পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

বজ্রমানিক পদাতিক

  • 22 July, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 440 view(s)
  • লিখেছেন : শৈবাল ঘোষ
'মহাত্মা' সম্মাননাকে আমরা হিমালয়ের উচ্চতার মানুষের জন্য সংরক্ষণ করে রাখি। কিন্তু মাঠে ঘাটের ধুলোয় গণমানুষের জন্য কাজ করে চলা কর্মীকেও যে 'মহাত্মা' বলা যেতে পারে সেটা আজিজুল হকের জীবনটাকে দেখলে বিশ্বাস করতেই হয়। সব হারানোদের পক্ষ নিয়ে প্রথম বিপ্লবটা আপনি করেছিলেন নিজের জমিদারি বংশের মধ্যে। নিজের বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে জমিজমা বিলিয়ে দিয়ে ছিলেন নিঃস্ব মানুষদের হাতে। আজিজুল হককে স্মরণ।

আজিজুল হক দা,

গতকাল আপনার চলে যাবার দিনে আবার মাথা নোয়ালাম আপনার উদাসী চোখ আর প্রবাসী হাসির সামনে।

কিন্তু 'স্মৃতিহত্যা'কে ছাপিয়ে আবার মাথা তুলে রাখবো আপনার প্রতিস্পর্ধী মুক্তচিন্তনের অনিঃশেষ রসদের দিকে। হাতের অস্ত্র থেকে মগজের অস্ত্র ধরার নির্জন সরণিতে আপনার সহযাত্রী হবার যোগ্যতা আর ধৃষ্টতা নেই আমাদের। কিন্তু জঞ্জাল-আঁকীর্ণ এই সমাজের অনড় পাথরে আপনি যে ঝাঁকুনি দিয়েছিলেন তার রক্তবীজ ফিরে ফিরে আসবেই। সমাজবিজ্ঞানের মধ্যে বিজ্ঞান আর ইতিহাস কোথা থেকে আসে তার হদিশ তো পেয়েছিলাম আপনারই কথনে। বিজ্ঞান প্রশ্ন করে --- 'কেন' আর 'কেমন করে' ? আর ইতিহাস প্রশ্ন করে --- 'কে, কি কখন' ? তাই ইতিহাসের ফসিল হয়ে আটকে না থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আপনি বিশ্বাস করেছেন --- If any 'ism' is a science, then it has to evolve. There is no last word in science. তাই সমাজের রাস্তা আর গন্তব্যও বদলে বদলে যাবে। এখানেই আপনি 'বিবর্তনবাদী' হয়ে থেকেছেন। কিন্তু সুবিধাবাদের 'শোধনবাদী' হয়ে যাননি ! You've grown from radicalist to being rationalist. Yet few could see your voyage from constructive destruction to a sustainable reconstruction.

'মহাত্মা' সম্মাননাকে আমরা হিমালয়ের উচ্চতার মানুষের জন্য সংরক্ষণ করে রাখি। কিন্তু মাঠে ঘাটের ধুলোয় গণমানুষের স্বার্থে কাজ করে চলা কর্মীকেও যে 'মহাত্মা' বলা যেতে পারে সেটা আজিজুল হকের জীবনটাকে দেখলে বিশ্বাস করতেই হয়। সব হারানোদের পক্ষ নিয়ে প্রথম বিপ্লবটা আপনি করেছিলেন নিজের জমিদারি বংশের মধ্যে। নিজের বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে জমিজমা বিলিয়ে দিয়ে ছিলেন নিঃস্ব মানুষদের হাতে।

আর সাহস ? ইস্পাতে বাঁধানো মনের শক্তি নিয়ে 'shoot-to-kill' order-এর সামনে দাড়িয়েও শীর্ণ শরীরকে ছাপিয়ে গেছেন বারবার। ১৯৭০ থেকে টানা ছয় বছরের জেল-অত্যাচারও আপনাকে ৭৬-এ দুঃসাহসিক জেল ভাঙ্গা থেকে দমাতে পারেনি। এমনকি বাংলা বিহারে দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটির গেরিলা কার্যকলাপ আমাদের বিশ্বাস করতে দেয়নি যে আপনার আগুন তখন নিবে গেছে। 'ব্যক্তি'-মানুষ আর 'সমাজ'-মানুষের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক বিভাজনটাকে আপনি বারবার বেআব্রু করেছেন। মানুষকে সংখ্যা হিসেবে না দেখার কথা মনে করিয়েছেন বারবার। বরং সমাজমুখী মানুষের মননের ওপর প্রত্যয়ী ছাপ ফেলতে চেয়েছেন। ৬০-র দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে আজ অবধি চলা বাম রাজনীতিকে 'বামপন্থা' বলেই বিশ্বাস করেননি আপনি। কারণ সেটাকে existing system-এর মধ্যেই রাজনীতির রূপের একটু অদল বদল বলে মনে করেছেন। আবার সিস্টেমের মধ্যেই তথাকথিত 'পরিবর্তন'-কে কোনো মৌলিক 'রূপান্তর' বলেই মনে করেননি। কারণ আর্থ সামাজিক রাজনৈতিক বিন্যাসের স্রোতের অভিমুখে কোনো রূপান্তর হয় না। স্রোতের বিপরীতেই প্রাণ চলে আর রূপান্তর আসে।

