শুরু হয়েছিল "কলকাতা এফএম" এর বাংলা টক শো অনুষ্ঠানের পথ চলা। সেই সময় উপস্থাপক-শিল্পী তালিকায় ছিলেন স্বরাজ বসু, উমা বসু, ঋতা দত্ত চক্রবর্তী, রমাপ্রসাদ বণিক, ঝিলিমিলি চক্রবর্তী, ঊর্মিমালা বসু, অলক রায় ঘটক, সুমিতা বসু, সৌমিত্র বসু, মুরারি চক্রবর্তী, কেতকী দত্ত, অঙ্গনা বসু, সৌম্যদেব বসু, বিপ্লব চক্রবর্তী, গৌরীশঙ্কর পাণ্ডা, অরুণ মুখোপাধ্যায়, অনুপ ঘোষ, অমিত রায়, সুরঞ্জনা দাশগুপ্ত, সুকৃতী লহরী, গার্গী রায়চৌধুরী... এইরকম বহু বিশিষ্ট মানুষজন।
পরবর্তীকালে এফএম-এর জন্য আলাদা করে অস্থায়ী উপস্থাপক পদের জন্য লিখিত এবং মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হল। ১৯৯৭ সাল থেকে অডিশন দিয়ে পাশ করে পাকাপাকি ভাবে অস্থায়ী উপস্থাপক হয়েছিলাম আমরা অনেকেই। ঋচা সরকার, শর্মিষ্ঠা গোস্বামী, সিদ্ধার্থ দাশগুপ্ত, শোভন চক্রবর্তী, বিদিশা রায়, পূর্বাশা রায়, কেয়া মুখোপাধ্যায়, কৃষ্ণা কুমার, প্রবাল মল্লিক, সুপ্রিয় রায়, শিবাশিস মুখোপাধ্যায়, কেয়া দে তখন অসাধারণ সব অনুষ্ঠান উপহার দিচ্ছেন শ্রোতাদের। তখন গোটা কলকাতার বুকে একটিই মাত্র এফএম চ্যানেল,আকাশবানী এফ এম। মানুষের তখন এফএমকে ঘিরে প্রবল উন্মাদনা। আমরা উপস্থাপক-উপস্থাপিকারা তখন জনমানসে সেলিব্রিটি হয়ে ওঠার উত্তেজনা রীতিমত টের পাচ্ছি।
কলকাতা আকাশবাণী বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য। এফএম রেইনবো কলকাতা আকাশবাণীর প্রথম এফএম চ্যানেল, শুধু তাই নয় বাংলা ভাষার প্রথম এফএম চ্যানেলও। শ্রোতাদের সঙ্গে প্রথম ফোন-ইন অনুষ্ঠান, লাইভ পুজো কভারেজ, বইমেলা লাইভ কভারেজ, এছাড়াও নানান ভাবে সরাসরি শ্রোতাদের রেডিও বা এফএম রেডিওর সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার কাজটা এফএম রেইনবোই করেছিলো সবার আগে। হারিয়ে যেতে থাকা বেতারের জনপ্রিয়তাকে ফিরিয়েএনেছিলো সেদিনের এফএম রেইনবো। এই বাংলার প্রায় সমস্ত গুণিজন, সাহিত্যিক, গায়ক, গায়িকা, শিল্পী বিভিন্ন সময়ে সরাসরি স্টুডিওতে বা ফোনে অংশ নিয়েছেন।
পরবর্তীতে আকাশবাণীর আরও একটি এফএম চ্যানেল এল, তখন প্রথমটিকে বলা হতো এফএম ১ এবং দ্বিতীয়টি এফএম ২।
আমরা দুটি চ্যানেলেই চুটিয়ে অনুষ্ঠান করতাম।
তারও বেশ কিছুকাল পরে এফএম ১এর নামবদলে হলো এফএম রেইনবো এবং এফএম ২ এর নাম হলো এফএম গোল্ড।
ততদিনে রৈ রৈ করে বেশ কিছু বেসরকারি এফএম চ্যানেল এসে গেছে কলকাতায়, রীতিমত হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে প্রাত্যহিক স্বাস্থ্যকর প্রতিদ্বন্দ্বিতা বজায় রেখেছিলাম আমরা।
যে চ্যানেলটা মানুষকে বিশুদ্ধ বাংলা ভাষায় বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলতে শিখিয়েছিল, শিখিয়েছিল আচরণ, শিখিয়েছিল ভাবতে, গড়ে তুলেছিল মননশীল চেতনা এবং সর্বোপরি যে চ্যানেলটা অন্য সব এফএম চ্যানেলের জনক, সে আজ ফসিল। এত কাজ, এত গবেষণা, এত শব্দ, এত বাক্য সব হাওয়ায় মিশে গেল। কিছুই পড়ে রইল না আর!
