বিগত ৩১ আগস্ট থেকে ৩ সেপ্টেম্বর, পশ্চিমবঙ্গ উর্দু অ্যাকাডেমির পক্ষ থেকে 'উর্দু ইন হিন্দি সিনেমা' নামক একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে বক্তা হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলেন বিশিষ্ট গীতিকার ও চিত্রনাট্যকার জাভেদ আখতার। জানা যায়, সেই অনুষ্ঠান রাতারাতি দুটো মৌলবাদী সংগঠনের চাপে নাকি উর্দু অ্যাকাডেমি বাতিল করেছে! জাভেদ আখতারের মতো বিখ্যাত লোক যাতে কলকাতায় না আসে, তার জন্য ফতোয়া জারি করেছে। এতে শিক্ষিত বাঙালি সমাজ ক্ষেপে আগুন। ক্ষেপে যাবার মতোই ঘটনা। চারিদিকে হায় হায় রব। তা ভালো। প্রতিবাদের কারণও একশো শতাংশ জায়েজ।
রফি আহমেদ কিদওয়াই রোডের বুকে বছরের পর বছর শুনশান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান– ওয়েস্ট বেঙ্গল উর্দু অ্যাকাডেমি। ১৯৯৯ সালে বামফ্রন্ট সরকার পশ্চিমবঙ্গ উর্দু অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠা করে। প্রতিষ্ঠানটি হঠাৎই বুদ্ধিজীবী মহলের চর্চায় উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠার ছাব্বিশ বছর পেরিয়ে গেছে। সরকার বদলেছে। অথচ, উর্দু অ্যাকাডেমির কাজ কতটা কী এগিয়েছে কেউ ভেবেছে তা নিয়ে? বছরে দুশো টাকার বিনিময়ে সপ্তাহে তিনদিন করে উর্দু পড়ানো হয়। ঘন্টাখানেকের ক্লাস। সারা বছরে উর্দু অক্ষর, কয়েকটি শব্দ, গল্প, কবিতা– এতদবধি শিখলেই পরীক্ষা-টরীক্ষার মাধ্যমে একটা ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট কপালে জুটে যায় ঠিকই, কিন্তু তা বাদে আর কিছুই হয়না। অ্যাকাডেমির পক্ষ থেকে উর্দু ভাষায় কাজ করার ক্ষেত্রে উদ্যোগ প্রায় নেই বললেই চলে। বছর বছর নতুন ছাত্ররা পড়ে, পরীক্ষা দেয়, পাশ করে অথবা করে না, কোর্সের মেয়াদ ফুরিয়ে যায়। পড়ানোর ক্ষেত্রে যত্নের অভাব, শিক্ষকের অভাব, তাদের ব্যবহার; অভিযোগ-অনুযোগের কারণ তখনই হত, যখন দুশো টাকার বদলে পনেরো-কুড়ি হাজার টাকা আমাদের পকেট থেকে যেত। ফলতঃ যারা নতুন ভাষা শেখার উৎসাহ নিয়ে ভর্তি হয়, তাদের অনেকেরই কিছুদিন ক্লাস করার পর অচিরেই সেই ইচ্ছে কোথাও যেন মুছে যাচ্ছে। গতানুগতিক নিয়মে নতুন ভাষা শেখা বড়ই বিড়ম্বনা হয়ে দাঁড়ায়। এভাবেই চলছে অ্যাকাডেমি। শহরের সিংহভাগ মানুষ জানেইনা এই নামে কোনও প্রতিষ্ঠান আছে, যেখানে স্বল্পমূল্যে উর্দু ভাষা শেখানো হয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে বিভিন্ন সময়ে শিল্প ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর আক্রমণ করে। শুধু তাই নয়, সাংস্কৃতিক পরিসরকে ভয় দেখিয়ে স্তব্ধ করার চেষ্টা হয়। উদাহরণস্বরূপ দেখা যায়, মধ্যপ্রদেশের চমতারপুরে আয়োজিত ভারতীয় জননাট্য সংঘ (Indian People’s Theatre Association- IPTA)'এর নাট্য উৎসব উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির চাপের মুখে বাতিল হয়ে যায়। জাতিবৈষম্যের বিরোধিতা করে তৈরি নাটকগুলোর বিরুদ্ধে, বজরং দল ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কর্মীরা অভিযোগ তোলে যে, নাটকগুলি 'অ্যান্টি-হিন্দু' এবং 'অ্যান্টি-ন্যাশনাল' বার্তা দিচ্ছে। অর্থাৎ, মৌলবাদের চরিত্র এক, মৌলবাদীদেরও।
