পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

লাল চোখে নীল গল্প

  • 10 October, 2024
  • 1 Comment(s)
  • 419 view(s)
  • লিখেছেন : সাদিক হোসেন
আসগার পাড়ার ছেলে। যদিও তার সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল পাড়ার বাইরে - লাস্ট ট্রেনে বাড়ি ফেরার সময়, অকস্মাৎ। সেদিন অফিস কেটে বিকেলের দিকে কফি হাউস গিয়েছিলাম। সুব্রত বলল, কাফকা এসেছে।

কোথায়?

ছিল তো এখানে। কাল সকালের ট্রেনে আবার ফিরে যাবে। বলছিল কেটিতে থাকবে। গেছে হয়ত।

অগত্যা পাড়ি দেওয়া হল কেটিতে। গিয়ে দেখি বেচারা একলা বসে রয়েছে। জিজ্ঞেস করতে বলল, একটা কাণ্ড ঘটে গেছে।

আমরা দুজনা এর-ওর দিকে তাকাতে জানাল, হাউস থেকে প্লান করেছিলাম প্লানেটোরিয়ামে যাব। কেটির কথা উঠেছিল। কিন্তু বিশু বলল কীসব থ্রিডিতে শো হচ্ছে ওখানে। ঢুকলে মনে হবে সত্যিকারের মহাবিশ্বে বসে রয়েছি। নেপচুন থেকে মার্স হাতের মুঠোয়। তো সেদিকেই আসছিলাম। আমি, বিশু আর পুরকায়স্থ।  মাঝখানে পুরকায়স্থ ঘোটালা পাকিয়ে দিল। বুকের ডান দিক দিয়ে ব্যথা উঠছে। গা দিয়ে দরদর করে ঘাম দিচ্ছে। চোয়াল শক্ত হয়ে যাচ্ছে। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। বিশুকে বললাম - চল ভাই, একে হাসপাতালে নিয়ে যাই। সে বলে, হাসপাতালে মরলে ব্যাপক ঝামেলা হবে। পুলিশটুলিশ আসবে। পোস্টমর্টেম হতে পারে। কেলেঙ্কারি হবে। তার চে’ কেটিতে যাই। ওখানকার ওয়েটাররা পুরকায়স্থকে চেনে। ওরাই যাহোক ব্যবস্থা করে দেবে। 

হার্ট-এটাকের পেশেন্টকে বার-এ আনলে?

আরে ব্যাপার খারাপ না। এসে দেখলুম। বিশুই ঠিক। ওয়েটারদের বলতেই তড়িঘড়ি ব্যবস্থা করল। ওদের কাছে পুরকায়স্থের বাড়ির নম্বর ছিল। ফোন করে ওর বৌকে ডাকা হল। বৌ এল আধঘন্টার ভেতর।  এসেই বিশুকে থাপ্পড় দিল। আমাকে চেনে না বলে শুধু চাউনি দিল। তারপর ট্যাক্সি ডেকে নিয়ে গেল বরকে। সঙ্গে বিশুও গেল।

খবর পেয়েছ কেমন আছে?

পাগল! এখন কেউ ফোন করে। কাল ঠিক খবর পেয়ে যাব। 

 

আসলে কাফকা, কাফকা নয়। থাকে কুচবিহারে। সেখানকার প্রচলিত লোকগাথার সঙ্গে এখনকার রাজনীতির মিশেল ঘটিয়ে দশ ফর্মার এক উপন্যাস নামিয়েছে। সেই উপন্যাসে একজন সাহেব ভুতের নাম গ্রেগর সামসা। সেই থেকে অনিমেষ কাফকা হয়ে গেছে লেখক মহলে। বইটা এক বছরেই ১০০০ কপি বিক্রি হয়েছে।

অনিমেষ দু:খ করে বলল, শালা বাংলার পাঠকরা হেব্বি হারামি। প্রথমে তোমাকে এক্সপেরিমেন্ট করতে দেবে। তারপর একটা এক্সপেরিমেন্ট যদি হিট হয়ে যায়, বারবার ঐটাই চাইবে। 

সুব্রত বলল, তোমার কাছে কি বিদেশি ভুত চাইছে।

সেটা হলেও বুঝতাম। একজন বলল, দাদা এবার কলকাতা নিয়ে লিখুন। কলকাতার বিহারি ট্যাক্সিওয়ালাদের নিয়ে লিখুন। আর লর্ড হেস্টিং তো এমনিতেই ভুত। হেস্টিং হাউসে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে মাঝে মাঝেই নথি খুঁজে বেড়ান। সেইটাকে সূত্র ধরে আপনি ৭৬র মন্বন্তরটাকে ধরতে পারবেন। একেবারে ৩০০ বছর! অকাদেমি বাধা।

আমরা মদে চুমুক দিয়ে অনিমেষের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। 

সে বলল, কী হারামি তোমাদের কলকাতার লোকগুলো। এগুলো মরে না কেন?

