অভিধান
একদিন সকালে স্যরের কাছে পড়তে গেছি । সদ্যই তখন আমি আনন্দমোহন কলেজের প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছি । পড়ার ফাঁকে স্যরকে ‘etymology’ শব্দটির অর্থ জিজ্ঞেস করতে স্যর একটি অভিধান পেড়ে আনতে বললেন । ডিকশনারির একটা আলাদা তাক ছিল । নির্দেশিত অভিধানটি ছিল জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস-এর বাঙ্গলা ভাষার অভিধান, সাহিত্যসংসদ । মুখবন্ধটি পড়তে বললেন চেঁচিয়ে: ‘কোন দুরূহ শব্দের সম্মুখীন হইলে আমরা বিজ্ঞ ব্যক্তিকে তাহার অর্থ জিজ্ঞাসা করি । কিন্তু সেই ব্যক্তি যথার্থ প্রাজ্ঞ হইলে উত্তর দিবেন, “অভিধান দেখিয়া লও ।” ইহার কারণ কি [sic.] ?’অভিধান’ গ্রন্থ কি শব্দার্থসংগ্রহ মাত্র নয় ? …’ স্যর থামতে বললেন । মগজে তড়িচ্ছটা ! মুহূর্তে বুঝে গেলাম, এবার থেকে নিজেকেই অভিধান দেখে নিতে হবে । স্যর শেখালেন, স্মৃতি থেকে উল্লেখ করা, উদ্ধৃতি দেওয়া একেবারেই অনুচিত । বললেন, ‘না দেখিয়া আপন নয়নে বিশ্বাস কোরো না কভু গুরুর বচনে ।’ প্রথমেই শুরু হলো অভিধান দেখতে শেখার ক্লাস । “ডিকশনারির প্রাক্কথন থেকে শুরু করে পরিশিষ্ট, সবই প্রয়োজনীয়।“বললেন স্যর । বুঝিয়ে বললেন, শব্দার্থ হৃদয়ঙ্গম করতে গেলে খুঁটিয়ে পড়া কতটা অপরিহার্য । ‘শব্দ’কে বৃক্ষ চিত্রকল্পে দেখতে শিখলাম সেদিন । ‘অক্ষরে অক্ষরে’ চিনিয়েছিলেন গাছের শিকড়ের আপাত অদৃশ্য বিস্তার, তার শাখা-প্রশাখায়, পত্রপল্লবে শিরা-উপশিরার অস্তিত্ব উপলব্ধি । সেই দিন থেকে অভিধান হয়ে উঠল নিত্যসঙ্গী, কাজ সহজ হোক বা দুরূহ, অভিধান দেখে মিলিয়ে নেওয়া চাই-ই । শুধু একটিই নয়, কতরকমের অভিধান ছিল স্যরের । নতুন সংস্করণ বেরোলেই সেটি সংগ্রহ করতেন । আর ছাত্ররা প্রিফেস পড়ে বুঝে নিতে শিখত নতুন কী কী সংযোজিত হলো । স্যরের ‘খুঁটিয়ে পড়া’র নমুনা থাকত প্রতিটি প্রবন্ধর মজার মজার আকর্ষণীয় শিরোনামে । দুই-একটি উদাহরণ দিই : How Not to Study Shakespeare …; “To Autumn”: The Odd Ode Out; Responses to Alice: Nonsense Made of Nonsense; না-জানা রামমোহন ; বিভ্রান্তিবিলাস : সহবাস-সম্মতি আইন ও বিদ্যাসাগর । এমন অসংখ্য মণিমুক্তো ছড়িয়ে আছে স্যরের বিবিধ রচনায় । অক্ষরে অক্ষরে দেখি সীমার মাঝে অসীমের বাস ।
সেই অকৃতকার্য ছাত্রটি
