পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

খেয়াঘাট

  • 07 July, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 622 view(s)
  • লিখেছেন : উজ্জয়িনী হালিম
এই গ্রামের বাইরে বড় একটা যায়নি হাবুল মাঝি। নৌকা নিয়ে ব্রাহ্মণী নদীর তীরের শিবরাত্রির মেলায় যাওয়া ছাড়া। দু একবার অবশ্য নবদ্বীপ গেছে পার্বণে। এই তার পৃথিবী। কলকাতার নাম শুনেছে, টিভিতেও দেখেছে, লোকে লোকারণ্য, যেন বারমাস মেলা লেগে আছে। অবশ্য কলকাতার গঙ্গা নদী দেখার একটা সাধ আছে, কিন্তু সাধ্য কোথায়? এই বই নদীর উপরেই খেয়া পারাপার করছে তার তিন গুষ্টি, এ নদীও তো ব্রাহ্মণী হয়ে গঙ্গা বেয়ে বৈতরণীর ঘাটেই ঠেকেছে। জল স্পর্শ করে মাথায় ঠেকায় মাঝি।

হাবুল মাঝির গ্রামটি বড় সুন্দর। কলকাতা থেকে ৩ ঘন্টার গাড়ির পথ। পাকা সড়ক থেকে মাটির রাস্তা নেমে চলে গেছে বিস্তীর্ণ ধান জমির বুক চিরে নদীর দিকে, বই নদী। এই নদীর দু তীরে আম কাঁঠালের ছায়ায় ঘেরা হাবুল মাঝির গ্রাম মালঞ্চা। সাবেকি গ্রামের সবটুকু বৈশিষ্ট্য নিয়ে স্বগরিমায় না জানি কত বছর ধরে  ধারণ করে আছে গ্রাম বাংলার দিনযাপন। ভগ্নদশা জমিদার বাড়ি, নাটমন্দির, পুজার স্থান, সার্বজনীন আটচালা ছাড়াও রয়েছে নদীর দু দিকেই কিছু বাঁধা ঘাট। দুই তীরের ৪-৫ টা গ্রামের মানুষের নদীর পারাপারের একমাত্র ভরসা হাবুল মাঝির খেয়া। ব্রাহ্মণ পাড়া, চাষি পাড়া হয়ে গ্রাম ছড়ানো বাগদি পাড়া পর্যন্ত। এককালে জমিদারদের লাঠিয়াল নিয়োগ হতো, এই পাড়া থেকেই। এখন সে যুগ গেছে। বাগদি পাড়ার নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো জনমজুর খেটে খায়, মেয়েরা টুকটাক বেতের, বাঁশের ঝুড়ি বোনে এই আর কি। তবে এই পাড়াতেই একটা পরিবারের কদর খুব, ঠেলায় পড়লে তারাই সম্বল। এরা হলো মাঝি পরিবার। সেই ছোট থেকেই হাবুল মাঝির খেয়া পেরিয়ে ইস্কুলে, কলেজে গেছে গ্রামের শিশু, কিশোর, যুবারা। আপিসের ট্রেন ধরতে দৌড় দিয়েছে বাবুরা, একবিন্দু তর সয় না তাদের।
ঝড়, বৃষ্টি, শীত, গ্রীষ্ম তুচ্ছ করে হাবুল মাঝি আছে খেয়া পারাপারের জন্য, সেই কাকভোর থেকে মাঝরাত, যেন প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম। যদি কোন অভাগা পথিক এসে পড়েছে অসময়ে, হাবুলের বাড়িতে ডাক গেছে তখনি। হাবুল ঘুম চোখেও লগি ঠেলে নৌকা নিয়ে হাজির। এর বদলে কোন বাঁধা মাইনে তার ছিল না। পঞ্চায়েতে সে খেয়ার ডাক ধরত, যেমন তারা তিনপুরুষ ধরে করে আসছে। নিত্যযাত্রীদের সাথে ব্যবস্থা মাসিক বা বার্ষিক। চাষি গ্রাম, ফসল উঠলে ধানের ভাগ পেত হাবুল, ক্ষেতের সব্জি, বাগানের ফল পাকুড় আর ঐ এক ফোঁটা নিষ্কর ভিটে। পুজা পার্বণের দক্ষিনা আর নেহাত অচেনা লোককে পার করলে ২টাকা ৫ টাকা। শীর্ণ বই নদীর মতই কষ্টেসৃষ্টে দিনাতিপাতের বন্দোবস্ত তার। অবশ্য বর্ষায় নদী ফুলে ফেঁপে উঠলে, হাবুলের মেজাজেও যেন তার ছায়া পরে। পাড়ের কাছে নৌকা নিয়ে বসে বসে বিড়ি ধরিয়ে নিজেকে বেশ কেউকেটা মনে হয় তার। ৪-৫ টা গাঁয়ের মানুষের সেই কাণ্ডারি। বিদ্যেটা বংশের নিয়ম মেনে ছেলেকে শেখাতে চেষ্টা করেছে সে। একমাত্র ছেলে তার, শখ করে নাম রেখেছে নিমাই। একটা মেয়ে ছিল নাম মায়া, তা সে কবেই মায়া কাটিয়ে চলে গেছে। এই বই নদীর উত্তর পাড়ের শ্মশানেই তার চিতা পাতা হয়েছিল। ঝাঁঝালো গরমে ঝিমুনি আসলে ছই এর ভিতর বসে, এই সব কত কথা মনে পড়ে মাঝির। সেই কবে তার বাবা কানাই মাঝির হাত ধরে সে বৈঠা বাইতে শেখে। বাবাও উত্তরের শ্মশানে শেষ শয্যা পাতল, আর নৌকার দাঁড় আর হাবুলের হাত থেকে নামলো না। দারিদ্র্য আর অভাব অনটনও আর বাড়ি থেকে গেল না কোনদিন। যত দিন যাচ্ছে ততই দিন চালানো কঠিন হয়ে উঠছে আজকাল। শুধু পারাপারের কড়ি তে কি আর হাঁড়ি চড়ে। ছেলেটাকে ভালো ইস্কুলে পড়ানোর শখ ছিল মাঝির, তা সে হলো শুধু শখ। ছেলে প্রাইমারি পাশ করে লেখাপড়ায় ক্ষান্ত দিয়েছে। এখন ইয়ারদোস্তদের সাথে ঘোরে, কি যেন সব দল করে, পার্টির মিছিল যায়, আকাশের দিকে হাত ছুড়ে শ্লোগান দেয়। ঘাটে বসে বসে দেখে হাবুল, বোঝে না কি হবে এতে। তার চেয়ে বাপদাদার পেশাটা শিখে নিলে ভালো করতো নিমাই, পেটে ভাতে কেটে যেত, যেমন তাদের তিনপুরুষের কেটেছে।

