অনুপ্রবেশ নিয়ে, অর্থাৎ এই রাজ্যে ওপার বাংলা থেকে অনুপ্রবেশের এর বিষয়টি নিয়ে আগের দুই পর্বে দুটি দিক থেকে দেখানোর চেষ্টা করেছিলাম যে চিৎকারের সঙ্গে অঙ্কের হিসাব মিলছে না। প্রথম পর্বে, Total Fertility Rate এবং রাজ্যের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিয়ে কিছু প্রসঙ্গের অবতারণা করেছিলাম।
“ওপার বাংলা থেকে আসা কোটি কোটি অনুপ্রবেশকারীতে এই রাজ্য বা দেশের অন্যান্য অঙ্গরাজ্য ভরে যাচ্ছে”। এই যে স্থির প্রতিপাদ্য, এটাকে কেন্দ্র করে আমি কিছু উত্তর খুঁজতে চেয়েছি। আমার যুক্তি বা অপযুক্তি, যাই বলুন, তার বেশিরভাগটাই ২০১১ পর্যন্ত যে সমস্ত জনগণনা বা সেনসাস হয়েছিল তার ওপর ভিত্তি করে। এখন আমার সেই তথ্যভাণ্ডারের ওপর নির্ভরতার জন্য তিনটি আপত্তি তোলা যেতে পারে।
( ১) ‘সব নেহরুজীর দোষ’, এইরকম একটা বিশ্বাসে ভর দিয়ে ‘ওসব সেনসাস কংগ্রেসী জমানায় তৈরি”, ওতে ভরসা করা যায় না, এই ধরণের যুক্তি
(২) এই রাজ্যে অনুপ্রবেশ যা কিছু হয়েছে সবই ২০১১ এর সেনসাসের পর থেকে
(৩) ওই যেমন চ্যানেলে এসে প্রখ্যাত লেখিকা তিলোত্তমা মজুমদার নিদান দেন, “ওপার থেকে মুসলমানরা দলে দলে এসে এখানে হিন্দু নাম নিয়ে হিন্দু আচারব্যবহার অনুকরণ করে বসবাস করছে, তাই ধরা যাচ্ছে না”।
তিলোত্তমার যুক্তিটি অসাধারণ! এর পরে আর কথা হবে না।
অনুপ্রবেশ এর দ্বারা লক্ষ লক্ষ বা কোটি কোটি জনসংখ্যা বাড়ছে কিনা, তারজন্য আমরা তৃতীয় একটি মাপক বা প্যারামিটার ব্যবহার করতে পারি। বাংলা ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা। এটা আমরা ধরে নিতেই পারি, ওপার বাংলা থেকে দলে দলে যারা আসছেন, তাঁরা তো বাংলা ভাষাতেই কথা বলেন। না কি রোহিঙ্গা ভাষায়? না কি বার্মিজ ভাষায়? না কি চীনা ভাষায়? এখন এই অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে কারও কারও কথ্য বাংলা, চাটগাঁয় বা সিলেটের আঞ্চলিক ভাষা হতেই পারে, কিন্তু সেনসাসের তথ্য সংগ্রহের সময় তাঁরা বাংলা ভাষায় কথা বলেন, নিশ্চয়ই সেইভাবেই নথীভুক্ত হবেন।
২০০১ সালের সেনসাসে পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যা ছিল ৮.০২ কোটি, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১৭.৮৪। সেই বছরের সেনসাসে বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা ৬৮,২৫৯,৩৫৫। অর্থাৎ এই রাজ্যে বসবাসকারী প্রায়, ৮০,২০০,০০০ - ৬৮,২৫৯,৩৫৫ = ১১,৯৪০,২৫৯ জন বা ১ কোটির বেশি মানুষ বা প্রায় মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫ % বাংলা ব্যতীত অন্য ভাষায় কথা বলেন।
২০১১ এর সেনসাসে এই রাজ্যের মোট জনসংখ্যা ৯১,২৭৬,১১৫ জন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার প্রায় চার শতাংশ কমে ১৩.৮৪। সেই বছরের সেনসাস অনুযায়ী বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা ৭৮, ৬৯৮,৮৫২ । অর্থাৎ এই রাজ্যে বসবাসকারী ৯১,২৭৬,১১৫ - ৭৮, ৬৯৮,৮৫২ = ১২,৫৭৭,২৬৩ অর্থাৎ প্রায় ১ কোটি ২৫ লক্ষ মানুষ বা মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫ % মানুষ বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য ভাষায় কথা বলেন।
অর্থাৎ ১০ বছরের ব্যবধানে রাজ্যের মোট জনসংখ্যার বৃদ্ধি হয়েছে ১১,০৭৬,১১৫ বা এক কোটি দশ লক্ষ, এবং সেই সময় ব্যবধানে বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে ১০,৪৩৯,৪৯৭ বা এক কোটি সাড়ে চার লক্ষর কাছাকাছি। অর্থাৎ বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের সঙ্গে একেবারে সাযুজ্যপূর্ণ। এই তথ্য থেকে ২০১১ পর্যন্ত ওপার বাংলা থেকে দলে দলে মানুষ এখানে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসাবে বাস করছে, সেইটা প্রমাণ করা সমস্যার!
