পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

গ্রামবাংলার রাজনীতি (তৃতীয় অংশ)

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 204 view(s)
  • লিখেছেন : পার্থ সারথি
শ্রমিক-কৃষক জনতার জঙ্গী আন্দোলন যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর ক্রমশ উত্তাল হয়ে উঠলে ফ্রন্ট নেতৃত্ব তাকে আইনি ও সাংবিধানিক সীমার মধ্যে বেঁধে রাখতে মনোযোগ দিল, যদিও তেভাগার মতো এই সময়েও কৃষক আন্দোলন পার্টির বেঁধে দেওয়া গন্ডি ছাপিয়ে গেল, লালঝাণ্ডা পুঁতে ভূস্বামীদের জমিদখল নিত্যকার ঘটনা হয়ে উঠল, জোতদার-ভিত্তিক দল বাংলা কংগ্রেসের পক্ষে যা মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। আজ তৃতীয় পর্ব গ্রামবাংলার রাজনীতি। আগের লেখার সূত্রগুলোও থাকলো এই লেখারই মধ্যে।

 

বাম জমানায় গ্রাম-রাজনীতি

১৯৪৭-পরবর্তী অধ্যায়ে গ্রামবাংলার রাজনীতিতে বিভিন্ন বাম ও কমিউনিস্ট পার্টির অনুপ্রবেশ ও প্রভাব ক্রমাগত বেড়ে চলল। ১৯৬৬ সালে উত্তাল খাদ্য আন্দোলন ফেটে পড়ার আগে পর্যন্ত অবশ্য গ্রামবাংলায় কংগ্রেসের প্রভাব খুব কম ছিল না। কিন্তু গ্রামস্তরে কংগ্রেসের বিশেষ সাংগঠনিক কাঠামো ছিল না, ছিল না নিম্নবর্গের মধ্যে মতাদর্শের ভিত। ১৯৬৬-র খাদ্য আন্দোলন মূলত কলকাতা ও সংলগ্ন কিছু জেলা শহরে শুরু হলেও, তা দ্রুত গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল। গ্রামাঞ্চলে কংগ্রেসি আধিপত্য তথা জোতদার-মহাজনদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ব্যাপক আকার নিল। ৬৭-র গোড়ায় কংগ্রেস সরকারের পতন ও যুক্তফ্রন্ট সরকারের উত্থান কৃষক আন্দোলনে গতিবেগ আনল। ‘যুক্তফ্রন্ট সরকার সংগ্রামের হাতিয়ার’ এই শ্লোগান তুলে যুক্তফ্রন্ট-ভুক্ত বাম দলগুলো বিশেষত সিপিআই(এম) গ্রামবাংলায় কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার ও সংগঠনের জাল বিস্তার করার ওপর নজর দিল। গ্রামবাংলায় প্রভাব বিস্তারের কাজে কমিউনিস্ট পার্টির সাংগঠনিক দক্ষতার সাথে সরকারী প্রশাসনিক ক্ষমতা ও সংস্কার কর্মসূচীকে এই প্রথম মেলানোর চেষ্টা হল। এই সময়ে নকশালবাড়ি কৃষক সংগ্রাম বিপ্লবী অভিমুখ সামনে নিয়ে এলে সিপিআই-এম নেতৃত্ব সরকার রক্ষার তাগিদে সেই আন্দোলনকে বিসর্জন দিতে দ্বিধাগ্রস্ত হল না।

ঘটনা হল, শ্রমিক-কৃষক জনতার জঙ্গী আন্দোলন যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর ক্রমশ উত্তাল হয়ে উঠলে ফ্রন্ট নেতৃত্ব তাকে আইনি ও সাংবিধানিক সীমার মধ্যে বেঁধে রাখতে মনোযোগ দিল, যদিও তেভাগার মতো এই সময়েও কৃষক আন্দোলন পার্টির বেঁধে দেওয়া গন্ডি ছাপিয়ে গেল, লালঝাণ্ডা পুঁতে ভূস্বামীদের জমিদখল নিত্যকার ঘটনা হয়ে উঠল, জোতদার-ভিত্তিক দল বাংলা কংগ্রেসের পক্ষে যা মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট আমলে তার সাথে যুক্ত হল শ্রমিকদের স্বতঃস্ফূর্ত ঘেরাও আন্দোলন, যা মালিকদের রাতের ঘুম কেড়ে নিল।

