যে কোন সমাজের বর্তমানের জন্ম ইতিহাসের ধারাবাহিকতায়। আবার সেই ধারাবাহিকতার গতি ধরে বর্তমানই লম্বা-চওড়া করে সেই সমাজের ইতিহাসকে। উপমহাদেশীয় সমাজে বর্তমানের রাজনীতি সেই ইতিহাসের ধারাবাহিকতার ফসল। বর্তমান ভারত কিংবা বাংলাদেশের সমাজ এই ইতিহাসের ধারাবাহিকতারই অংশ, এখানকার ধর্মীয় সংখ্যাগুরু রাজনীতি ও সংখ্যালঘুর রাজনৈতিক নিধনগুলি তার ফলাফল। তাই বর্তমানকে বুঝতে গেলে, সমাধানের খোঁজ করতে হলে, এর গভীরে ঢুকে বুঝতে হবে ঘটনাগুলোর পেছনকার ইতিহাস।
সম্প্রতি বাংলাদেশ কিংবা ভারত জুড়ে যে ধর্মীয় সংখ্যাগুরু রাজনীতি এবং সংখ্যালঘু নিধনের চিত্রগুলি উঠে আসছে তা শুধু 'এই সরকার' কিংবা 'ওই সরকারের' আমলেই ঘটছে এমনটা নয়, এর সাথে জড়িয়ে রয়েছে এই দুই দেশের সমাজের ইতিহাস ও বর্তমানের কাঠামোগত শ্রেণীচরিত্রগুলো। ইতিহাসে এই দুই দেশেরই দেশীয় স্বাধীন(পুঁজি) বিকাশ নষ্ট করেছিল তথাকথিত সভ্য উন্নয়নশীল বিদেশী শক্তিগুলি, বিশেষত, ব্রিটিশশক্তি। সেই সময় (মহাবিদ্রোহের পরবর্তী সময়) থেকে বর্তমান সমাজের শাসকের শ্রেণীভিত্তি-ও প্রস্তুত হয়েছিল বিদেশী উন্নয়নশীল শক্তিগুলির হাতে। ধর্মীয় সংখ্যাগুরুর উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের আদলে সামন্তশ্রেণী-নয়া জমিদারশ্রেণী ও বিদেশী বৃহৎ পুঁজির শক্তিগুলির দ্বারা লালিত-পালিত, তাদের এদেশীয় কার্যকর্তাদের কুক্ষিগত হয়ে(মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া)। পরবর্তীতে এই শ্রেণীভিত্তিকে লক্ষ্য রেখেই বিদেশী শক্তিগুলির দেশভাগ। দেশভাগের পরবর্তী সময় থেকে দেশের 'উন্নয়ন' মানে এককভাবে ধার্য্য হয়েছে বিদেশী নীতিমালা প্রণয়ন। বিশ্বায়ন পরবর্তী সময়ে যার ফুল ও ফল হিসেবে পাওয়া গেল, একচেটিয়া উদারীকরণ-বেসরকারিকরণ। এই নীতিমালা প্রণয়নের প্রয়োগে বিদেশী পুঁজি, বৃহৎ ব্যবসাদারদের দাপট যত বেড়েছে, সেই দাপটকে সিঁড়ি বানিয়ে ধাপে ধাপে বেড়েছে ধর্মীয় সংখ্যাগুরুর উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলি। এর হাত থেকে 'মুক্তি' পেতেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, সংখ্যাগুরুর উগ্র ইসলামিক ধর্মীয় রাজনীতির পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের জন্ম। কিন্তু যে মতাদর্শের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল, বাংলাদেশের জন্মের পর তার সম্পূর্ণ বিকৃতি ঘটলো, মুজিব-বাহিনী বিশ্বাসঘাতকতায়। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্যে মুজিব-বাহিনী গোটা বাংলাদেশ জুড়ে যে ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা কায়েম করেছিল ভারতের সম্প্রসারণবাদী আমলাতান্ত্রিক শাসকশ্রেণীর দৌলতে, তারফলে বাংলাদেশেও ধর্মীয় সংখ্যাগুরুর উগ্র ধর্মীয় রাজনীতির পুনর্জাগরণ শুরু হয়। বাংলাদেশের আমলাতান্ত্রিক শাসকশ্রেণীগুলির অন্দরে ভীত মজবুত হয় উগ্র জাতীয়তাবাদী বোধে উদ্বুদ্ধ ইসলামিক মৌলবাদী মতাদর্শের। বর্তমানের তথাকথিত নতুন বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নিধনগুলি সেই ইতিহাসের ধারাবাহিকতার অংশ।
