আমাদের সম্পাদক কদিন হল চুপ মেরে গ্যাচে। সন্ধ্যার আসরটিও জমচে না। ইয়ার বক্সি কম পড়েচে। ব্যাপারখানা কী? শুধোতে বল্লে, সময় বড় খারাপ। পকেট কেবল খালি হচ্চে।
শুনে পেত্যয় হয় না। সম্পাদকের পাঁচো ইয়ার নিয়ে মদ গেলা ভিন্ন খরচ আচে বলে বদনাম কত্তে পারবেন না। বন্যা, খরা, মহামারী, গরীবের কন্যাদায়, আপিসের পিওনের ছেলের চিকিচ্ছে --- কোথাও একটি পয়সা দান করেন না। পুজো আচ্চায় নেই, সোনাগাজী যান না, বারকতক বিশ বচ্ছরের কন্যাটির দিব্যি কেটে বলেচেন শহরতলিতে কেনা মেয়েমানুষও নেই (তবে নিন্দুকের মুখ বন্ধ করে কে? তিনি বলে বেড়াচ্চেন সম্পাদকের বয়েস গিয়েচে তাই চরিত্র এসেচে। তবে আপিসটি যাতে কচি সুন্দরীতে ভরে থাকে সেটি ঠিক খেয়াল রেখেচেন৷ দেখেও সুখ ইত্যাদি)। তালে আর খরচ কিসে?
সম্পাদক ব্যাজার মুখ করে বল্লে, কিচুই খবর রাখেন না দেখচি। তাই নকশায় ফালতু লোকেদের মিছিল বাদে লেখার কিচু পান না। শেয়ার বাজারের হাল কী জানেন? বাজার পড়চে তো পড়চেই। আমার ইনভেস্টমেন্টের বারোটা বাজচে। আপনার আর কী? হাওয়ায় হাওয়ায় কেটে যাচ্চে। আমার দুখখু আর আপনি কী বুজবেন? সম্পাদক নেহাত গোবেচারা মানুষটি নয়, তবে আমার কাচে কিচু গোপন করে না। তাই তার কাঁদুনি শোনা কর্তব্য হয়। ভর সন্ধ্যাবেলা বেয়ারাকে সোডা, গেলাস আর চিকেন পকোড়ার বদলে চা দিতে বলে সম্পাদক শুরু কল্লে।
গিন্নী জন্মদিনে নূতন গাড়ির আবদার করেচিলেন। সম্পাদক শেয়ারে বেজায় লোকসান হওয়ায় যোড়হাতে প্রার্থনা কল্লে আপাতত ক্ষ্যামা দেয়া হোক, গাড়িটি বিবাহবাষ্যিকীতে হবে। এ সওয়ায় কন্যা আইফোনের নতুন মডেলটির কড়ার দিলেন। বাপের বিয়ের সিলভর জুবিলি তো আর ফি বচ্ছর আসে না। তা বাদে লেটেস্ট আইফোন এদানী রাম শ্যাম যদু মধু সক্কলেরই আচে। কিটি পার্টিতে পুরাতন মডেলটি নিয়ে গিয়ে গর্ভধারিণীর বেইজ্জতি লেকাপড়া জানা কন্যা সইতে পারবেন না।
সম্পাদক গিন্নীকে স্যামসাঙে রাজি করিয়ে ফেলেচিলেন, মধ্যখান থেকে সব মাটি করে দিলেন লোভন চাটুজ্জে। টিভিতে পরের বউয়ের প্রতি তেনার কমিটমেন্ট দেখে গিন্নী সন্দেহ কল্লেন ইকোনমি বেহাল, কাগচ ধুঁকচে, শেয়ারে লোকসান --- সব বাজে কথা। আসলে কত্তাটির ডবকা মেয়েমানুষ জুটেচে। তেনার ফেশিয়াল, মেনিকিওর, পেডিকিওর আর লঞ্জারিতেই বাবু টাকা ওড়াচ্চেন। সম্পাদক যত বলেন লোভনবাবুর টাকা আচে পাওয়ার আচে মেয়েছেলে টানার, আমার কেবল ভুঁড়ি আচে, গিন্নী আমল দেন না। তিনি কন্যা সহযোগে বাপের বাড়ি গিয়ে উঠলেন।
আমার নিজের জাঙিয়া না কিনতে পাল্লে ভাল হয়, আমি নাকি গার্লফ্রেন্ডের জন্যে লঞ্জারি কিনচি। বুঝুন কাণ্ড! সম্পাদক বিলক্ষণ দুফোঁটা চোখের জল ফেলে বল্লে।
তার দুখখু দেখে হুতোমের পাষাণ হৃদয়েও যে দু এক ঢেউ না উঠল তেমন নয়। পিঠে হাত রেখে বল্লেম, ভায়া এমন শোকের সময় মদ বাদে চা খাওয়া যে! বিস্কুট অবধি নেই? বিস্কুট! সে আঁতকে উঠলে। পাল্লে বিস্কুট ছেড়েই দিতুম। চেষ্টা করচি, এখনো খেয়ে ফেলি এক আধটা। কারখানাই থাকবে না তা পাব কোথায় যে খাব?