আর একটা থিওরি বাজারে ঘোরে। সেটি হল ওপার বাংলা থেকে দলে দলে মানুষ আসছে কিন্তু সবাই এই রাজ্যে না থেকে দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে, অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছে কাজের সন্ধানে। দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ বা ওড়িশার বিভিন্ন স্থানে বাংলাভাষী পরিযায়ী মানুষদের ওপর যখন রাষ্ট্রীয় দমন বা রাজনৈতিক আক্রমণ চলছে, তখনও আমাদের নগর কলকাতার মধ্যবিত্ত শ্রেণী নিজেদের প্রবোধ দিচ্ছি, এরা কেউ আদত বাঙালি নয়, সব ওপার বাংলার। ‘পরিযায়ী অনুপ্রবেশকারী’ কাজের সন্ধানে কোন কোন রাজ্যে চলে যেতে পারে? প্রথম পর্বেই পরিযান নিয়ে লেখার সময়েই লিখেছি, যে রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো তারা পরিযায়ীর গ্রহিতা। সেই হিসাবে আমি নীচের সারণীতে (১ নং সারণী ) চারটি বিশেষ রাজ্য নিয়েছি যেখানে কাজের সন্ধানে বেশি মানুষ পাড়ি জমায়।
সারণী -১
|
রাজ্য |
বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা |
বৃদ্ধি |
|
|
|
২০০১ |
২০১১ |
|
|
দিল্লি |
২০৮৪১৪ |
২১৫৯৬০ |
৭৫৪৬ |
|
মহারাষ্ট্র |
৩১০১৩৭ |
৪৪২০৯০ |
১৩১৯৫৩ |
|
গুজরাট |
৪০৭৮০ |
৭৯৬৪৮ |
৩৮৮৬৮ |
|
কর্নাটক |
৪১২৫৬ |
৮৭৯৬৩ |
৪৬৭০৭ |
এর পাশাপাশি আমরা কয়েকটি তথাকথিত শিল্পোন্নত রাজ্য বা পরিযায়ী গ্রহিতা রাজ্যের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দেখব এবং পরিযায়ী মানুষের সংখ্যা নিয়ে দেখতে পারি ।
১. দিল্লিতে ২০০১-২০১১ এই ব্যবধানে মোট জনসংখ্যা বৃদ্ধি তিরিশ লক্ষের কিছু বেশি । বৃদ্ধির হার প্রায় ২০ শতাংশ । এই সময়কালে দিল্লিতে প্রায় তিন লক্ষ পরিযায়ী এসেছেন ।
২. গুজরাটে, ২০০১ আর ২০১১ এই ব্যবধানে জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রায় ১ কোটি। বৃদ্ধির হার প্রায় ১৯.২ শতাংশ । এই সময়ের মধ্যে গুজরাটে কাজের সন্ধানে এসেছেন প্রায় সাড়ে ছ লাখ মানুষ।
বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীরা যদি পশ্চিমবঙ্গ হয়ে দিল্লি বা গুজরাটে গিয়ে থাকেন তাহলেও তাদের ধরা আছে এই তিন লক্ষ বা সাড়ে ছয় লক্ষ পরিযায়ীর মধ্যেই। অন্যদিকে এই সময়ের মধ্যে গুজরাটের জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে প্রায় এক কোটি (সঠিক সংখ্যা ৯৮,৬৭,৬৭৫)। আমরা যদি কাজের প্রয়োজনে গুজরাটে আসা মানুষদের (যার একটা অংশ বেআইনি অনুপ্রবেশকারী বলে লোকের বিশ্বাস) বাদ দিয়েও ২০০১ থেকে ২০১১ এঁর মধ্যে গুজরাটের জনসংখ্যাবৃদ্ধি হিসেব করি তাহলে তা দাঁড়ায় ১৮.