করোনার মধ্যেও আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে "লাইভ" করে এসেছি.... বড়রা শিখিয়েছিলেন, দ্য শো মাস্ট গো অন, কারণ আকাশবাণী মানে বহুজন সুখায়, বহুজন হিতায়। শুধু বিনোদন নয়, বিনোদনের পাশাপাশি সমাজের প্রতি দায় থাকে আমাদের, সে দায়বদ্ধতা শিখতে শিখতে পেরিয়ে এলাম ২৫ বছর। আমাদের জীবনের গোল্ডেন পিরিয়ড।
হ্যাঁ আমরা বিশুদ্ধ বাংলায় টানা ২ ঘন্টা "লাইভ টক শো" শুনে এবং পারফর্ম করে বড় হওয়া প্রজন্ম।
আমরা শুদ্ধ উচ্চারণ শিখেছি, আমরা স্পষ্ট উচ্চারণ শিখেছি, আমরা অনর্গল শুদ্ধ বাংলায় টানা দু'ঘন্টা "লাইভ" কথা বলতে শিখেছি। সকালের রাগ বা ভোরবেলার গান রাতে না বাজাতে শিখেছি....
বিষয় হতে পারে "ক্লোনিং" কিংবা "বনফুলের শতবর্ষ", হতে পারে “মদনমোহনের জন্মদিন পালন” বা “বইপাড়ার সাতকাহন”, হতে পারে “শান্তিনিকেতন আশ্রম তৈরির গোড়ার কথা” বা “মহাভারতের একটি করে চরিত্র নিয়ে”, “যামিনী রায়ের শিল্পভাবনা” বা “ত্রৈলোক্যনাথের রচনার রস”, হতে পারে "আমার প্রিয় শিক্ষক" বা "কথায় সুরে কন্ঠ ভরে", “ভোরাই আজ রাতে আলাপন.....” দিনের যে কোনও সময়, যে কোনও বিষয়। মোট কথা যে কোনও কিছু হতে পারে। যদি অকালে চলে যান কোনও সেলেব, সেই মুহূর্ত থেকে আকাশবাণীর এফ এম চ্যানেলের তরুণ তুর্কীরা আধিকারিক এবং সহউপস্থাপকদের সহযোগিতায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে "লাইভ" টক শো-তে। শুরু করেছে স্মরণ অনুষ্ঠান। লাইভ ফোন ইন প্রোগ্রামে যোগ দিতেন সাধারণ শ্রোতা, বিদগ্ধ গুণিজন।
ও, যেসব বিদগ্ধ বিশিষ্ট গুণিজনের ইন্টারভিউ নিয়েছি, তার ছবি নেই। আমরা কেউ কোনও প্রমাণ দেখাতে পারব না। নিষেধ ছিল আকাশবাণীর স্টুডিওতে ছবি তোলা। ২৫ বছর কম কথা নয়। সামান্য কিছু রেকর্ড করা রয়েছে ব্যক্তিগত উদ্যোগে। সব কিছু পাবলিক করে নাম কুড়োতে শিখিনি। তা-ই কী কাজ করেছি আমরা, কীভাবে করেছি... আজ আর আমরা না-ই বা বললাম।
বই কিনে, বই পড়ে, নিজেদের ঋদ্ধ করে প্রতি মুহূর্তে বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার কাজ করেছি আমরা। হ্যাঁ আমরাই। আমাদের প্রতি মুহূর্তে সহযোগিতা করেছেন নেতৃত্ব দিয়েছেন যারা, তাঁরা সরকারি আধিকারিক হলেও বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতিকে আগলে রাখার দায় তাঁদেরও ছিল। তাঁদের নেতৃত্বে আমাদের বেড়ে ওঠা, বড় হয়ে ওঠা। যেদিন থেকে প্রাইভেট এফ এম চ্যানেলে ইংরেজি বাংলা হিন্দি মেশানো জগাখিচুড়ি ভাষা ঢুকল, টক শো-র নামে শুরু হল অবিশ্রান্ত অর্থহীন বাচালতা, একের পর এক হিন্দি চটুল গানে ভরে গেল চারপাশ, বাংলা সংস্কৃতিকে ক্রমশ কোনঠাসা করার পরিকল্পনা সেদিন থেকেই শুরু।