সুব্রত বলল, থাকছ কোথায়?

কাফকার সটান জবাব, কেন প্রতিবার যেখানে থাকি। পুষ্পার ঘরে।

তখনো আমি খুব বেশি মাল খাইনি। সুব্রত প্লান করে নিল, এবার তাহলে সবাই মিলে পুষ্পার ঘরে যাওয়া হবে।

কিন্তু কাফকা নারাজ, অহো… তোমরা ভাই কলকাতার মানুষ, প্রেম সম্পর্কে তোমাদের ধারণা খুব ঊনবিংশ শতাব্দী কেন্দ্রিক। একটুও এগোতে পারলে না।

তোমরা এগিয়েছ বুঝি?

আলবাত এগিয়েছি।

কী রকম?

সেসব তাত্ত্বিক ব্যাপার এখন বলতে ভাল্লাগছে বাঁ..। ওসব ছাড়ো। 

মানে, পুষ্পার বাড়িতে নিয়ে যাবে না! আমরা যে ভাবছিলাম তুমি এসেছ, একটা গল্পপাঠের আসর জমানো হবে আগামীকাল।  সেটা তাহলে ক্যানসেল করতে হচ্ছে!

কাল তো ট্রেন!

যাবে তো রেগুলারে। না গেলেই হল। পরেরদিন বাসে তুলে দেব।

অনিমেষের চোখ মুহুর্তে উৎসুক। কী যেন ভেবে নিল। আমি কফিনের শেষ পেরেকের উপর হাতুড়ি চালিয়ে বললাম, তানিয়ার বাড়িতে যাব তোমাকে নিয়ে। সুব্রত তো থাকছেই, অনেকদিন পর পার্থপ্রতিমদাও শহরে। নদীয়ার পরিমল থাকবে। ওদের সঙ্গে দেখা করবে না!

পার্থদা কোথায় থাকছেন?

নিউটাউনে। তানিয়ার বাড়িতে।

বোধহয় মন খারাপ হয়ে গেল কাফকার। গ্লাসে ‘দাদা’ ঢালা হল। চুমুক উঠল। এবং পুষ্পার ঘরে যাবার নিমন্ত্রণ পেয়ে গেলাম আমরা। 

 

পুষ্পার ঘর বন্ধ ছিল। ভেতরে খদ্দের। আমরা করিডরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মেয়েগুলো আমাদের দেখে মজা করছিল। আমাদের শারীরিক দুর্বলতা ছিল তাদের ঠাট্টার প্রধান বিষয়।

কাফকার চোখ ছলছল। বিসলারির বোতলে দাদা। দাদাতে চুমুক দিয়ে বলল, কদিন ধরে ভাবছি লাইফটাকে চেঞ্জ করব। শালা এখানে কিছু নেই। খালি আকচাআকচি।  লুম্পেনদের জোর চারদিকে। সাহিত্যে এই পরিমান লুম্পেন আগে কোনোদিন ঢোকেনি। 

তা চেঞ্জ করে যাবে কোথায়?

সেটাই হল গিয়ে কোশ্চেন। আবার চুমুক দিয়ে বোতলটা সুব্রতকে দিল, কুচবিহারে বৌ-বাচ্চা, এখানে পুষ্পা। বৌ তবু ঘরে ঢুকতে দেয়। পুষ্পা তো ঘরে অন্যকে ঢোকায়। অথচ, দেখো, কথা হয়েছিল এই কদিন ও কারোকে নেবে না। শালা কথা রাখল না। বাঁ…

তা কী ভাবছ?

ভাবছি পাহাড়ে উঠব। এভারেস্টের বেসক্যাম্পে যাব। সব পাল্টাতে হবে। নতুন ফর্ম খুঁজছি। বুঝলে। এইসব দিয়ে…  কিছু হবে না…. সেন্টেন্সের গঠন অব্ধি পাল্টাব। একটা ক্যারেক্টর ভেবেছি। সে তিস্তার তলায় ডুবে আছে। কিন্তু জ্যান্ত। তার উপর দিয়ে সময় বয়ে চলেছে। শীত, গ্রীষ্ম… আর রাজবংশীরা, সরকার পক্ষ, ট্যুরিস্টরা যা যা ফন্দি আঁটে সব সে শোনে। নদীতে লিপিবদ্ধ করে। বন্যা হলে সেইসব লিপিবদ্ধ করা ঘটনা সাধরণের ঘরে ঢুকে যায়… আইডিয়াটা কেমন?