১৯% যা গুজরাটের প্রকৃত জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের (১৯.২৮%) এর থেকে কম হলেও ২০০১ -২০১১ সাময়কালে ভারত (১৭.৭%), পশ্চিমবঙ্গ ( প্রায় ১৪% ) এবং আসাম (১৭.০৭%) -- এর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের থেকে বেশী। দিল্লির ক্ষেত্রেও হিসাবটা প্রায় অনুরূপ অর্থাৎ ভারতের এবং এই রাজ্যের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের থেকে বেশি। এই হিসাবের পাশাপাশি আমরা ওই একই সময়কালে রাজ্যগুলিতে বাংলাভাষীর সংখ্যা বৃদ্ধির হিসাবটা নেব।
দুটি শিল্পোন্নত রাজ্যের অর্থাৎ যাদের পরিযায়ী গ্রহিতা হিসাবে ধরে নিতে পারি তাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি , পরিযায়ী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা ইত্যাদি দিয়ে কিন্তু ‘ওপার বাংলা থেকে আসছে আর দিল্লি , গুজরাট ইত্যাদি রাজ্যে চলে যাচ্ছে’, এই বিশ্বাসের সমর্থনে তেমন জোরালো যুক্তি পাওয়া যাচ্ছে না।
ভারতীয় জনগণনা পরিসংখ্যান ব্যবহার করে দেখার চেষ্টা করেছি কোন রাজ্যে কতজন মানুষ আছেন যাদের মাতৃভাষা বাংলা। যেমন গুজরাটে ২০০১ সালে বাংলাভাষী লোক ছিলেন ৪০,৭৮০ আর ২০১১ তে এই সংখ্যা বেড়ে হয় ৭৯,৬৪৮। অর্থাৎ, ২০০১ থেকে ২০১১ এঁর মধ্যে গুজরাটের জনসংখ্যায় বাংলাভাষীর সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৪০,০০০। মনে রাখতে হবে, এই ৪০,০০০ এর মধ্যে তিন ধরণের লোক আছেন – পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা বাঙালি, বাংলাদেশ থেকে আসা বাঙালি আর গুজরাতে বংশানুক্রমে বাস করা প্রবাসী বাঙ্গালি। এখন ৪০,০০০ এর মধ্যে কতজন বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী এটা বলা সম্ভব নয়। কিন্তু অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা কোনভাবেই ৪০,০০০ এর বেশী হতে পারে না। অর্থাৎ, ৪০,০০০ হল ২০০১-২০১১ এঁর মধ্যে বাঙ্গালি অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যার ঊর্ধসীমা। আসলে অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা এর থেকে কমই হবে। ২০০১ থেকে ২০১১, এই ১০ বছরে গুজরাটের জনসংখ্যা বেড়েছে ৯৮,৬৭,৬৭৫। অর্থাৎ ২০০১-২০১১ এই সময়কালে, গুজরাটের জনসংখ্যাবৃদ্ধিতে বাংলাভাষীদের অবদান মাত্র .০৬%। ২০০১-২০১১ মধ্যে গুজরাটের বাংলাভাষীদের সংখ্যাবৃদ্ধি যদি অনুপ্রবেশের জন্য হয় তাহলেও মোট জনসংখ্যা বৃদ্ধির নিরিখে তার অনুপাত খুবই সামান্য। আমি গুজরাট এর উদাহরণ দিলাম , কিন্তু সারণীতে দেওয়া বাকি রাজ্যগুলিও হিসাব করতে পারেন। এই হিসাবে আমার ধরা চারটি রাজ্যের মধ্যে মহারাষ্ট্রে সামান্য বৃদ্ধি ছাড়া অন্য কোথাও, মানে যে রাজ্যগুলি কাজের সুযোগের নিরিখে খুবই আকর্ষণীয়, সেই সেই রাজ্যে বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা দিয়ে অনুপ্রবেশের তত্ত্বটাকে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না।
