Do not be idolatrous about or bound to any doctrine, theory or ideology, even Buddhist ones. Buddhist systems of thought are guiding means ; they are not absolute truth.
(Interbeing : Fourteen guidelines for Engaged Buddhism, Thich Nhat Hanh)
গাইড লাইনের চোদ্দটি সূত্রের প্রথম সূত্রটি পাঠ করেই চমকে উঠেছিলাম। বলে কি ! কোন বিশেষ তত্ত্ব, আদর্শ বা নীতিকে আরাধ্য আসনে স্থাপন কোরো না। এমনকি সেটা যদি বৌদ্ধ সূত্র হয়, তাকেও আরাধনা করোনা। বৌদ্ধ ধর্মমত চিন্তার একটা পদ্ধতি মাত্র। কিভাবে চিন্তাভাবনা করতে হবে, সেটাই শেখায়। বৌদ্ধমত গুলিও চরম সত্য নয়। কিন্তু অনতিবিলম্বেই চমক ভাঙলো, মনে পড়লো ভগবান বুদ্ধ তার অনুগামী আনন্দকে কি বলেছিলেন? এ তো সেই একই কথার প্রতিধ্বনি। আত্মদীপ ভব। আত্ম শরণ্ ভব। অনন্য শরণ্য ভব। নিজেকে প্রদীপ করে তোলো, সেই প্রদীপের আলোয় নিজেই নিজের পথ খুঁজে নাও। অন্যের শরণ নিও না।
এ তো কোন ধর্মমত নয়। এ কোন বিশ্বাসের কথাও নয়। বরং এখানে অনুসন্ধান ও সত্যকে নিজের বিচার বোধ দিয়ে যাচাই করার কথা বলা হয়েছে। এমন কথা তো কার্ল মার্কসের লেখাতেও পেয়েছি যে, সংশয় একটি বড় মানবিক গুণ। সবকিছুকে যাচাই করা ও অন্ধত্ব বর্জন করা। আর চরম ধ্রুব সত্যের ধারণার বিরোধিতা করেছিলেন মাও সে তুঙ। তিনি শ্রেণী সংগ্রাম কে একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া (কন্টিনিউয়াস প্রসেস) বলেছিলেন। এটা চলতেই থাকবে। ইস্পাত কে ঠান্ডা হতে দিলে সে একটি বিশেষ আকৃতি বা শেপ গ্রহণ করবে। তাই তাকে নিরন্তর উত্তপ্ত রাখতে হবে। যাতে প্রাতিষ্ঠানিকতা, নির্দিষ্ট ফর্ম যেন তাকে গ্রাস না করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি নিজে পার্টির সদর দপ্তর এর একজন সদস্য হয়েও আহ্বান জানিয়েছিলেন, সদর দপ্তরে কামান দাগো (Bombard the Head Quarter)। বৌদ্ধ ধর্মের ১৪ টি সূত্রের প্রথম সূত্রের কথাই কি এখানে শুনতে পাচ্ছি না?
থাক সে কথা। আমার বলার বিষয় কিছুটা ভিন্ন। চিন্তাভাবনা দৃষ্টিভঙ্গির একটি পদ্ধতি নির্মাণ করার চেষ্টা আমরা দেখেছিলাম ১৫৮২ সালে। মুঘল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে। তাঁর সাম্রাজ্যে বহু সংখ্যক জাতি ধর্ম ভাষা সম্প্রদায়ের মধ্যে সহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক সম্মান মর্যাদা গড়ে তুলতে প্রয়াসী হন। ফতেপুর সিক্রিতে ইবাদৎখানা হলে ধর্ম মত নির্বিশেষে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সুফি - সন্ত - পীর ফকির - দরবেশ - যাজক - ঋষি - পাদরী - পুরোহিত সকলের সাথে খোলা মনে দিবারাত্রি আলোচনা করেন। সকল ধর্মের সার সত্যকে উপলব্ধি করতে সচেষ্ট হন। কোনো মতকেই তিনি পরিপূর্ণ গ্রহণ বা বর্জন করেন নি। বরং এগুলির সংশ্লেষণ করে, সার সত্য কে বুঝতে চেয়েছেন। সকল ধর্মের মূল নির্যাস কে উপলব্ধি করতে চেয়েছেন। সেই উপলব্ধি পরমত সহিষ্ণুতা বা সুহল ই কুল। যা শেষ অবধি দিন ই ইলাহী নামে পরিচিত।
এই দিন ই ইলাহী কি নতুন কোনও ধর্ম মত? এটা কি ইসলাম বিরোধী মতবাদ? এর মধ্যে সুফি প্রভাব কতটা? এই মতবাদ কি সকল ধর্ম মত বিদ্বেষী? হঠাৎ এমন একটি নতুন ধর্ম চালু করলেন কেন? এসব নানান প্রশ্নের ভিড়। লক্ষ্য করার বিষয়, আমার ধারণা আকবর তার এই নতুন উপলব্ধি বা চিন্তা ভাবনাকে একটি ধর্মমত হিসেবে প্রচার করতেই চাননি। তিনি সমাজ ধর্ম জগৎকে দেখার একটা দৃষ্টিভঙ্গি, একটা মনোভাব, গাইড লাইন গড়তে চেয়েছিলেন মাত্র। এটা নিয়ে বহু মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি আছে যে, কেন তিনি একটি নতুন ধর্ম দিন-ইলাহী প্রচলন করলেন। এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে যে --