অন্যদিকে, নকশালবাড়ি আন্দোলন শুরুতে কিছু অঞ্চলে কৃষকদের মধ্যে বিপ্লবী উদ্দীপনা তৈরি করলেও কৃষক চেতনা সম্পর্কে নেতৃত্বের ভ্রান্ত মূল্যায়ন (‘শ্রেণীশত্রু খতম’ দরিদ্র-ভূমিহীন কৃষকদের জাগিয়ে তুলবে) আন্দোলনকে হটকারী পথে ঠেলে দিয়ে দ্রুত বিপর্যয় ডেকে আনল। এক্ষেত্রে, বিপ্লবী পার্টি-রাজনীতি নিম্নবর্গের চেতনাকে অনুধাবন ও আত্মস্থ করতে অসমর্থ হল। পরবর্তীকালে এই আন্দোলন পুনরুজ্জীবনের নানা প্রক্রিয়াতেও এই সমস্যা রয়েই গেল, নিম্নবর্গের স্বকীয় চিন্তা-চেতনার অধ্যয়ন ও চর্চা কখনই বিশেষ গুরুত্ব পেল বলে মনে হল না। এ রাজ্যে মাওবাদী আন্দোলনের শুরুর দিকের অভিজ্ঞতা (যা পূর্বে বিবৃত হয়েছে) তেমনই ইঙ্গিত করে।       

এদিকে, ’৭৭ সালে পুনরায় ক্ষমতায় আসার সময় অতীত অভিজ্ঞতা থেকে সিপিএম দল এই শিক্ষাই নিল যে, সরকার ও জঙ্গী আন্দোলন একসাথে চালানো সম্ভব নয়। তাই, বামফ্রন্ট রাজত্বের শুরু থেকেই কঠোরভাবে নিয়মতান্ত্রিক পথে সংস্কার কর্মসূচী চালানোর ওপর জোর দেওয়া হল। মুখ্যমন্ত্রী হয়েই জ্যোতি বসু ঘোষনা করলেন, লালঝান্ডা পুঁতে জমি দখল করা আর কারখানায় ঘেরাও আন্দোলন বরদাস্ত করা হবে না। এইভাবে, নিম্নবর্গের রাজনীতিকে আইনি সীমায় বেঁধে রাখা নিশ্চিত করা হল। অন্যদিকে, নিম্নবর্গের মধ্যে পার্টির প্রভাব ও সাংগঠনিক শক্তির ওপর নির্ভর করেই একের পর এক নির্বাচনে জিতে বামফ্রন্ট শাসন দীর্ঘস্থায়ী হল। ফলত, ৭৭-পরবর্তী অধ্যায়ে সংগঠিত ও অসংগঠিত রাজনীতির মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক তথা আন্তঃক্রিয়া বিশিষ্ট রূপ নিল---নিম্নবর্গের সম্প্রদায়গুলি প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ল, এতটাই যে নিম্নবর্গের পৃথক সত্তা বা স্বকীয় উদ্যোগের সন্ধান প্রায় অসম্ভব হয়ে গেল।

সংক্ষেপে, ১৯২০-এর দশক থেকে বাংলার গ্রামাঞ্চলে সংগঠিত পার্টি-রাজনীতির যে অনুপ্রবেশ শুরু হয়েছিল, ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর পশ্চিমবঙ্গে তা নতুন মাত্রা পেল। সংসদীয় ‘বাম’ দলগুলি, বিশেষত সিপিআই(এম), সরকারি ক্ষমতা এবং সরকারি সংস্কার কর্মসূচীকে কাজে লাগিয়ে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে গ্রামস্তরে তার সাংগঠনিক জাল বিস্তার করল। তাদের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসি রাজনীতি ছিল মূলত উচ্চবর্ণ ও উচ্চশ্রেণীর ওপর নির্ভরশীল, যার সাথে নিম্নবর্ণ ও নিম্নশ্রেণীর মানুষের ছিল সুদীর্ঘ অধীনতা ও সংঘাতের ইতিহাস। উপনিবেশিক আমল থেকেই কংগ্রেস ছিল মূলত উচ্চবর্ণের উচ্চকোটি মানুষের দল, যদিও সেই আমলে কংগ্রেসের আহ্বানে বিশেষ সন্ধিক্ষণে (যেমন ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে) গ্রামীণ নিম্নবর্গের বিপুল সমাবেশ ঘটেছিল, এবং বহুক্ষেত্রেই অসংগঠিত রাজনীতি তার নিজস্ব ভঙ্গিমায় কংগ্রেসি রাজনীতির সীমারেখা অতিক্রম করে গেছিল।