কিন্তু তা হবার নয়। নিমাই লায়েক হয়েছে, মিটিং মিছিল করে রাতে ভাত খেতে বসে কতো বড় বড় কথা সে বলে, যার বেশীর ভাগ মানেই বোঝে না হাবুল বা তার বউ। গ্রামের উন্নয়ন হবে, কেউ আর না খেয়ে থাকবে না, তাদের নামে ব্যাংকে বই হবে, সেখানে সরকার অনেক টাকা দেবে মাসে মাসে; হাবুল কে আর নৌকা নিয়ে বের হতে হবে না। তাছাড়া বাবুরা সব লেখালেখি করেছে, বই নদীর উপরে হবে ব্রিজ, খেয়ার আর দরকার হবে না। ব্রিজের উপর দিয়ে হুশ করে মোটর সাইকেল নিয়ে চলে যাবে নিমাই। নদীর ওপারের খাসপুরের মেয়ে রেখাকে বিয়ে করে নিয়ে আসবে মারুতি গাড়ি চেপে। শেষের স্বপ্নটা নিমাই আর প্রকাশ্যে বলে না, কিন্তু এমন কত স্বপ্নই ভিড় করে তার তরুণ চোখে, উন্নয়নের আশায় সে দিন গনে। সবুজ পার্টির তরুণ দা তাকে কথা দিয়েছে, ব্রিজের কন্ট্রাক্টরি লাইনে তাকে সাপ্লাই এর কাজ তদারকিতে ঢুকিয়ে দেবে। শুধু শুধুই কি মিছিল হেঁটে গলা ফাটায় সে! বাপ তার অবুঝ, উন্নয়নের ছটা দেখলে মুখ ঘুরিয়ে নেয়, সেই কুপি বাতির দেশের লোক, নতুন যুগের আলোর জোরে তার চোখ অন্ধ হয়ে যায়।

বাপ বলে - কি বলিস নিমাই ব্রিজ হবে? তাহলে আমাদের নৌকার কি হবে বাপধন? নিমাই একটা অবজ্ঞার শব্দ করে বলে, কতদিন বলেছি এবার এসব ছাড়, বেচে দাও ডিঙিটা, না হলে অন্তত কাঠ গুলো খুলে ঘরে কাজে লাগাও! শিউরে ওঠে হাবুল। নদীর পবিত্র জলে, দুবেলা পুজো দিয়ে যে নৌকা ভাসিয়ে তাদের গ্রাসাচ্ছাদন হয়, তাকে ঘরের কোনে ফেলে রাখাও যে পাপ। তাছাড়া ছেলের এসব গল্পতে তার বিশ্বাস নেই। তরুণ বাবুরা নাকি তাকেও মুদি দোকান করে দেবে, যখন ব্রিজ চালু হবে। কিন্তু জলের তরঙ্গে দুলে চলা জীবন হাবুলের, মুদি দোকান যদিও বা হয়, তার নিস্তরঙ্গ জীবনে সে বাঁচবে কি করে? সাত পাঁচ ভেবে ভেবে আরও বেশি করে নৌকাতে বসে ঝিমায় হাবুল। নদীর জল কলকল করে কতো পুরনো দিনের কথা বলে যায়। মনে হয় এই যেন সেদিন চণ্ডীতলার ভট্টাচার্যদের ছোট ময়ে কমলার বর ও বর যাত্রীদের নদী পার করালো সে। তার নৌকাতেই শ্বশুর বাড়ি গেল কমলা আবার বিধবা হয়ে তারই নৌকাতে ফিরলে বাপের বাড়ি। শম্ভু চক্কোত্তির ছেলে অবিনাশ, তার খেয়া পার করেই তো কলেজ পাশ করলো; এখন সে নাকি জজ ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছে। আর সেই বর্ষার ঝড় জলের রাতে, ভট্টাচার্যদের মেয়ে নমিতা যখন মন্ডলদের ছেলে সৌরভের সাথে পালালো, তখন কে তাদের খেয়া পার করে দেয় - এই হাবুল মাঝিই তো। বছর ঘুরতেই নমিতা ছেলে কোলে, স্বামীর সাথে যখন গাঁয়ে ফিরলে, তখন ভট্টাচার্য ও মণ্ডল বাড়ি - দু বাড়িতেই ঘটা করে ভোজ দিয়েছিল। হাবুল সপরিবারে খেতে গিয়েছিল। খাদ্যতালিকায় নদীয়া থেকে এনে পরিবেশন করা দই এর স্বাদ যেন এখনো জিভে লেগে আছে। আনমনে জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট চাটে হাবুল।