বিস্কুটের কথায় কারখানা চলে এল দেখে ভাবলেম গিন্নীর শোকে সম্পাদক ট্রেড ইউনিয়ন লিডার হবার রঙ্গ কচ্ছে বটে, তবে একটু দাবড়ে দিলেই সিধে হয়ে যাবে। তা দাবড়ানোর আগেই সে বলে, অবিশ্যি কোন কারখানাই বা বন্ধ হচ্চে না? কিচু তো সরকার বাহাদুর নিজেই বন্ধ করে দিচ্চেন, বাকি মালিকরা কপালে হাত ঠেকিয়ে ভারতমাতা কি জয় বলে তালা ঝুলিয়ে দিচ্চেন। ভাবচি কবে আমাকেই মালিক না বিদেয় করেন। বল কী হে? এমন হাঁড়ির হাল নাকি? তা কজন পথে বসলে এ কদিনে?
কয়েক লক্ষ হবেই। তবে কিনা সক্কলে কি আর পাকা চাকুরি কচ্ছিল? ঠিকে কাজের লোকই বেশি। পাকা চাকুরির বাবু বিবিদের পালা সবে শুরু হয়েচে।
আজব! কয়েক লক্ষ লোকের ভিটেমাটি নিয়ে টানাটানি, এদিকে কাগচে টুঁ শব্দটি নেই, টিভিতে কেবল লোভন চাটুজ্জে আর ফাঁকি বাঁড়ুজ্জের ইন্টারভিউ চলচে!
হুতোমের হয়রান মুখ দেখে সম্পাদক এত শোকের মধ্যেও হেসে গড়াগড়ি। বলে, সে যুগে আপনি বিলক্ষণ তালেবর ছিলেন। কিন্তুক এ যুগে দুধের শিশু। চাকুরি নেই, বাণিজ্য নেই ওসব কেউ দ্যাকায় নাকি? সরকার বাহাদুর সম্পাদককে জেলে ভরে দেবেন না? ভাল ভাল খবর দ্যাকাতে হবে। টিভিতে কাশ্মীর দেখচেন না? কেমন বউভাতের পরদিনের বাড়ির মতন সুনশান পথঘাট দেখিয়ে বলচে ওখানে নাকি লোকে মোচ্ছব কচ্ছে? অমনটি না বল্লে সরকার বাহাদুর যাবি আয় কোম্পানি পাঠিয়ে দেবেন বাসায়। কোন পুরাতন মামলায় যে কোন হাজতে পুরবেন তার হদিশ ভগবানও পাবেন না।
এ সরকার না ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রে বাপু! লোকে কী করবে তালে? মিউটিনি?
শুনে সম্পাদক আরেকটিবার গড়াগড়ি খেলে। মিউটিনি! কোন যুগে আচেন খুড়ো? অসমিয়া বাঙালিরে দেখতে পারচে না, হিঁদু মোছলমানে সাত জম্মের শত্তুর ভাবচে, বামুন কায়েতরা নিচু জাতের মড়া তেনাদের জমিনের উপর দিয়ে যেতে দেবেন না বলে এয়ারড্রপ কত্তে হচ্চে। এনারা করবেন মিউটিনি? সম্পাদকের বেয়ারা হুতোমের পরিচয়টি না জানলেও বোধ করি পোশাক আশাক দেখে ভদ্রলোক জ্ঞান করেন। তাই চায়ের পেয়ালা ফেরত নিতে এসে একটি চুমুকও দেয়া হয়নি দেকে বল্লেন, চা ভাল্লাগচে না? কফি দেব, বাবু? কিচু না বলতেই, দিচ্চি, বলে পেয়ালাটি নিয়ে সে গাইতে গাইতে প্রস্থান কল্লে:
বাবুর বোতল গেল পেয়ালা এল
শেয়ারে লোকসান
খবর গেল কেচ্ছা হল নূতন ফ্যাসান।
আচ্ছে দিনের কথা অমৃতসমান
সরকারে যা বলেন তাহাই সঠিক ব্যাখ্যান।