ভালোই। (মন রাখতে বললাম)

ইতোমধ্যে পুষ্পা দরজা খুলেই চেঁচিয়ে উঠল, এতোজনকে নিতে পারব না। 

আহা। কাফকা প্রেমিকাকে সামলাতে বলল, ওরা ভদ্দরলোক গো। ওসব করতে আসেনি।

ভদ্দরনোকেরাই এখানে আসে।

না, মানে, ওরা সেজন্য আসেনি। তোমাকে জাস্ট দেখতে এসেছিল।

 

পুষ্পার ঘরে বসে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম। হাজারগন্ডা ঠাকুরের ছবি। আয়নায় কপালের টিপ। সুইচ টিপলে ঝিকমিক আলো জ্বলে। আলোটা আবার দপদপ করে। খাটের নিচে বাসনপত্র। একটা ট্রাভেল ব্যাগ রয়েছে। ওটা কাফকার।

চান সেরে পুষ্পা আবার গ্লাস সাজালো। প্লাস্টিকের গ্লাসে রম ঢালা হল। পা ছড়িয়ে পুষ্পা বসেছিল। কাফকা গিয়ে তার ঘাড়টা মালিশ করে দিচ্ছিল। 

 

সুব্রত ঘড়ি দেখে বলল, চলো। 

কাফকা বাধা দিল না, কাল তাহলে তোমরা আসর বসাচ্ছ তো?

অমনি পুষ্পা জেদ ধরল, তোমাদের ভদ্দরনোকদের আসরে আমিও যাব। এই আমাকে নিয়ে যাবে তো!

কাফকা প্রেমে বিগলিত, কিন্তু মুখটা কাঁচুমাচু। 

আমরা বেরিয়ে পড়লাম।

 

শিয়ালদা থেকে লাস্ট ট্রেনটা ধরেছিলাম। সবই ঠিক ছিল। কিন্তু আধঘন্টা পরেই পেট থেকে পাকস্থলি বেরিয়ে এলো। কোনোমতে চলন্ত ট্রেনের দরজার সামনে বসে বমি করছিলাম। রডটা ঠিক ধরতেও পারছিলাম না। যেকোনো মুহুর্তে পড়ে যেতে পারতাম। খানিকপর পিঠে কে যেন হাত রাখল। সে আসগার। 

 

আমাকে ধরে ধরে প্লাটফর্মে নামাল। চাতালে বসিয়ে খবরের কাগজ দিয়ে হাওয়া করল। জল এনে মাথায় ঢালল।

ধাতস্থ হলে পর বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

আমি তাকাতেও পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল ওখানেই শুয়ে পড়ি। 

সে বলল, এসব করেন কেন? খামোকা শরীরকে কষ্ট দিয়ে কী পান?

কোনো উত্তর করিনি। এসব বোকা প্রশ্নের উত্তর নেই। তবে সে আমাকে ঘর অব্ধি পৌঁছে দিয়ে দরজায় ধাক্কাও মেরেছিল। কিন্তু দরজা খোলা অব্ধি ওয়েট করেনি। মা দরজা খুললে আমি হামাগুড়ি দিয়ে ঘরে ঢুকে ছিলাম।

 

পরের দিন প্রোগ্রাম করা গেল না। পার্থপ্রতিমবাবুর বুকের ব্যামো - সেটা বেড়েছে। সুব্রত পুষ্পার ঘরে গিয়েছিল। কিন্তু কাফকার সঙ্গে তাকে করিডরেই গল্প সারতে হয়েছে। পুষ্পা দু'জনকে পরপর নিয়েছিল। প্রায় চল্লিশ মিনিট লাগল সেসব সাল্টাতে। সুব্রত কাফকার ভাবি উপন্যাস শুনেছিল। পরে আমাকে জানিয়েছিল এটা কাফকা কোনোদিন লিখবে না। আসলে এখন ও কিছুই লিখছে না। টেনশানে আছে। তাই আজগুবি প্লট সাজিয়ে ভ্যানতাড়া মারতে চাইছে। 

 