ফেরা যাক আসল কথায়। উর্দু ভাষাকে মুসলমানদের সাথে, বলা ভালো, ধর্মের সাথে জুড়ে দেওয়া রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের বহু আদিম প্রোপাগান্ডা৷ জমিয়তে উলেমা-ই-হিন্দ' এর নেতা সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী, রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী এবং বর্তমানে তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুখ, স্বয়ং এই অনুষ্ঠান বাতিলের শমন জারি করেছেন। তাদের সাথে আছে ওয়াহইয়াইন ফাউন্ডেশন।
জাভেদ আখতার স্বঘোষিত নাস্তিক। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে আক্রমণাত্মক বক্তব্য রাখার জন্য একাধিকবার তিনি সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে তার ব্যক্তিগত মতামত ধর্মপালনকারী মুসলমানদের কাছে আপত্তিকরও বটে! এ'কথা সত্য। আর এতেই মৌলবাদীদের আপত্তি। সে আপত্তি থাকতেই পারে। তবে তার জন্য একটা সরকারি প্রতিষ্ঠান নিজেদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বাতিল করবে কেন? স্বাধীন-স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান– উর্দু অ্যাকাডেমির কি মৌলবাদী সংগঠনগুলোর আবদার মেনে চলার কথা?
উর্দু ভাষাকে কোনও বিশেষ সম্প্রদায়ের বলে দাগিয়ে দেওয়া একধরনের নোংরা রাজনীতি ছাড়া কিচ্ছু না। উর্দুর জন্ম ও বিকাশ ঘটেছে ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের পারস্পরিক মেলবন্ধনের মাধ্যমে। ফারসি, তুর্কি, আরবি, হিন্দি ও আঞ্চলিক উপভাষার সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা এই ভাষা ভারতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতির উজ্জ্বল প্রতীক। প্রেমচাঁদ থেকে ফয়েজ– উর্দুর সাহিত্যিকরা ধর্মের সীমানা ভেঙে মানবতা, প্রেম ও প্রতিবাদের ভাষা গড়ে তুলেছেন। তাই উর্দুকে ধর্মীয় পরিচয়ে সীমাবদ্ধ করা মানে ইতিহাসের সঙ্গে অন্যায় করা। পশ্চিমবঙ্গ উর্দু অ্যকাডেমির মতো হাতেগোনা প্রতিষ্ঠানগুলোর এখন এই জরুরি বাস্তবতার সম্মুখে দাঁড়িয়ে কেবল উর্দু ভাষাকে বাঁচানো নয়, বরং ভারতের বৈচিত্র্য ও সহাবস্থানের ঐতিহ্যকে রক্ষা করার প্রয়োজন।
বাংলা জুড়ে জোরকদমে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতির চাষ করছে বিজেপি-আরএসএস। সংখ্যাগুরুর মৌলবাদ যখন সংখ্যালঘুদের উপর রোজদিন নৃশংস আক্রমণ নামায়, ভিটেমাটি কেড়ে নেয়, তাদের সবরকম ভাবে কোনঠাসা করে, দিনের পর দিন সংখ্যালঘুরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, তখনই সংখ্যালঘুর মৌলবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এবং তার সুবাদে সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলো নিজেদের জমি শক্ত করে। যে দুটি মৌলবাদী সংগঠনের কথায় আজ জাভেদ আখতারের কলকাতায় আসা পন্ড হল, সেই সংগঠনের বাদশারা বাংলার খেটে খাওয়া সংখ্যালঘু মুসলমানদের রুটি-রুজি জোগাড় করতে ঠিক কতটা সুবিধা করল বলুন তো! উপরন্তু, এ'ধরনের ঘটনা সামনে আনতে পারলে আখেরে দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলোরই লাভ।