১) একটি ধর্মের অন্যতম অবলম্বন হলো একটি ধর্মগ্রন্থ, যা দিক নির্দেশ করে। দিন ই ইলাহী র কোন নির্দিষ্ট ধর্মগ্রন্থ ছিল না। এটা ছিল একটা ভাব, একটা উপলব্ধি।
২) এরপরেই প্রশ্ন আসে, যে কোন ধর্ম একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, মন্দির, মসজিদ, গির্জা, গুরুদ্বার, একটা উপাসনা কেন্দ্রকে অবলম্বন করে পরিচালিত হয়। দিন ই ইলাহীর কোন ধর্ম প্রতিষ্ঠান, উপাসনা কেন্দ্র ছিল না।
৩) প্রত্যেক ধর্মের নিয়ম রীতি পরিচালনা তদারকি গাইডলাইন দেখাশোনার জন্য একদল যাজক সম্প্রদায় থাকে। ধর্ম প্রচারক থাকে। দিন ই ইলাহীর ক্ষেত্রে কোন যাজক প্রচারক সম্প্রদায় ছিল না।
৪) ধর্ম মানেই তো কিছু আচরণ বিধি। এটা করা উচিত, ওটা করা উচিত না।।এই দিকে মুখ করে উপাসনা করো, ওই দিকে কোরোনা। এটা খাবে না, ওটা খাবে। এই মন্ত্র উচ্চারণ করবে। অমুক তিথিতে, তমুক বারে, এটা করতে হবে, ওটা করা যাবে না। দিন ই ইলাহীতে এমন কোন আচরণবিধি ছিল না।
তাহলে বিষয়টা দাঁড়ালো কেমন? একটি ধর্ম আকবর প্রবর্তন করলেন, যে ধর্মের কোন প্রচারক নেই, কোন মন্দির মসজিদ প্রার্থনা গৃহ নেই, কোন আচরণ বিধি বিধি নিষেধ নেই, কোন ধর্মগ্রন্থ নেই, তার মানে তো ধর্মটাই নেই, তাই না? এটা এমন এক বাড়ি যার দরজা নেই, জানালা নেই, ছাঁদ নেই, দেয়াল নেই, সিঁড়ি নেই, আসবাবপত্র নেই। তার মানে আসলে বাড়িটাই নেই। যেটা আছে, বাড়ির একটা ভাব, একটা ধারণা। উল্লেখযোগ্য আকবর এই মতকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। ফলে এই মতাদর্শ গ্রহণ করেছিল এমন কোন তালিকা ও পাওয়া যায় না। যে গুটি কয়েক নাম পাওয়া যায় সেগুলো অন্যের লেখা ও উদ্ধৃতি থেকে। যদি এটা পৃথক কোন মত হতো তাহলে রাজ অনুগত, পাত্রমিত্র, আমাত্যরা সকলেই এই মত গ্রহণ করতেন। অন্তত রাজ শক্তির চারপাশে স্তাবক তোষামুদের ভীড় তো কম থাকে না। তারা দলে দলে এই মত গ্রহণ করেছিলেন এমন তথ্য পাওয়া যায় না।
আমার ধারণা একটা সু বিশাল সাম্রাজ্য। সেই সাম্রাজ্যের ধর্ম ভাষা জাতি গোত্র এসবের বহুত্বকে স্বীকার করতে গিয়ে, যদি আকবর আরেকটি নতুন মত অর্থাৎ সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দোকান খুলতেন, তাহলে বহুমতের সংশ্লেষণের পরিবর্তে বিশ্লেষণ জোরালো হত। তাই আকবর দিন ই ইলাহী ঘোষণা করলেন। এটা শুধুই একটা দৃষ্টিভঙ্গি, একটা ভাব। একটা রাষ্ট্রীয় আদর্শ। আজ থেকে সাড়ে চারশো বছর আগে এমন উন্নত আধুনিক ধারণা বাস্তবিকই অবিশ্বাস্য। বুদ্ধের মতবাদ পড়তে গিয়ে তখন মনে হচ্ছিল, এতো যেন একই কথা। বৌদ্ধ ধর্ম চিন্তা তরিকা শেখায়, ভাবনার গাইডলাইন দেয়। কিন্তু কোন নির্দিষ্ট ভাবকে ধরিয়ে দেয় না। আকবরও রাষ্ট্রের প্রশাসক কর্মচারী কর্মকর্তাদের, প্রজাদের একটা দৃষ্টিভঙ্গির ধারণা দিয়েছেন। কিন্তু কোন নির্দিষ্ট মতকে, ভাবকে ধরিয়ে দেননি।
আমরা যেকোনো কথায় পশ্চাদপদতা বোঝাতে, মধ্যযুগীয় ধারণা বলে নিন্দা সূচক শব্দবন্ধ ব্যবহার করি। কিন্তু সেই মধ্যযুগে আকবর একটি আধুনিক চিন্তার জন্ম দিয়েছিলেন।