সকালের ট্রেনে আসগারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সে বড়বাজারে সিংজির গদিতে সেলসম্যান। বলল, তোমাদের সব লোকদেখানো জিনিস। কী আর করো? একদিন গদিতে কাজ করলে সাহিত্য পেছন দিয়ে বেরিয়ে যাবে।

আসগার দেখি শিল্পি-সাহিত্যিকদের উপর খ্যাপা। সুযোগ পেলেই বলে, আসল কালাকার এইসব করে না। তোমাদের মদ-মাগির নেশা। সেইটাই আসল। লেখালিখি ছুঁতো। আসলি কালাকার হলে সমাজকে রাস্তা দেখাতে। ফু:

আমি ওর কথা শুনছিলাম মন দিয়ে। এটাও বুঝতে পারছিলাম ওর মধ্যে আমাদের সম্পর্কে জানবার অদম্য কৌতূহল রয়েছে। একবার শুধু তানিয়ার বাড়িতে আসরের কথাটা উল্লেখ করেছিলাম। শুনেই যেতে রাজি হয়ে গেল। 

 

বিকেল থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল আসর। ডিভানের উপর প্রকৃত বাদশাহের মতোন বসে আছেন পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল। বহুদিন সেতার বাজায়নি তানিয়া। আজকে কভার খুলে সেটাকে নিয়ে বসেছে। টিউনিং করছিল। সামনে ছোট্ট একটা যন্ত্র। সেটা তানপুরার কাজটি করে দেবে। 

পরিমল তখনো আসেনি। আসগার গিয়ে বসল পুষ্পার পাশে। দু-জনের মধ্যে বুঝি মজার আলোচনা চলছে। সম্ভবত সবকিছু নিয়েই ব্যাঙ্গ করছে তারা। ইতোমধ্যে গ্লাস ঘুরছিল। সঙ্গে ফিশফিঙ্গার। পুষ্পা ঢকাঢক মারছিল। আসগার মদ খাবে না। শুধু ফিশফিঙ্গার। 

কোলবালিশটা পিঠের দিকে রেখে আয়েশ করে পার্থপ্রতিম বললেন, হচ্ছে না। তোমার গদ্যটা বড়োই কমজোরি। 

প্রথমেই এমন আঘাত আসতে পারে কাফকা বুঝতে পারেনি। কী যুক্তি দেবে ভাবছিল। আচমকা পার্থপ্রতিম তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকে গুরুগম্ভীর গলায় বলতে থাকলেন –---

অন্ত্যেষ্টির মতো তুমি এসেছ এবার, হে সুন্দরী।

প্রজ্ঞার আগুন থেকে বন্ধ্যা কবিদের কামনায়

তুমি আবির্ভূতা। নীলকোমললোচনে

মত্ত পরিহাস জানে মানসের অনতিদূরেই তার মৃত্যু হবে…

 

পরিবেশটা গম্ভীর হয়ে গেল মুহুর্তে। তানিয়া সেতারে মেঘ রাগের  আলাপ শুরু করছে। পার্থপ্রতিম এতোক্ষণ কবিতা পড়ার পর খুকখুক কাশছেন। সামান্য জলে গলা ভিজিয়ে সেতারের ছন্দে মাথা দোলাচ্ছিলেন। 

কাফকা রাগে মদ ঢালছিল গ্লাসে। আচমকা বিদ্যুৎ চমক। তারপর গরজে গরজে আকাশ চৌচির হয়ে গেল। মেঘ কাচের মতো ভেঙে পড়ছিল শহরের রাস্তায়। মেঘের টুকরোয় বিদ্যুৎ লেগে চকিত আলোর সৃষ্টি হচ্ছিল। 

দরজায় কলিংবেল। খুলতে দেখা গেল দেবারতি মিত্র এসেছেন। সদ্য যৌবন পেরিয়েছেন বোধহয়।

তানিয়ার সেতার থামল। তানপুরা বাজছিল যন্ত্রটায়। দেবারতি সটান গিয়ে পার্থপ্রতিমের মুখোমুখি বসলেন, এবার বলুন। 

পার্থপ্রতিম হতচকিত। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে আবার নিজের কবিতার কাছেই ফিরে গেলেন –---

চিকন কবিতা সব চলে গেল শতকশকটে…

তাঁকে থামিয়ে দিলেন দেবারতি। আবার বললেন, কবিতার স্বস্বরটি আকর্ষনীয়। চিকন থেকে চিকনতা অব্ধি অর্থের যাত্রা দেখাচ্ছেন। যেন বাইরে থেকে ঝেঁপে আসছে অন্যতর সুখ। এই সুখ সাংসারিক নয়। অতিপ্রাকৃত। তাবলে গেরস্থালি ছোটো হবে কেন? রান্নার সরঞ্জাম যেকোনো যুদ্ধাস্ত্রের থেকে বেশি ক্ষমতা রাখে।