ধর্মীয় সংঘাতে ব্যস্ত থাকা জনগণের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-রোজগারের মতো অত্যাবশ্যক ইস্যুগুলো নিয়ে মাথাব্যথা থাকে না। শাসকেরা আমাদের বারবার ধর্মে-ধর্মে লড়িয়ে দেয়। আর সেই সুযোগ নিয়ে নিজেরা যাবতীয় সুবিধা-সম্পদ লুটেপুটে খায়।
পশ্চিমবঙ্গে বর্তমানে একদিকে, তৃণমূল সরকার জনগণের ট্যাক্সের টাকায় ঘটা করে দীঘায় জগন্নাথ মন্দির উদ্বোধন করছে, দুর্গাপুজোয় ক্লাবগুলোকে এক লক্ষ টাকা করে দিচ্ছে। অন্যদিকে, মুসলমান মৌলবাদী সংগঠনের আপত্তিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বাতিল করছে। বলাবাহুল্য, ঘটনাগুলো একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। আরএসএস-এর বদান্যতায়, তৃণমূলের শাসনে, বাংলার বুকে ধর্মীয় মেরুকরণ ও সাম্প্রদায়িক বিভাজন প্রকট হয়েছে, এ'কথা অনস্বীকার্য। মুসলমানদের একঘরে করা হলে, তাদের উপর আক্রমণ নামলে, নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে তারা আবারও বাধ্য হয়ে তৃণমূল কংগ্রেসকেই ভোট দেবে। এটাই তৃণমূলের ছক। এখন প্রশ্ন হল, যে মৌলবাদী সংগঠনগুলো পরোক্ষভাবে ধর্মীয় বিদ্বেষকে সাধারণ মানুষের মননে-চেতনায় ছড়িয়ে দেয়, সেই সংগঠনগুলো কাদের মদতে রাজ্য তথা দেশজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে? সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির কাঁধে ভর করেই কি তবে তৃণমূল কংগ্রেস ছাব্বিশের বৈতরণী পার করতে চাইছে?
বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে সাম্প্রদায়িকতার বীজ ব্রিটিশরাই পুঁতে দিয়ে গেছিল। হিন্দু-মুসলমান বিভাজনকে উসকে দিয়ে তারা রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিল। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ সেই বিভেদের এক বড় উদাহরণ। একইভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় এবং বিশেষ করে দেশভাগের প্রাক্কালে হিন্দু-মুসলমান সংঘাত ভয়াবহ আকার নিয়েছিল, যা দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতচিহ্ন রেখে গেছে বাংলার মাটিতে। স্বাধীনতার পর বামফ্রন্ট দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার সময়ে সাংগঠনিকভাবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখলেও মাটির তলায় বিভাজনের আগুন সর্বক্ষণ জ্বলেছিল। তৃণমূল সরকার সংখ্যালঘুদের প্রতি ভোট ব্যাঙ্ক হিসেবে ঝুঁকলে বিজেপি 'মুসলমান তোষণ'-এর ন্যারেটিভ জনপ্রিয় করে তোলে। যার ফলে বিজেপির বাংলায় জায়গা করতে কিছুটা সুবিধাই হয়। এখন তৃণমূল সরকার যদি বিজেপি'র পথে হেঁটে মৌলবাদী সংগঠনগুলোকে দিনের পর দিন তুষ্ট করে চলে– তাহলে ছাব্বিশে ভোটে জিতে বৈতরণী পার করে ফেললেও, বাংলার ছবিটা আমরা বৈচিত্র্য ও সম্প্রীতির রঙে এরপর আঁকতে পারব তো?