তাহলে কী দাঁড়ালো ? পশ্চিমবঙ্গের প্রোজেক্টেড ১০ কোটির কিছু বেশি জনসংখ্যার প্রায় পৌনে ন কোটি বাংলা ভাষায় কথা বলেন আর ১ কোটির কিছু বেশি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য ভাষায় কথা বলেন। মনে রাখতে হবে এই এক কোটির কিছু বেশি মানুষের মধ্যে অনেক ভাষার মানুষ আছেন পশ্চিমবঙ্গে যাদের বসবাস প্রায় তিন চারশো বছর ধরে (যেমন মাড়ওয়ারি সম্প্রদায়ের মানুষেরা যাঁদের পূর্বপুরুষেরা বহু বছর আগেই বাংলাতে চলে এসেছিলেন)। অন্যদিকে বর্তমানে ( প্রোজেক্টেড) ভারতের মোট বাংলা ভাষীর সংখ্যা প্রায় ১১ কোটি যার মধ্যে ৯ কোটিই পশ্চিমবঙ্গে। তার মানে প্রায় দুকোটি বাংলাভাষী পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থাকেন। মনে রাখতে হবে এঁর মধ্যে বহু বছরের প্রবাসী বাঙ্গালিরাও আছেন , যেমন দিল্লি , উত্তর প্রদেশ এর বেনারস , বিহারের ভাগলপুর, পূর্নিয়া, কাটিহার, রাঁচি, মুম্বাইয়ের বাঙালি, পুরুলিয়া সংলগ্ন ঝাড়খণ্ড, ইত্যাদি।
আন্তঃরাজ্য পরিযান একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এবং যেখানে উপার্জনের সুযোগ বেশী মানুষ সেখানেই যেতে চাইবেন। বহুবছর ধরেই এমনটাই ঘটছে। সেদিক থেকে দেখলে ১৪৬ কোটির একটি দেশে (২০২৫ এর প্রোজেক্টেড) যদি ২ কোটি বাংলা ভাষী পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থাকেন, তা কোনভাবেই অস্বাভাবিক নয়, কেননা তার বেশিরভাগটাই প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাংলার বাইরে বাস করে আসছেন। বেআইনি অনুপ্রবেশের হিসাব কিন্তু মিলছে না। বিশেষত যেখানে কাজের সু্যোগহীন বলে পরিচিত পশ্চিমবঙ্গে ১ কোটি অ-বাংলাভাষী থাকছেন। হিসাব মেলাতে হলে মেলাতে হলে SIR এর ভাঁওতাবাজি ছেড়ে সেনসাস পুনরায় চালু করতে হবে।
অবৈধ অনুপ্রবেশ, ঘুসপেটিয়া ইত্যাদি বলে যেসকল জাতীয়তাবাদীরা লাফালাফি করছেন, তাঁদের উচিত জাতীয়তাবাদী কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবী রাখা, অবিলম্বে মুলতুবি রাখা সেনসাস চালু করুন।
এর পরের পর্ব ‘হাকিমপুর সরগরম’
এই লেখার সমস্ত তথ্যই ভারতীয় জনগণনা পঞ্জী ওয়েবসাইট এবং U.N. Dept. of Economic and Social Affairs - Population Division. World Population Prospects: The 2024 Revision. (Medium-fertility variant). থেকে প্রাপ্ত