ভুল বুঝছেন আপনি।

ভুল বুঝিয়েছেন আপনারা। 

সমস্ত কবিতাই তো ভুল। একমাত্র কবিরাই ভুল তৈরি করতে পারেন। ভুল এখানে নাকচ অর্থে নয়। ভুল, যে, ভুলিয়ে দেয়।

তাও কিছু অবশিষ্ট থাকে। সেখানেই আমার স্বর। উপস্থিতি। 

উচ্ছিষ্ট? 

আপনাদের জন্য উদ্বৃত্ত।  আমাদের কাজ উচ্ছিষ্টকে নিয়েই। 

হচ্ছেটা কী! বুঝি বহুদিনের রাগ রয়েছে দুজনের মধ্যে। আজকে রাগমোচন হতে পারে।

এরমধ্যে কাফকা চেঁচিয়ে উঠল। 

কী হয়েছে?

আমরা দু কবির তর্কে মমনোনিবেশ করায় খেয়াল করিনি আসগার আর পুষ্পা কখন বারান্দায় চলে গিয়েছিল। নিজের লেখা নিয়ে একটু আগে বিরূপ মন্তব্য শুনেছে কাফকা। এবার প্রেমিকাকে আসগারের সঙ্গে দেখে বুঝি কিছু বলতে গিয়েছিল। আসগার তো আমাদের বৃত্তে থাকে না। ফলে কথা দিয়ে কাফকাকে রুখতে চায়নি। এক্কেবারে বিচি মুঠোয় নিয়ে চাপ দিয়ে ফেলেছে।

কাফকা কঁকাতে কঁকাতে দু-পায়ের মাঝখানে হাত দিয়ে বসে পড়েছিল। 

কিন্তু সেটা দেখে পুষ্পা আর হাসি থামাতে পারল না। সে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল আসগারের গায়ে। 

 

পার্থপ্রতিম এতোক্ষণ দেবারতির দিকে চেয়ে ছিলেন। এবার হঠাৎ উঠে গিয়ে সোচ্চারে বললেন, আসুন, দেবী, উদ্বৃত্তকে উচ্ছিষ্টে পরিণত করি। 

তা কী করে হয়?

হলেই হবে।

হলেই হবে, এমন কথাও আপনারাই বলেন। আমি বলি আগে একটু দু:খ প্রকাশ করতে শিখুন।

দু:খ সর্বত্র। সে প্রকাশিত।

তাহলে তাকে স্বীকৃতি দিন। 

পার্থপ্রতিম এবার জখম হওয়া বাঘের মতো তানিয়ার থেকে সেতারটা ছিনিয়ে কী করতে চাইছিলেন। কিন্তু ভারী যন্ত্রটাকে সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন মেঝেয়। সেতারের তারগুলো ছড়রা গুলির মতো শব্দ করে বাজতেই থাকল। সেই তারে আঙুল কেটে ফালাফালা। 

আবার মেঘ ভাঙল আকাশে। মেঘের টুকরো ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছিল। মেঝেয় টুকরোগুলো খানিক গড়াগড়ি খেয়ে আইসক্রিমের মতো গলে যাচ্ছিল। ভিজে যাচ্ছিল পায়ের তলা। 

দেবারতি পার্থপ্রতিমকে মেঝে থেকে তুললেন। 

আসগার এতোক্ষণ চুপ ছিল। এবার বলল, তোমরা সব ভুয়ো কালাকার। 

সে সেতারটা তুলে আছাড় মারল। 

তানিয়া চেঁচিয়ে উঠল, বাস্টার্ড! 

দেবারতি শান্ত গলায় বললেন, এই ছেলেটা, তুমি কে?