দিন যায়, আজকাল ক্রমশ কাজ কমে আসছে হাবুলের, ঠিক যেমন কমে আসছে বই নদীর নাব্যতা। গরমে তো অনেক জায়গায় জল থাকে না। মানুষ হেঁটেই পার হয়। অনেকে আবার খাসপুর দিয়ে ঘুরপথে সাঁকোর উপর দিয়ে মোটরবাইক নিয়ে যাতায়াত করে। গ্রামেও লোক কমছে। অনেকেই বাইরে চাকরি করে। যাদের ক্ষমতায় কুলায় তাদের বাড়ির ছোটরাও হস্টেলে থেকে লেখাপড়া করে। চাষি পাড়ার দৌলতে আজও হাঁড়ি চড়ে হাবুলের ঘরে। উন্নয়ন তার কাছে এক অলীক স্বপ্ন মনে হয়, আশা নয়, একরাশ আশঙ্কা নিয়ে সে উন্নয়নের আসার পথে নিরুৎসাহিত হয়ে চেয়ে থাকে।

কিন্তু যা যায় তা বোধহয় একেবারেই যায়। হাবুলের দিন গিয়েছে। এখন নিমাইদের পৃথিবী। এবারের ভোটে এ গাঁঁয়ের মানুষ ব্রিজ তৈরির দাবিতে নেতাদের সাথে জোর সওয়াল করে প্রতিশ্রুতি পাকা করে নিয়েছে। আজ বিজয় মিছিল। সবুজ দল জিতেছে, ব্রিজ তাহলে এবার হবে। নিমাই এর চাকরি হবে, হাবুলের হবে মুদির দোকান। খেয়াঘাটে নিজের জীর্ণ নৌকার উপর বসে শোভাযাত্রা দেখে হাবুল, নিষ্পলক চোখে। পাড়ার একটা উৎসাহী ছেলে তার হাতে একটা পতাকা ধরিয়ে দিয়ে যায়। বই নদীর দক্ষিণের বাতাসে পতপত করে ওড়ে সে নিশান। হাবুলের চোখে রাজ্যের ঘুম নেমে আসে।

এরপরে বেশ কয়েক বছর পার হয়ে গেছে। সত্যিই বই নদীর উপর ব্রিজ হচ্ছে। ব্রাহ্মণীর শাখা নদী বই অসহায় ভাবে সহ্য করছে যান্ত্রিক উপদ্রব। সহ্য করছে হাবুল মাঝিও। এখন কালে ভদ্রে তার ডাক পরে খেয়া দেওয়ার। ব্রিজের কাজ শেষ হলে, তার দরকার ফুরাবে। কে জানে একদিন হয়তো বই নদীর দরকারও ফুরাবে! ক্ষীন হয়ে আসা জলের টানে কি তারই ইংগিত!
শেষমেশ উন্নয়ন এসেছে এ গাঁয়ে, উন্নয়ন আসবেই, ধ্রুবতারার মতই সত্য সেটা, এখন বোঝে হাবুল। কিন্তু কেন যে নিমাইকে জনমজুর খাটতে যেতে হয় আজও, কেন যে তার মুদির দোকানের দেখানো জায়গায় রায়দের কাপড়ের দোকান হয়ে গেল, কেন আর কেউ তার উন্নয়নের খোঁজ করে না - এসব এখনো বোঝে না সে। সে শুধু বোঝে বই নদীর ভাষা, দুজনের অব্যক্ত কান্নার সুর মিলে একসাথে বয়ে যায় ব্রাহ্মণী হয়ে বৈতরণীর দিকে। সে খেয়াঘাটেও কি উন্নয়ন হচ্ছে, হচ্ছে কোন নতুন ব্রিজ?

0 Comments

Post Comment