বর্তমান বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নিধনকে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলি, ভারতরাষ্ট্রের সম্প্রসারণবাদী আমলাতান্ত্রিক শাসকশ্রেণীগুলির স্বার্থে অতিরঞ্জিত করে দেখালেও, মুজিবকন্যা-হাসিনাকে ‘বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের রক্ষাকর্তা’ হিসেবে বিশ্বের চোখে দেখাতে চাইলেও --- এই একই ঘটনার নির্যাস পূর্বেও দেখেছে বাংলাদেশের জনগণ। ফলে ফ্যাসিবাদী হাসিনা, আওয়ামী-বিরোধী গণঅভ্যুত্থানে সংখ্যালঘু হিন্দুদের পক্ষ থেকে বিপুল পরিমাণে জনসমর্থন পেয়েছিল বর্তমানের আমেরিকা-পন্থী ইউনূস সরকার(প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে)। এই গণঅভ্যুত্থান যে পূর্বপরিকল্পিত ছিল তাও স্বীকার করেছে এই সরকার। যদিও বা সেইসময়ের 'বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে'র রাজনৈতিক দাবিগুলির মধ্য দিয়ে তার পূর্বাভাসও খানিকটা মিলেছিল। তারপরেও বলতে হয়, এই সফলতার ইতিহাস রচনার উর্বর জমি তৈরি করেছিল ফ্যাসিবাদী হাসিনার মাত্রাহীন শোষণ ও অত্যাচারের ইতিহাসগুলি।
এই ধর্মীয় সংখ্যাগুরু রাজনীতি, অত্যাচার, নিধনগুলির প্রাথমিক উপলক্ষ ধর্ম হলেও এর নির্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে, তা সংখ্যালঘু’র সম্পত্তি, জমি-শ্রমশক্তি, সঞ্চিত উদ্বৃত্ত লুটের দ্বারাই সম্পন্ন হয়। যার উদাহরণ ভারতের বাবরি মসজিদ ধ্বংস ও রামমন্দির তৈরির মধ্য দিয়েও মিলেছে। অথবা বর্তমানের সংখ্যালঘু নিধনের আইনগুলি, ঘটনাগুলির থেকেও মিলছে। রামমন্দিরের গোটা অঞ্চল জুড়ে এখন বিদেশী পুঁজি'র বৃহৎ ব্যবসাদার ও তাদের এদেশীয় কার্যকর্তাদের ছড়াছড়ি। আর রয়েছে, সমস্ত কিছু হারিয়ে নিঃস্ব হওয়া সংখ্যালঘু, নিম্নবর্ণের সস্তার শ্রমিক। তাই সংখ্যাগুরু নিম্নবর্ণের শ্রমজীবী হিন্দুদের আকৃষ্ট করবার কৌশলে ভারত রাষ্ট্র, আমলাতন্ত্রের আশ্রয় নিতে হয় ‘মন্দির অর্থনীতি‘ মত উদ্ভট, কাল্পনিক অর্থনৈতিক তত্ত্বে। বাংলাদেশে এসবের গতি ভারতের তুলনায় খানিক পিছিয়ে থাকলেও ভবিষ্যৎ একই; ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জমি-শ্রমশক্তি, উদ্বৃত্ত লুট করে তার কিছু অংশ আঞ্চলিক ধর্মীয় সংখ্যাগুরু, সামন্তশ্রেণীর দখল, আর বাকি অংশ বিদেশী পুঁজির বৃহৎ ব্যবসাদার ও তাদের এদেশীয় কার্যকর্তাদের উন্নয়ন।
বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের ‘পরিত্যক্ত সম্পত্তি আইন পাশ’ করে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্পত্তি দখলের প্রস্তুতি শুরু হয়। এরপর সংবিধানের নানা সংস্কার ও সামাজিক আন্দোলনগুলির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যাগুরু রাজনীতি ও সংখ্যালঘু নিধনের রাজনৈতিক জোরশক্তি জাঁকিয়ে বসে রাষ্ট্রীয় চরিত্রে। হাসিনা-আওয়ামী সরকারের আমলে সংখ্যালঘু নিধন প্রতিবছরই অতিরিক্ত মাত্রায় বাড়ে, তার প্রমাণ দেয় তখনকার তথ্যগুলো। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে দ্বিগুন হারে বাড়ে সংখ্যালঘু নিধন, যা নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেন সেখানকার সংখ্যালঘুরা। জানান, ২০১৯ সালে সারা বছর ধরে যে পরিমান নির্যাতন, নিধনের ঘটনাগুলি ঘটেছে, ২০২০ সালের প্রথম ৬ মাসে তার চেয়ে বেশি নির্যাতন, নিধনের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৯ সালে সারা বছরে হত্যার সংখ্যা ১০৮ জন, আহতের সংখ্যা ৪৮৪ জন। আর ২০২০-এর প্রথম ৬ মাসেই হত্যা হয় ৭২ জন, আহত হয় ৫১২জন। একই ভাবে ২০১৯ সালে ভিটে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয় ৪৩৪টি পরিবার, তা ২০২০ সালে প্রথম ৬ মাসেই পৌঁছায় ৪৮৯টি-তে। ২০২২ সালে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ৮৯ হাজার ৯৯০ একর জমি লুঠ, ১৫৪ জনকে হত্যা সহ মোট ২২০ কোটি ৮৯ লাখের সম্পত্তি দখল হয়। ২০২৪ সালের জুলাই মাসের প্রথম দিকের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, হাসিনার আওয়ামী সরকারের শাসনআমলে প্রতিবছরই রমরমিয়ে বেড়েছে সংখ্যালঘু হিন্দু নিধন, যার মধ্যে ৭০ শতাংশই ছিল জমিকেন্দ্রিক, যেখানে ধর্ম কেবল উপলক্ষ, প্রধানত চাই, জমিগুলো। এখন তথাকথিত নতুন বাংলাদেশের ইউনূস সরকারের আমলে মোট ২০০০টি আক্রমণের ঘটনা সামনে আসছে, সংখ্যালঘুদের উপর।
এই সরকার ক্ষমতায় আসে হাসিনার আওয়ামী সরকারের ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ক্ষমতার বিরুদ্ধে ছাত্র ও মধ্যবিত্ত জনতার রাগ, ক্ষোভকে ব্যবহার করে। এর ক্ষমতায় আসবার পেছনেও রয়েছে, বিদেশী বৃহৎ পুঁজির শক্তিগুলির বাংলাদেশে বাজার দখলের লালসা, তাদের অন্তর্দ্বন্দ্বের প্রতিফলন। হাসিনা আমলের বাংলাদেশে ২০১৫-২০১৬ সাল থেকে বিদেশী বৃহৎ পুঁজি চীনা লগ্নি বাড়তে থাকে, তার পরবর্তী সময় জুড়ে নানা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। শেষে, ২০২৪ সালে জুলাইয়ের দশ তারিখ হাসিনা-বাংলাদেশের সাথে সাম্রাজ্যবাদী চীনের স্বাক্ষরিত হয়, মোট ২১টি চুক্তি, এবং ভবিষ্যতে স্বাক্ষরিত করবার তালিকায় থাকে আরও ৭টি চুক্তি। এই স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলোর মধ্যে ‘অবকাঠামো উন্নয়ন’, ‘ডিজিটাল ব্যবস্থার উন্নয়ন’, ‘নানা জায়গার রাস্তা তৈরির কথা ও উন্নয়ন’-এর 'মনের মাধুরী মেশানো' মিষ্টি বুলি থাকলেও প্রধান চুক্তি হয় “চীনের ন্যাশনাল ফাইন্যান্সিয়াল রেগুলেটরি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন(এনএফআরএ) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যে ব্যাংকিং এবং ইন্স্যুরেন্স রেগুলেটরি সংক্রান্ত", চুক্তিটি(এমওইউ)। এটির ফলে বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীর ব্যাংকিং সিস্টেমে বিদেশী বৃহৎ পুঁজির আমেরিকার দখল পুরোপুরি ক্ষমতা চ্যুত হতে পারতো, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের গোটা বাজারে আমেরিকার আধিপত্য হটতে বাধ্য, তার বিপরীতে সমস্ত জায়গায় স্থায়ী পেত আরেক বৃহৎ পুঁজির শক্তি, চীনের একাধিপত্য। যেখান থেকে ইউনূসের হাত ধরে বাংলাদেশের বাজারে আবারও আমেরিকার জাঁকিয়ে বসবার প্রত্যাবর্তন। ইউনূস ক্ষমতায় বসে প্রথমেই উন্নয়নের কাতর আর্জিতে, আমেরিকার সাথে ২০ কোটি ডলারের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন, বাংলাদেশের উন্নয়নে আমেরিকান নীতিমালা প্রণয়নের কথা বলেন, এগুলির বিপরীতে। তার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার স্পষ্ট জানান, হাসিনা আমলের করা প্রতিটি ‘অসম চুক্তি’গুলি পুনর্বিবেচনা করে দেখা হবে। হাসিনা-বাংলাদেশের সাথে চীনের করা অসম চুক্তিগুলোর মধ্যে নানা কায়দায় যুক্ত ছিল ভারতের আদানি গোষ্ঠীর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র(ভারতের মাটিতে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করে