আসগার বলল, আপমাদের দেখতে এসেছি।

 

এই লুম্পেনকে নিয়ে আর কী করা যায়। তাকে মারতে গেলাম আমরা সবাই মিলে। সে ব্যাটা আমাদের চরকি নাচন নাচিয়ে ছাড়ল। এইসবের মধ্যে পরিমল হাজির। কেউ গ্লাস ছুঁড়েছিল। সেটা তার সিঁথি কেটে বেরিয়ে গেল। এখন দেখলে মনে হবে নববধূ।


 

তানিয়া জানাল, আজকে সে আমাদের সঙ্গে চলে যাবে। 

আসগার একাই ফিরল কারোর তোয়াক্কা না করে।

 

একটা ক্যাবে করে আমরা সবাই বেরিয়ে পড়েছিলাম। ঘরের মধ্যে ছিল দেবারতি আর পার্থপ্রতিম।  বাংলার দুই স্বতন্ত্র স্বর। সারারাত তারা কি তর্ক করেছিল? নাকি মিমাংসার দিকে এগিয়ে ছিল খানিক? এর উত্তর কেউ জানে না। 

 

তবে 'উদ্বৃত্ত’’ আর ‘'উচ্ছিষ্ট’ শব্দ দুটি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ যে চলেছিল - সেটা সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত। বহুদূর চলে যাবার পরও তাদের গলা - কখনো উচ্চ, কখনো কর্কশভাবে - ক্যাবের মধ্যে ঢুকে পড়ছিল অনায়াসে।  

 

আসগারকে এনেছিলাম মজা করব বলে। এখন সে আমাদের নিয়েই মজা করে। বাংলা একাডেমির সামনে দাঁড়িয়ে শাসক দলের সঙ্গে ঘনিষ্ট কবিকে নির্দ্ধিধায় বলতে পারে, শালা চটিচাটা! সারাজীবন সরকারি চাকরি করেছিস। মোটা পেনশান পাস। তাও খালি খাই খাই। এবার বিদেশে যাবার প্লান মারাচ্ছে। ছো:

কিন্তু সেই কবি আসগারকে ঘরে নিমন্ত্রণ করল। বুঝে গেছিলেন এর সঙ্গে পাল্লা দেওয়া ঠিক না। তার চেয়ে সমঝোতায় আসা সুবিধের।

 

আসগারকে সকলেই ভয় করে। কেউ দ্বিমত পোষণ করতে পারে না। কখন কার উপর খাড়া নেমে আসবে কেউ জানে না। 

 

এদিকে তাকে এড়িয়ে যাওয়াও অসম্ভব। যেকোনো সভায় চলে যায়। কবিদের বিভিন্ন নামকরণ করে। কেউ কাতলামাছ, তো কুকুরের লেজ। একজনকে সামনা সামনি বলেছিল, হেই কপি, তুমি কিন্তু অন্যায় অবিচারের উৎপল দত্ত। হেবি শেয়ানা। মনে করো কেউ কিছু জানে না। আমি কিন্তু সব কিত্তি ফাঁস করে দোবো। রাতের বেলা মেয়েদের ম্যাসেজ করা? সব স্ক্রিনশট আছে।

 

সেই কবি একাডেমি চত্বর ছেড়েই দিলেন ভয়ে। 

 

তবে আসগার মদ খাওয়া শিখে গেছে। ওর কাছে টাকা থাকত না। কিন্তু কোনো প্লান হলেই আগে থেকে কীভাবে সব বুঝে ফেলত। ভিড়ে যেত গ্রুপের মধ্যে। 

 

সুব্রতর বোনের বিয়ে। প্রচুর কেনাকাটা করতে হবে। একদিন ঠিক করলাম আসগারের কাছে যাব। সিংজীর গদিতে। 

 

গিয়ে দেখি সে কজন মহিলার সামনে মুহুর্তে লাহেঙ্গা পরছে। আবার খুলে অন্যটা পরছে। আয়নায় তাকে দেখে মনে হল চন্দ্রাবতী। 

 

তাদের মিটিয়ে আমাদের কাছে এল আসগার। চা খাওয়াল। শাড়ির দাম কীরকম সংকেতে লেখা থাকে সেসব জানাল। এক বিচিত্র জগৎ খুলে যাচ্ছিল আমাদের সামনে। শাড়ির পাড়ে টিকিট সাঁটা। ধরা যাক সেই টিকিটে লেখা রয়েছে - 56753. এর অর্থ শাড়িটার ক্রয়মূল্য 675টাকা। আবার অন্য টিকিটে লেখা হয়ত - 8225. এর অর্থ শাড়িটার ক্রয়মূল্য 225x2 = 550 টাকা। 

 

যাহোক বেশ সস্তাতেই শাড়ি কিনতে পেরেছিলাম আমরা। 

 