প্রসারভারতীর পক্ষ থেকে একবার এরকম একটা সার্কুলার এসেছিল যে, যে-সমস্ত উপস্থাপক-উপস্থাপিকার বয়স 35 বছর পার হয়ে গেছে, তাদেরকে বাদ দিয়ে দেওয়া হবে। সেবার আমরা বেশকিছু সহমর্মি বন্ধু অডিও ভিজুয়াল মিডিয়াকে কে সঙ্গে নিয়ে সারা ভারত জুড়ে আন্দোলন শানিয়েছিলাম,- জাতীয় স্তরের সর্বভারতীয় চ্যানেলগুলিও আমাদের আন্দোলনের শরিক হয়েছিল সেবার, তার ফলে রাতারাতি পিছু হঠতে এবং সিদ্ধান্ত আর নীতি নিয়ম আমূল বদল করতে বাধ্য হয়েছিল তৎকালীন ভারত সরকার। তদানীন্তন প্রসারভারতীর সর্বময় কর্তা নিজের নির্দেশ প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন সাত তাড়াতাড়ি,- সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে আমাদের জয় হয়েছিল।
উল্লেখ্য, গত মে মাসেই আরও একটি বড় পরিবর্তনের সাক্ষী হয়েছে আকাশবাণী। সরকারি সংস্কারে ইতিহাসের পাতায় স্থান নিয়েছে বহুদিন ধরে চলে আসা একটি রীতি। বদলে গিয়েছে সরকারি রেডিও-র নাম। 'দিস ইজ অল ইন্ডিয়া রেডিও...', গত মে থেকেই অতীত এই পরিচয়। মোদী সরকারের সিদ্ধান্তে নাম থেকে ছেঁটে ফেলা হয় এআইআর । অল ইন্ডিয়া রেডিও-এর বদলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেওয়া আকাশবাণী নামটিকেই মান্যতা দিয়েছে কেন্দ্র। তাই অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো আর নয়, সেদিনের পর থেকে আকাশবাণী বলেই সরকারিভাবে সমস্ত ক্ষেত্রে স্বীকৃত সরকারি রেডিও স্টেশন। এআইআর নামটি এখন শুধুই নস্ট্যালজিয়া। সেই হারিয়ে যাওয়া সম্পদের তালিকা ক্রমশই হচ্ছে লম্বা। এবার তাতে সর্বশেষ সংযোজন রেডিও-এর বিপ্লব এফএম রেনবো।
এফএম রেইনবোতে একশোরও বেশী অস্থায়ী উপস্থাপক এবং উপস্থাপিকা রয়েছেন। যঁদের অনেকেরই উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম রেডিও। এফএম রেইনবো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বলা ভালো প্রাইমারি চ্যানেল গীতাঞ্জলির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কয়েক হাজার মানুষ এবং এফএম রেইনবোকে ভালোবাসেন এমন লক্ষ লক্ষ শ্রোতা।
প্রায় একশো জনের বেশী ক্যাজুয়াল প্রেজেন্টার এফএম রেইনবো আর এফএম গোল্ডের সঙ্গে যুক্ত। যদিও তাদের হয়ত অন্য কোনও ভাবে উপস্থাপনার কাজে যুক্ত করে নেবেন আধিকারিকরা, তবুও আগামীর জন্যে অনেকটা চিন্তা রয়ে গেল কিন্তু।