আনন্দমোহন কলেজে ক্লাসভর্তি দুর্বল ছাত্রর দল । স্যর পড়াতেন এমনভাবে যেন সকলেই চেষ্টা করলে অনার্স পেয়ে যাবে । প্রতিটি ছাত্রর অন্তর জানত এই মানুষটির বিপুল হৃদয়ের খবর । তবে সাহস করে সেই রাশভারি আবরণ পেরিয়ে অনেকেরই পৌঁছনো হতো না স্যরের কাছে । জ্ঞান এবং সচ্ছলতায় পেছিয়ে পড়া ছাত্রকুল আজন্ম কুন্ঠিত । যে কয়েকজন সেই দ্বিধার গণ্ডি ডিঙিয়ে স্যরের সান্নিধ্য-সীমা ছুঁয়েছে সাহস করে, তারা চিনেছে অন্য এক পৃথিবী । ইংরেজি সাহিত্যর সুবিশাল জগতের সামান্য যা কিছু স্নাতকস্তরের সিলেবাসে পাঠ্য ছিল স্যর বুঝিয়ে দিতেন সাবলীল । ছাত্রদের একটি অনুরোধেই স্যর পড়িয়ে দিতেন কোনো শিক্ষকের না-শেষ করা সিলেবাস । ‘ম্যাকবেথ’-এর মতো শক্ত নাটক যিনি পড়াবেন তিনি একটি দৃশ্য পড়িয়েই সেই যে উধাও, দেখা নেই । ছাত্ররা স্যরকে সমস্যা জানাতেই উনি পড়িয়ে দিলেন গোটা একটা নাটক । প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি চরিত্র ছাত্রদের সামনে এসে দাঁড়াত । স্যর বলতেন, ‘নতুন কিছু পড়াতে আমার সর্বদাই ভালো লাগে । আনন্দ পাই ।’ অথচ বহু শিক্ষক একই বিষয় পড়াতেন বছরের পর বছর । সিলেবাস পালটে দিলে অনুযোগ করতে শুনেছি ।
ছাত্ররা স্যরের সাহায্য চাইলে – বিশেষত, সচ্ছলতায় যারা দুর্বল – স্যর সময় করে পড়া বুঝিয়ে দিতেন কলেজে কোনও ফাঁকা ক্লাসরুমে । অথবা, কাজের ফাঁকে হাতিবাগানে ‘চেতনা’-র লাইব্রেরি ঘরে । এমনকি শ্যামবাজারের ঐতিহাসিক ‘ধাঁধা’ পত্রিকার ঘরেও । স্যরের স্বচ্ছন্দ বিচরণের পথে যত্রতত্র জায়গা করে নিয়ে বসে পড়তেন আলোচনায় । পড়া বুঝিয়ে দিতেন । আর ৩ নং মোহনলাল স্ট্রিটের চারতলায় তো ছিল তরুণ হাঁ-করা ছাত্রদের জাতীয় গ্রন্থাগার । সিলেবাসের বাইরের জগতের আদিগন্ত বিস্তার ।
এমনই এক নিম্নবিত্ত ছাত্র ছিল । অভাগা সে ছাত্রটি পার্ট ওয়ান পেরোলেও পার্ট টু-তে আটকে গেল । অনার্স পাওয়া তার হলো না। গাঁ-এর ছেলে । শহরে মেসে থেকে পড়ত । রেজাল্ট বেরোতে সেই ছাত্রটি এসে স্যরকে প্রণাম করে বলেছিল, ‘আপনি অনেক সাহায্য করলেন, স্যর । কিন্তু হলো না আমার । আচ্ছা স্যর, পাশ হয়ত আমি করতে পারলাম না, কিন্তু এই যে ম্যাকবেথ পড়লাম, প্যারাডাইস লস্ট পড়লাম, তা তো কেউ কেড়ে নিতে পারবে না আমার থেকে ।’
তবু স্নেহ নেত্র জাগে ধ্রুবতারা
এই ছাত্রটির কথা বলতে গিয়ে স্যরের গলা ধরে যেত । চোখ ভিজে যেত । বলতেন, ওই-ই আমার আসল ছাত্র । এমন নগণ্য ছাত্রর সংখ্যা ছিল অগণন । শিক্ষা ও চিন্তা জগতে এক মহীরুহর আশ্রয়ে ছিল তাঁর ছাত্ররা । আজ কি তারা তবে আশ্রয়হীন ? না । বটানিক্যাল গার্ডেন-এর সেই বটবৃক্ষর কথা ভাবুন পাঠক । যার মূল কেন্দ্রটি বহুকাল নেই । কিন্তু রয়ে গেছে শাখায় প্রশাখায় ঝুড়িতে ঝুড়িতে তার ব্যাপ্তি । স্যর তাঁর প্রতিটি ছাত্রকে শিখিয়েছিলেন আত্মদীপ হতে । অনন্যশরণ হতে । স্বাবলম্বনের সেই শিক্ষায় প্রত্যেকেই হতে পারে এক একটি বটবৃক্ষ । হতে পারে সেই চিরসখা যিনি সংসারগহনে নির্ভয়নির্ভর, অধনের ধন, অনাথের নাথ, অবলের বল । স্যরও ছিলেন আমাদের চিরসখা । প্রায়শই বলতেন, ‘Foolproof’ method মেনে চলতে । নিজে মেনে চলতেন । অর্থাৎ এমন সহজ করে কাজ বোঝাতেন যাতে একজন বোকা, পিছিয়ে পড়া মানুষও নির্দেশটি বুঝতে পারে । এক অর্থে ম্যান ম্যানেজমেন্টের মৌলিক শিক্ষা । ফলত, গবেষণার কাজে এমন অনেক সহযোগী তিনি পেতেন যাঁরা প্রথাগত শিক্ষায় আদৌ প্রতিষ্ঠিত নন । কিন্তু তাঁদের স্যর হাতে ধরে প্রশিক্ষিত করে নিজের কাজের উপযুক্ত করে নিতেন । আর এভাবেই সফল তাঁর বিশ্ববিশ্রুত কাজের ধারা । Academia.edu বা ResearchGate-এ স্যরের প্রোফাইল খুললেই তাঁর প্রবন্ধগুলির পাঠকসংখ্যা দেখা যাবে । তাঁর জীবন্ত সংযোগ থাকত আমজনতার সাথে । তাঁর সঙ্গে ‘যোগ’ থাক বা ‘অযোগ’ তাঁর স্নেহনেত্র বিস্তৃত থাকত সর্বত্র ।
Perfection is not a virtue, but a DUTY
তাঁর লেখার প্রুফ দেখতে দিলে স্যর এই বাক্যটি শোনাতেন : ভুল দেখলেই শোধরাও । আর, বার বার দ্যাখো ভুল কিছু না কিছু পাবেই । এবং পেলেই তা শোধরাও । ক্রমাগত এমন অনুশীলনের মধ্যে থাকতে থাকতে সাধারণ মানের ছাত্রদেরও নির্ভুল ছাপার ব্যাপারে সতর্ক সচেতনতা এসে যেত । এই শিক্ষাটি আমাদের সকলের সারা জীবনের শিক্ষা । এই সেন্স অফ ডিউটি থেকেই স্যর গবেষণাক্ষেত্রে তাঁর পূর্বসূরীদের ভ্রম সংশোধন করতেন । এই ছিল তাঁর ঐতিহাসিক দায় । উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, স্যরের রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান সম্পর্কে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দেওয়া । রামমোহন লাইব্রেরি প্রকাশিত পৌত্তলিক প্রবোধ রচনাটি যে রামমোহন রায়-এর (ব্রজমোহন দেব ছদ্মনামে) তা আমরা প্রথম জানতে পারি তাঁরই উদ্যোগে । ভূমিকাতে রা.ভ. লিখছেন :
প্রথমেই বলা দরকার – উনিশ শতকের গোড়া থেকে তখনকার বাঙলায় অর্থাৎ এখনকার পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশে যা কিছু ঘটেছে, তার প্রায় সবকিছুরই অগ্রদূত ছিলেন রামমোহন আর বিদ্যাসাগর । এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে হাতে ও কলমে তাঁরা কাজ করেন নি । শুধু বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য নয়, বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতির যে রূপ গত দুশ বছরে গড়ে উঠেছে, তার প্রায় সব ক্ষেত্রেই তাঁদের কিছু-না-কিছু দান ছিল । শুধু হিন্দু বাঙালি নয়, ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে গোটা বাঙালি জাতির নতুন আত্মপরিচয় অর্জন করার পেছনে অবদান রয়েছে তাঁদের ।