পুজো এসে গেছে। লিটিল ম্যাগাজিন মেলার আগে পত্রিকা ছাপাতে হবে। সেজন্য লেখা সংগ্রহ চলছিল। অফিস থেকে বিভিন্ন ঠেকে ঘুরেঘুরে লেখার তাগাদা দিচ্ছিলাম। ফিরতাম প্রায়দিন রাতে। শিয়ালদাতে আসগারের সঙ্গে মোলাকাত হয়ে যেত। ও নতুন ফন্দি দেখাল। আমরা ভেন্ডারে উঠতাম। ওর কাছে প্লাস্টিকের বোতলে জল মেশানো বাংলা থাকত। ভেন্ডারে বিড়িও টানা যেত। ফলে আমাদের সেই এক ঘন্টার যাত্রাটা বেশ আমোদে কাটত। 

 

একদিন দেখি আসগার আগে থেকেই লোডেড। তাও বোতল খুলে মাল ঢালছে গলায়। চোখ লাল। বলল, সিংজীর সঙ্গে পাঙ্গা নিয়েছি। ঐ শালাকে কারবার করতে দেব না। আমাকে চেনে না। কতো কপিকে সাইজ করলাম। সিংজীতো তেলাপিয়া! 

কী করবে তুমি?

তালা লাগিয়ে দেব।

ওরা তোমাকে জেলে ঢুকিয়ে দেবে। ওদের টাকা নেতা থেকে পুলিশ সবাই খায়। ওসব করতে যেও না।

শালা আমাকে একদিন ছুটি দিল না। কোনোদিন কামাই করি না। একদিন ছুটি চাইলাম, বলল, পুজোর পরে ছুটি পাবে। হারামির হাত বাক্স। ওকে ছাড়া যাবে না। 

স্টেশন এসে গেছিল। বলল, কপি তুমি যাও। এখন আর কোনো ট্রেন নেই। আমি এখানেই শোবো। সে রেল লাইনের ব্যাগটা মাথায় রেখে শুয়ে পড়েছিল।

 

একটু জোর করলে হয়ত ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু সেটা না করাটাই কাল হল।

 

রাতের মাল ট্রেনে তার দুটো পায়ই কাটা পড়ল। 

 

আসগার আর একাডেমি চত্ব্রে যেতে পারে না। এতে সকলেই হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। কবিরা আবার কবিদের কাজ করছে। কোনো ভয় নেই। উৎপাত নেই। শান্ত পরিবেশে রবীন্দ্রসংগীত গুনগুন করা যায়।

 

কিন্তু কথায় আছে, শত্রু পাল্টানো যায়। প্রতিবেশি পাল্টানো যায় না।

 

ফাইভ স্টার ক্লাবে এখন সে ক্যারাম খেলা ধরেছে। বেটিং করে। হারে। আবার জিতেও যায়। জিতে গেলে আমার অসুবিধা হয় না। কিন্তু হারলেই তাকে মাল খাওয়াতে হবে। মাঝে মাঝে টাকা চায়। বেশিরভাগ সময় কাটিয়ে দিই। এদিকে বাপের সঙ্গে কুস্তি লড়ছে রোজ। ক্লাবে গেলেই খবর পাওয়া যায়। বাপের টাকা নিয়ে জুয়া খেললে বাপ খিস্তি দেবে নাই বা কেন?

 

পত্রিকা প্রকাশের দিন ওকে ডাকা হয়েছিল। ঘরোয়া অনুষ্ঠান। তানিয়া গান গাইল। পুরকায়স্থ কবিতা পড়ল। বিশু বলল স্বদেশ সেনের কবিতা নিয়ে।

 

প্রোগ্রামের শেষে আমাকে ধরল আসগার। অব্দার করে বলল, আমি কি আর কলকাতায় যেতে পারব না কোনোদিন?

কেন যাবে না?

তুমি আমাকে নিয়ে যাবে?

নিশ্চয়। 

 

কথা দিয়ে ফেলেছিলাম ঝোঁকের মাথায়। এবার অফিস থেকে ফেরার পথে শুধু মদ, টাকা নয়; কলকাতা ঘোরার বায়নাও জুড়ে গেল। সে ছাড়বার পাত্র নয়।

 

কোথায় যাবে।

ভিক্টোরিয়া। 

ওখানে গিয়ে কী করবে?

ঘোড়ার গাড়ি চড়ব।

ভিক্টোরিয়ায় যাওয়া হল বটে। তবে দুই পা কাটা মানুষকে নিয়ে তো ঘোরা সম্ভব নয়। আসগারও বুঝে ছিল। বলল, পুষ্পার সঙ্গে একবার দেখা করিয়ে দেবে?

সেটা কি ঠিক হবে?