মনে পড়ছে, আপনি বলতেন --- পৃথিবীর বড়লোকদের নিয়ে কোনো সাহিত্য বা কবিতা লেখা হয় না। বরং অভাগা গরিবদের দুঃখ দুর্দশা, আশা নিরাশা নিয়েই কবিতা লেখা হয়, সাহিত্য রচনা হয়। সব ধনী লোকেদেরই প্রকৃতি আর জীবন কাহিনী মোটামুটি একই রকম। শুধুমাত্র quantitative variation আছে। কিন্তু দরিদ্র মানুষদের জীবন আলেখ্যর মধ্যে অনেক বৈচিত্র্য আছে। তাই কবিতা আর সাহিত্য গরিবদের জীবনেই সৃষ্টির উপাদান খোঁজে।

ক্ষমতাসীন বামপন্থীদের লাইনের বিরোধিতা করেও সামগ্রিকভাবে আপনি বামপন্থীদের কাছ থেকে পাওয়া সম্মান হারাননি। দীর্ঘ ১৮ বছরের হাজতবাসে আপনার ওপর তৎকালীন রাষ্ট্রীয় অত্যাচারের কথা জানতে চাইলে আপনার মুখ চোখে কতটা করুণা নিয়ে আপনি বলতেন হাজতের বাইরেই তো এখনও আপনার চেয়ে হাজার গুণ বেশি অত্যাচারিত হয়ে চলে এদেশের কোটি কোটি মানুষ। যে সমাজের সিংহভাগ মানুষ আপনাদের মতো অনুঘটকদের ওপর আস্থা রাখতে পারেনি, আপনাদের সাথে পা মেলায়নি, সেই একই সমাজের প্রতিটি মানুষকেই আপনি সম্মান করতে বলে গেলেন। নবীনদের বলতেন "জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকো, মানুষের কাছে ঋণী থাকো।" শিশুর সরল হাসি মাখা মুখে তাদেরকে বলেছেন --- "We've enjoyed life in love, rejection, repression and agitation. But you're only consuming your life, not quite enjoying it." দর্শন-চিন্তক আজিজুলদার এই মন্তব্য আমাদের মধ্যে এখনও শিহরণ জাগায় ! জেলখানার অত্যাচারে যৌবন হারিয়ে, পঙ্গুত্বে জর্জরিত হয়ে গিয়েও কোনো ব্যক্তি মানুষের ওপর প্রতিশোধ পুষে রাখেননি। বরং লিখেছেন "পেয়েছি সারা অঙ্গে ক্ষত ! অক্ষত শুধু হৃদয়ের ভালবাসা ! ক্ষতের বিনিময়ে ভালবাসা, সেটা কি কম পাওয়া ?" প্রেম আর বিপ্লব কখনও হিসেব করে করতে নেই --- এই দর্শনে বিশ্বাস করে আপনি কাজ করেছেন। ব্যর্থতাকে স্থায়ী মনে করেন নি। বরং তাকে সাফল্যের পূর্বরাগ বলে মনে করেছেন। বিপ্লবের আসল মানে যে ভালোবাসা, সেটা তো আমরা জানতামই না। আপনিই তো আমাদের চেতনাতে ঝটকা দিলেন। শত্রুতা, অত্যাচার, ভাঙ্গন, অন্ধকার পেরিয়েও আপনার কোনও আক্ষেপ নেই, হতাশা নেই, নেতিবাচকতা নেই। অথচ এই নির্বিকার আর অকৃতজ্ঞ সমাজকে ভালোবাসার কথাই বললেন। অন্য পথ দিয়ে হেঁটে এসেও এখানে আপনি মিলে গেলেন রবীন্দ্রনাথের মনে করিয়ে দেওয়া 'নরদেবতার' সাথে। Dogmatism ছেড়ে humanism-কে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। ঠিক যেন রবীন্দ্রনাথেরই মতো ধর্মচিন্তা ছেড়ে 'The religion of man' কে conceive করাতে উত্তরণ ! এই মৃত্যুঞ্জয়ী মানবতাবাদ নিয়ে আপনি আজ মহাকালের সমুদ্রে বিলীন হলেন না। বরং তরী বেঁধে থেকে গেলেন এক বিকল্প-অন্বেষী ভুবন, দেশ আর সমাজের 'মহামানবের সাগরতীরে

 

 

 

 

0 Comments

Post Comment