বিড়ি খায়, অদ্ভুত ধোঁয়া ছাড়ে। প্রথমে বিড়িটা তর্জনী ও বুড়ো আঙুলের ফাঁকে রেখে একটু রগড়ে নেয়, মানে বিড়ির ভেতরের ঠাসা মসলাটা একটু আলগা করে নেয়। তারপর বিড়িতে আগুন ধরায়। ধরিয়ে আঙড়া মাথাটা মুখে ঢুকিয়ে জোরে ফুঁ দেয়। এবার বিড়িটা মুখ থেকে বার করে এনে সোজা করে টানতে থাকে। সনাতন দা বলে, এটা হল স্বাস্থ্যকর ধূমপান। বিড়ি পাকাতে ছাইয়ের পাউডার লাগে। এক ফুঁয়ে তোর ওই ছাই উড়িয়ে দিলাম সনাতন দা ধরমবীর কলোনির খালপাড়ে থাকে। নাম বাগেরখাল। দরমার বেড়ার ঘর। টিনের চালা। জং ধরে অনেক জায়গায় ফুটো হয়ে গেছে। তাই চালার উপরে মোটা নীল পলিথিন শিটে ছেয়ে দিয়েছে।
সনাতন দা কথা বলে ভালো। জীবন হলো বিড়ির মতো এবং টিনের চালার মতো। বিড়ি যখন পুড়তে থাকে কষ্ট পায় কি? জীবনটা বিড়ির মতো টেনে টেনে পুড়িয়ে উড়িয়ে দাও। জীবন তো টিনের চালা। জং ধরবে, ঝাঁঝরা হবে। নীল পলিথিন শিটে ঢেকে দেবার চেষ্টা করো। না হলে বৃষ্টির জল, চড়া রোদ ঢুকে যাবে!
আমি বলি, নীল পলিথিন শীট কেন?
সে বলে, জীবনটা নীলকণ্ঠ যে! আকাশ নীল, সমুদ্র নীল ছড়িয়ে যেতে চায়!
সনাতন দা'র ঘরের একটু দূরে বজরংবলীর মন্দির আছে। হনুমানজির পেটানো ব্যায়ামবীরের শরীর। তেল জবজবে লাল মেটে সিঁদুর বজরংবলীর গা মুখ জুড়ে ল্যাপটানো। পেটের দিকের পেশীগুলো দেখবার মতো। উঁচু বুক, স্তন দুটো চওড়া ছড়ানো পুরুষ্টু। হাতের মাসল তো নয় যেন ঢিবি! সিনেমার নায়কদের এখন হনুমানজির মত শরীর। এই শরীর তরুণীদের খুব পছন্দ।
মন্দিরের দেয়ালে চারটি ছবি দেখবার মতো। এক, হনুমানজি রাম লক্ষ্মণকে কাঁধে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে। দুই, হাঁটু মাটিতে গেড়ে বুক চিরে ভক্ত হনুমানজি রাম সীতাকে দেখাচ্ছে অথচ একটুও রক্ত ঝরছে না বুক থেকে। তিন, গন্ধমাদন পর্বত হাতের তেলোতে রেখে সূর্য বগলদাবা করে অনুমানজি ধাবমান মহাশূন্যে। চার, পৃথিবীর দীর্ঘতম লেজে অগ্নিসংযোগ করে দৌড়ে দৌড়ে লঙ্কা দহন করছে পবন পুত্র।
সনাতন দা রোজ সকালে হনুমানজির মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে পাঁচ মিনিট হনুমান চল্লিশা পাঠ করে। প্রণাম সেরে খালধার ধরে হেঁটে চলে যায় কাঁচরাপাড়া স্টেশনের দিকে। তখন তার কাঁধে একটা গামছা থাকে। ট্রেন প্লাটফর্মে এসে থামলে সনাতন দা ভেন্ডার থেকে একের পর এক দ্রুত মালের ঝুড়ি নামায় যদি ট্রেন ছেড়ে দেয়! তবে যতদূর জানি ট্রেন একটু বেশি থামাবার শলাপরামর্শ আগেই করা থাকে গার্ডবাবুর সঙ্গে। তারপর সনাতন দা মাথায় করে সমস্ত ঝুড়ি একের পর এক পৌঁছে দেয় মণ্ডল বাজারে। সেসব কোনোটা মাছের ঝুড়ি, কোনোটা সবজির ঝুড়ি। উঁচু উঁচু সব মজবুত ঝুড়ি!
আমি সকালবেলা 'মর্নিং ওয়াকে' যাই। কোনোদিন সনাতন দা'র সঙ্গে খালধার ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি। সনাতন দা'র জানার খুবই আগ্রহ। কলোনি কি, ধরমবীর নাম কেন?
এইসব শুনে আমার জ্ঞানের অহংকার বাড়তে থাকে। আমি বলি, ধর্ম থেকে ধরম শব্দটা এসেছে। এটাকে বলে ব্যাকরণের স্বরভক্তির নিয়ম। ধৃ থেকে ধর্মের উৎপত্তি। মানে ধারণ করা।
সনাতন দা বলে, তাহলে কি দাঁড়ালো? ধর্ম কোনো পুজোআচ্চা নয়?
সনাতনদাকে অশিক্ষিত মনে করে আমার জ্ঞানের বহর আরো বাড়তে থাকে।
আমি বলি, তুমিই ধর্ম। তুমি তোমার মোট বয়ে কুলি হয়ে শ্রম দিয়ে সমাজটাকে ধারণ করে রেখেছো।
সনাতন দা মুচকি হেসে বলে, তাই নাকি!
কলোনি বিদেশি শব্দ। এর মানে উপনিবেশ, অস্থায়ী আস্তানা। সনাতন দা না বুঝেই বলে, ও তাই!
এইবার সনাতন দা প্রশ্ন করে বসে, এই যে এখন সনাতন! সনাতন! বলে শব্দটা খুব চাউর, সনাতন মানে কি? আমার বাবার নাম ছিল হরতন কুর্মী। আমার নাম সনাতন কুর্মী।
আমি বলি, সনাতন মানে চিরন্তন, চিরপ্রবহমান যা অপরিবর্তনীয়।
সনাতন দা বলে ওঠে, তাহলে আমার এই মুটে বওয়া জীবন চিরন্তন, অপরিবর্তনীয়, সনাতন? আমার খালধারের দরমার বেড়ার জীবন, ফুটো চালার জীবন সনাতন!
আমি সনাতন দা'র মুখের দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে মজে যাওয়া খালের তির তিরে স্রোত দেখতে থাকি...