আমার কাছে ওর নম্বর আছে। তোমার ফোনটা দাও। আমার ফোনে ব্যালেন্স নেই।

 

অতএব, যাওয়া হল পুষ্পার কাছে। সে থাকে একতলায়। ওখানে আসগারকে তোলাটাই সমস্যা। পুষ্পাই ঠিক করে দিল। দুজন চ্যাংরা এসে আসগারকে কোলে তুলে নিয়ে গেল পুষ্পার ঘরে। ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

 

ফেরার সময় বিশেষ কথা হয়নি। কাফকার জন্য মন কেমন করছিল। মনে হচ্ছিল আমি বোধহয় কাফকার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। এবার সে কলকাতায় এলে মুখ দেখাব কেমন করে!

 

যা ভেবেছিলাম - ঘটনাটা আরো গুরুতর হয়ে গেল। 

তখন অফিসে। কাফকা ফোন করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি তিস্তার পাড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি। 

কেন?

স্যুইসাইড করব।

মানে।

গুড বাই।

ফোনটা কেটে দিল সে। যতবার ফোন করি ধরে না। রিং হতেই কেটে দিচ্ছে। কী করব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ, হোয়াটসঅ্যাপে একটা ভিডিও পাঠাল।

 

ভিডিওটা পুষ্পা আর আসগারের। দুই পা কাটা আসগার বিছানায় শুয়ে রয়েছে। আর পুষ্পা তার উপর বসে রতিক্রিয়ায় মগ্ন।

 

এবার ফোন করলে বলল, তুই আমার সঙ্গে এসব করতে পারলি? আমি তো পুষ্পাকে ভালো বেসেছিলাম। এখন এটা যদি বউ দেখে ফেলে? কী হবে আমার?

 

কাফকা তিস্তার পাড় থেকে আবার বাড়ি ফিরে গিয়েছিল। আমি ক্লাবে গিয়ে সটান আসগারের কলার চেপে ধরলাম, এসব কী করেছিস?

আসগারও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছে। ভিডিওর কথাটা বললে জানাল, ওটা পুষ্পা তুলেছিল। তোমার বন্ধুটা হারামি। ও তোমার বন্ধুকে সবক শেখাতে এসব করেছে। 

কাফকা ওকে ভালোবাসে।

বাল ভালোবাসে! ফুর্তি করতে আসে। সেইটা ঢাকতে ভালোবাসার ছল। ওসব মেয়েরা ঠিক বুঝে নেয়।

কলার ছেড়ে দিতে আসগার বলল, আজকে দুটো বোর্ড জিতেছি। মদ খাবে?

 

ক্লাবের ছাদে উঠে আমরা মদ খাচ্ছিলাম। আকাশে চাঁদ। সেদিকে তাকিয়ে আসগার বলল, আমি আর পুষ্পা চাঁদে গিয়েছিলাম। 

চাঁদে?

হ্যাঁ। আরো অনেক জায়গায় গিয়েছিলাম। মঙ্গল গ্রহে। বৃহস্পতিতে। তারপর কী যেন বলে… ও হ্যাঁ… মহাশুন্যে। 

তোর নেশা হয়েছে।

আসগার হেসে বলল, ধুর। নেশা আমার হয় না। তখন তো পা ছিল। পুষ্পা চালাকি করে বেরিয়ে এসে আমাকে ফোন করত। আমরা প্লানেটোরিয়ামে চলে যেতাম। ওখানে গিয়ে একদম শেষের দিকে বসতাম। বিশ্বাস করবে না চাঁদ, মঙ্গল.. এইসব পুরো সত্যিকারের মতো চোখের সামনে চলে আসত। মনে হত, আরে, এই তো চাঁদের মাটি, ওখানে সহজেই হাঁটা যাবে। আমরা একসঙ্গে হেঁটেছি ওসব জায়গায়। 

 

আমি আসগারের পা দেখছিলাম। যেন যে পা কেটে দেওয়া হয়েছে, সেখানে চাঁদের ধুলো লেগে রয়েছে এখনো।

 

ক্লাবের ছাদ থেকে ওকে নামাতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম। আসগার হেসে উঠছিল।

 

ওর হাসিটা মহাশুন্যে ভেসে যাচ্ছিল। 

 

কভার ছবি - করতোয়া সেনগুপ্ত

 





 

1 Comments

Krishnendu Talukdar

10 October, 2024

নকল ভণ্ড বুদ্ধিজীবীদের মুখোশ খুলে দেওয়া গল্প।

Post Comment