সেখানে উৎপাদিত বিদ্যুৎ পুরোটাই বাংলাদেশে রফতানি করার কথা বলা হয়েছিল) ও আম্বানির ‘রিলায়েন্স পাওয়ার’ গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তিগুলো। এই কারণে মূলত, বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানের পক্ষ নিয়ে পশ্চিমী সংবাদমাধ্যমগুলো 'ভারত-চীন-হাসিনা জোট'-এর কথা বারংবার প্রচার করেছিল। ফলে এই মুহূর্তে হাসিনাকে সরিয়ে আমেরিকা-পন্থী ইউনূসের ক্ষমতা দখল চীন ও ভারত, দুই রাষ্ট্রের কাছে প্রচণ্ড সমস্যাজনক। এছাড়াও, ভূ-রাজনীতিতে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে 'জিসমিয়া'(জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন অ্যাগ্রিমেন্ট) এবং 'আকসা' (অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড ক্রস সার্ভিং অ্যাগ্রিমেন্ট) নামের দুটি সামরিক চুক্তিও করতে চলেছে আমেরিকা। আশঙ্কা, যার মাধ্যমে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে আমেরিকান নিয়ন্ত্রণের একাধিপত্য বজায় থাকবে। ফলে দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অর্থনৈতিক, সামরিক ও ভূ-রাজনৈতিক তিনদিকেই প্রবল পরিমাণে ক্ষতি হবে চীন ও ভারত রাষ্ট্রের, এ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে। এই কারণেই আবার ইউনূসের বিরুদ্ধেও তারা সরাসরি, 'কঠোর হাতে' কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। আপাতত তারা প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশের উপর, ইউনূস সরকারের কাছে নিজেদের দরকষাকষির জোরশক্তি বাড়ানোরই চেষ্টা চালাবে, ইউনূসের মাথার উপর থেকে আমেরিকান একাধিপত্যকে নানা ভাবে কমজোরী করতে।
প্রথম থেকে ভারতের আমলাতান্ত্রিক শাসকশ্রেণীগুলি আমেরিকা-পন্থী ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধ। বর্তমান বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নিধনের চিত্রগুলি অতিরঞ্জিত করে তুলে ধরা ও তার মাধ্যমে পূর্বের হাসিনা সরকারের আমলের চিত্রগুলিকে আড়াল করা ভারতরাষ্ট্রের এখনের প্রধান কর্তব্য। তাই ভারতরাষ্ট্র হাসিনাকে নিরাপদ জায়গায় ‘শেল্টার’ দেওয়া সমেত বর্তমান বাংলাদেশ সম্পর্কে অতিরিক্ত পরিমাণে মিথ্যে তথ্য ছড়াতে এতটাই তৎপর যে, সাধারণ সংবাদমাধ্যম তো কোন ছাড়, স্বনামধন্য দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার ৪ঠা ডিসেম্বরে 'উত্তর সম্পাদকীয়'তে ‘চাই সাহসী সিদ্ধান্ত’ নামক নিবন্ধে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব রাজনীতির সদস্য মোহিত রায় লিখেছেন, নানা মিথ্যের ছড়াছড়ি করে, এই বাংলার সংখ্যাগুরু হিন্দুদের আবেগীয় জনমত কুড়াতে, ধর্মীয় হিংসাত্মক(সংখ্যালঘু নিধন) কথা। তিনি, কায়দা করে ১৯৭১ সালের ইন্দিরা গান্ধীর কথা তুলে, বর্তমান বাংলাদেশে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা, ভারতীয় সেনা অভ্যুত্থানের কথাও এই নিবন্ধের মধ্য দিয়ে তুলে ধরতে চেয়েছেন, জনমানসে। এ যে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব শাসকশ্রেণীর ফ্যাসিবাদী বিজেপি সরকারের সম্প্রসারণবাদী চরিত্রের জনমত কুড়ানো ও এই বাংলায় সংখ্যালঘু নিধনের জমির উর্বরতা বাড়ানো, তা বলা বাহুল্য।
বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন ইউনূস সরকার একটি আমেরিকা-পন্থী, নয়া উদারবাদী, বৃহৎ পুঁজির মতাদর্শের সরকার। আমেরিকান মডেলের তথাকথিত উন্নয়ন, ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী। তারা বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দলও তৈরি করবার প্রচেষ্টায় রয়েছেন, বাকিদলগুলোর বিপরীতে, সেই ২০০৪ সাল থেকে। এঁরা যে ইসলামিক মৌলবাদীদের সরকার নয় তা স্পষ্ট। তবে বাংলাদেশের আমলাতান্ত্রিক শাসকশ্রেণীগুলির অন্দরে এই ইসলামিক মৌলবাদী মতাদর্শ অন্তর্নিহিত থাকবার ফলে এবং বর্তমানে দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে ঘিরে মূলত বৃহৎ পুঁজির রাষ্ট্র চীন ও আমেরিকার বাজার দখলের খেলা দ্রুত গতিতে বেড়ে চলবার কারণেই তারা বাংলাদেশের ক্ষমতা ধরে রাখতে ইসলামিক মৌলবাদীদের সঙ্গ নিতে বাধ্য। শুধু ইসলামিক মৌলবাদী নয়, চীন ও ভারত রাষ্ট্র, ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্বের গোষ্ঠীগুলোর সাথেও নানা রাজনৈতিক অঙ্কের সমঝোতা করে চলতে হবে তাদের। নইলে আমেরিকা-পন্থী ইউনূসের বিপরীতে আরেকটা অভ্যুত্থান(সেনা) কেবল সময়ের অপেক্ষা। তাই ইউনূস সরকার, হাসিনা আমলের পূর্বের চুক্তিগুলি এখনো বাতিল করে উঠতে পারেনি, বরং এই সময় বাতিল-না করার পথে হাঁটা শুরু করছে(গতি), আদানির বাংলাদেশের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের এখনের অবস্থা সেই ইঙ্গিত দেয়(বাতিলের বদলে ইউনিট প্রতি পয়সা কমাবার আর্জি জানিয়েছে ইউনূস সরকার, আদানি গোষ্ঠীর কাছে।)। আসলে বর্তমানের ভারত ও বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নিধনের অঙ্ক, ভারতের পরিপূরক হয়ে কাজ করছে। এর রাজনৈতিক ফলাফলগুলির সাথে যুক্ত এই দুইদেশে ভবিষ্যতে বিদেশী বৃহৎ পুঁজির লগ্নি, প্রসার ও জনগণের জমি-সম্পদ লুট, সস্তার শ্রমিকের আমদানি। আবার এগুলিকে সিঁড়ি বানিয়ে ধর্মীয় সংখ্যাগুরুর উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী সংগঠনগুলোর উত্থান, আঞ্চলিক ভাবে জাঁকিয়ে বসবার বীজগণিত-ও রয়েছে এরই মধ্যে।
আজকের আধুনিক বিশ্বে ধর্মীয়-সামন্তশ্রেণীগুলি রাজনৈতিক অর্থনীতিতে অচল, এরা টিকে বিদেশী বৃহৎ পুঁজির লুঠেরাদের সহায়, তাদের এদেশের আঞ্চলিক রক্ষাকর্তা হয়ে। এই দুই দেশের এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির জন্য প্রধান কারণ, বিদেশী পুঁজির বৃহৎ শক্তিগুলোর লাগামছাড়া লুণ্ঠন, উন্নয়নের বিজ্ঞাপনে। যদিও-বা এসবের বিপরীতে প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ বাম শক্তিগুলির ব্যর্থতাও অনস্বীকার্য। তারা বস্তুনিষ্ঠ মতাদর্শের সংগ্রাম, শ্রেনীলাইন ও এই দুই দেশের সমাজের উৎপাদন সম্পর্কের পরিবর্তে অতিরিক্ত পরিমাণে বেশি জোর দেয় আবেগঘনিষ্ঠতার ভাববাদী দর্শনে, শ্রেনী লাইনের বদলে গণলাইনে ও রাষ্ট্রের উপরিকাঠামোতে। তাই বিভিন্ন অঞ্চলের সংখ্যালঘু নিধনের ঘটনাগুলিও বিনা বাধায়, প্রতিরোধে বেড়ে চলে দ্রুততার সাথে, যা ছড়িয়ে পড়ে সমাজে নিত্যনতুন হিংসার জন্ম দেয়, পুনঃরায়। আর বর্তমানের ফলাফল হিসেবে উঠে আসে সমাজে। এগুলি সমাজে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ধর্মীয় সংখ্যাগুরুর ফ্যাসিবাদী রাজনীতির জমি মজবুতের কাজ করে চলে নিঃশব্দে, ভারত ও বাংলাদেশ, দুই দেশ জুড়ে।