সমাজ সংস্কারক রামমোহনের পাণ্ডিত্যর দিকটি অনেকটাই অজানা ছিল আমাদের কাছে । ‘ভারতপথিক’ রামমোহন যে ‘বিশ্বপথিক’ ছিলেন সেকথা বিশদে জানা যায় রা.ভ.-র দুটি প্রবন্ধে ‘বিশ্বপথিক রামমোহন’ ও ‘না-জানা রামমোহন’ । আমরা জানতে পারি কীভাবে রামমোহনের গবেষণা-কাজ ও ভাবনা প্রশংসিত হয়েছে ইওরোপের ভারতবেত্তা ও বিদ্বানমহলে । হোরেস হেমান উইলসন, মাক্স্ ম্যুলার, মরিস ভিন্টারনিৎস্ ছিলেন রামমোহনের অনূদিত উপনিষদ ও অন্যান্য কাজের গুণগ্রাহী ।
অন্যদিকে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান নিয়েও সুগভীর চর্চার পরিচয় দিয়েছেন স্যর । প্রমথনাথ বিশীর সূত্র ধরে রা.ভ. পাঠকের সামনে আনলেন শিক্ষা পরিষদের সচিব এফ. আই. মৌআটকে লেখা বিদ্যাসাগরের চিঠি যাতে বিদ্যাসাগর জানাচ্ছেন বেদান্ত ও সাংখ্য ভ্রান্ত দর্শন । জানতে পারি কীভাবে কলম ধরেছিলেন বিদ্যাসাগর নব্যন্যায়ের বিরুদ্ধে । নিয়েছিলেন শিক্ষাসংস্কারের উদ্যোগ । স্যর জানালেন বর্ণপরিচয়-এর বিরুদ্ধে জন মার্ডকের অভিসন্ধির কথা । ঈশ্বরভাবনা প্রসঙ্গ কেন আনেন নি বিদ্যাসাগর তাঁর শিশু পাঠ্যক্রমে ? বিদ্যাসাগরের রচনার গুণেই ভেস্তে গেল মার্ডকের চক্রান্ত । রা.ভ.-র গবেষণায় আমরা জানতে পারি কীভাবে প্রশংসিত হয়েছিলেন বিদ্যাসাগর জার্মান ভারতবেত্তাদের কলমে । তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্য বইগুলি, তাঁর বিধবা বিবাহর উদ্যোগ, তাঁর করা সংস্কৃত ও ইওরোপীয় মূল বইগুলির অনুবাদ । এই সকল কাজের স্বীকৃতি পেয়েছিলেন বিদ্যাসাগর জার্মান বিদ্বানদের কাছে । তাঁকে জার্মান প্রাচ্য সমিতির সহযোগী নির্বাচিত করা হয়েছিল ।
আবার স্মরণ করতে হয় সেই চেতাবনি, perfection is not a virtue, but a duty । খুঁটিয়ে না পড়লে এমন বহু বিষয় যা কৃতবিদ্য জীবনীকারদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে এযাবত, রা.ভ.-র চোখে ধরা পড়ত কি ? তাঁর ‘foolproof’ গবেষকমন এই ভ্রম সংশোধনের জন্য কলম ধরেছেন । শুধুই কি রামমোহন ও বিদ্যাসাগর, আজ পর্যন্ত প্রকাশিত উনচল্লিশটি বইয়ের ছত্রে ছত্রে এমন না-জানা কত তথ্য রয়েছে ? কত সামান্য জানি । তাই যা ছোঁয়া হলো তা বিন্দুবৎ মাত্র। ব্যাপ্তি এতটাই যে তাঁর অবর্তমানে তাঁর কাজের মূল্যায়নের জন্য বহু গবেষককেই নিরলস কাজ করতে হবে ।
হ্যাঁ, কাজ করতে হবে নিরলস । যেমনটি স্যর নিজে করতেন । তাঁর চারতলার পড়ার ঘরে সৃষ্টির কারখানায় ছিল সহযোগীদের আনাগোনা সকাল থেকে রাত । প্রত্যেকের সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন কাজ । ক্লান্তিহীন বই ঘাঁটা (তাতে পাখির চোখ দুটি শব্দে – পারফেকশন আর ফুল্প্রুফ) এবং ডিক্টেশন । আমাদের বিস্মিত চোখের সামনে তাঁর কাজ ডানা মেলে পাড়ি দিচ্ছে দেশ থেকে বিদেশে । বিপুল তার বিস্তার । অপরিমেয় গভীরতা । একদিকে আসছে স্বীকৃতি-সম্মান, অন্যদিকে কমে আসছে আলো – দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর । জানুয়ারি ২০০০, স্যর জেনে গেলেন তাঁর একটি চোখের দৃষ্টি চিরবিশ্রামে । আমাদের শিক্ষক নির্বিকার, নেই কোনো হুতাশ । কাজের গতি গেল বেড়ে । ওই সময় পর্যন্ত প্রকাশিত ছিল চারটি বই । আর, গত দুই দশক পাঠককে উপহার দিয়েছে রা.ভ.-র আরও পঁয়ত্রিশটি প্রকাশিত বই – জীবনের শ্রেষ্ঠতম গবেষণাকর্ম ও তার স্বীকৃতি এই দুই দশকেই । এই সময়েই নামী পাশ্চাত্ত প্রকাশনা সংস্থা প্রকাশ করেছে তাঁর মহামূল্যবান তিনটি বই – Studies on the Carvaka / Lokayata ; More Studies on the Carvaka / Lokayata ; Origin of Geometry in India. একদিকে সহযোগীদের নিত্য দুশ্চিন্তা তাঁর ক্ষীণ হয়ে যাওয়া দৃষ্টি নিয়ে । আর স্যর বলতেন, ‘চলো, অনেক গল্পগাছা হল্ এবার কাজে লাগা যাক।’ চোখের এই অনিবার অসুস্থতা নিয়েই রা.ভ. ছুটে গেছেন দেশের প্রান্তে প্রান্তে – সেমিনারে, অথবা কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীছাত্রদের পড়াতে – ইংরেজি, বাংলা, সংস্কৃত, ইতিহাস, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান প্রভৃতি সকল ডিসিপ্লিনেই স্যর ছিলেন স্বচ্ছন্দ । তবে তাঁকে থামতেই হলো অবশষে । করোনা-সতর্কতার কারণে বন্ধ হলো ঘোরাঘুরি । সহযোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ শুধুই মোবাইল ফোনে । কারখানা সাময়িক বন্ধ। তবু সহযোগীদের সঙ্গে সৃষ্টির কাজ চলল টেলিফোনিক ডিক্টেশনে । কাজ চলছে ঢিমে তালে । তখনও বন্ধুরা মেইল পাচ্ছেন মাঝে মধ্যেই – ‘নতুন লেখা’ । তবে দৃষ্টি আর সহযোগিতা করছিল না । ক্রমশ চোখের আলো নিভে আসছিল । কিন্তু অন্তর্দৃষ্টি ছিল প্রখর । এবং তা ছিল শেষ দিনটি পর্যন্ত ।
সবশেষে বলি, স্যরের মেলামেশার গণ্ডি ছিল বৃহৎ । সহজ বিচরণ ছিল উঁচু ও নিচু সকল স্তরেই । তাঁর জীবনদর্শন নিহিত ছিল মার্কসবাদে । ছিল সুগভীর আস্থা, অনুশোচনাহীন । সেই বিষয়টিতেও ছিল খুঁটিয়ে পড়ার অভ্যাস । নবীন পাঠকের কথা মনে রেখে সহজ ভাষায় মার্কসীয় দর্শন আলোচনা করেছেন কয়েকটি বইতে :মার্কসবাদ জিজ্ঞাসা, দ্বন্দ্বতত্ত্ব জিজ্ঞাসা, বস্তুবাদ জিজ্ঞাসা, মার্কসীয় নন্দনতত্ত্ব এবং সবশেষে, কমিউনিজম কী ? মার্কসবাদের আলোকে দীপ্ত ক্ষুরধার লেখনী শানিত বিতর্কে খণ্ডন করেছে অহংকারী গবেষকের ভ্রম । তবে এমন সুদৃঢ় বিশ্বাস কখনও সংকীর্ণ করে নি তাঁর মন । স্যরের স্নিগ্ধ আলাপন ও মানবিক বন্ধুতা বিস্তৃত করেছে তাঁর স্বজনসংখ্যা, আত্মীয়তা । তাঁর মতে বিশ্বাসী না হয়েও তাঁর স্নেহধন্য থেকেছেন অনেকেই ।