১৯৭৭ পরবর্তী পর্বে বামফ্রন্টের ক্ষমতায় উত্থান, গ্রামাঞ্চলে কিছু সংস্কার কর্মসূচী গ্রহণ এবং সর্বোপরি গ্রামাঞ্চলে পার্টি সংগঠনের জাল বিস্তারে বামফ্রন্টের প্রধান দল সিপিআইএম-এর মনোনিবেশ নিম্নবর্গের মানুষের সামনে নিজেদের মাথা তোলার নতুন সুযোগ হাজির করে দিল। কংগ্রেসি প্রভাবকে গুঁড়িয়ে গ্রামবাংলায় একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েমে সিপিএম-এর যেমন নিম্নবর্গের মানুষকে দরকার ছিল, নিম্নবর্গের মানুষেরও তেমনি এতদিনকার প্রভুত্বকারী উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার জন্য একটা অবলম্বন দরকার ছিল। ফলে, ১৯৭৭-এর পটপরিবর্তনের অব্যবহিত পরে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে একটা পরিমাণে কৃষক সংগ্রাম গড়ে উঠল, যাকে সিপিয়াই(এম) নিয়মতান্ত্রিকতার নিগড়ে বাঁধতে চাইলেও তা নিম্নবর্গের স্বকীয়তা নিয়ে বহু ক্ষেত্রেই আইনি রাজনীতির সীমানা ছাপিয়ে গেল। সিপিএম অবশ্য দ্রুত এই ছুটন্ত ঘোড়ার মুখে লাগাম পড়িয়ে দিল। ১৯৭৮ সালেই পঞ্চায়েত নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে পঞ্চায়েতি রাজ ব্যবস্থা সুচারুভাবে কায়েম করে নিম্নবর্গের জাগরণকে গ্রামস্তরে নিয়মতান্ত্রিকতার খাঁচায় পুরে ফেলা হল। এভাবে নিম্নবর্গের জাগরণ যেমন নিয়ন্ত্রিত হল, তেমনি তা খানিক প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতিও পেল।

১৯৭৮-এর নির্বাচনের পর এক নমুনা সমীক্ষায় দেখা গেল, পঞ্চায়েতে নির্বাচিত ৭৫ শতাংশ প্রতিনিধিই এসেছেন এমন পরিবার থেকে, যাদের জমির পরিমাণ ২ একরের নীচে। বর্ণভিত্তিক বিচারে, তফশিলী জাতি ও উপজাতির প্রতিনিধিরাই ছিলেন সমস্ত বর্ণ ও সামাজিক গোষ্ঠীগুলির মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যায় এবং তাদের প্রতিনিধিত্ব পরবর্তীকালে বেড়েছে ক্রমবর্ধমান হারে (রামচন্দ্রন ১৯৯৭ ও লিয়েতেন ১৯৯৬)।

সরকারি ক্ষমতার এই তথাকথিত বিকেন্দ্রীকরণে নিম্নবর্গের মানুষ ক্ষমতার পিরামিড কাঠামোয় নিজেদের একটা জায়গা খুঁজে পেলেন। গ্রামসমাজে তাদের মান-মর্যাদা বেড়ে গেল। তারা সরকারি ব্যবস্থাটার সাথে কিছুটা একাত্মতা খুঁজে পেলেন। এর সাথে যুক্ত হলো এই সময়কালেই সবুজ বিপ্লব কর্মসূচীর সফল রূপায়ণের ফলে গ্রামবাংলার একটা বড়ো অংশ জুড়ে কৃষি উৎপাদনে অভূতপূর্ব অগ্রগতি। এই উৎপাদনের বিকাশে বামফ্রন্ট আমলের সীমিত ভূমিসংস্কার, অপারেশন বর্গা ও পঞ্চায়েতি রাজ ব্যবস্থার একটা অবদান থাকল। কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধির সুফল অবশ্য মূলত গ্রামসমাজের উচ্চবর্গের মানুষের ঘরেই ঢুকলো এবং গরীব ভূমিহীনদের মধ্যে প্রান্তিকীকরণের হার বাড়ল, কিন্তু তবু কাজের সুযোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং মজুরির হার উল্লেখযোগ্য বেড়ে যাওয়ায় প্রান্তিক কৃষকের জীবনযাত্রার মানও একটা মাত্রায় বৃদ্ধি পেল। ১৯৭৯-৮০ সাল থেকে ১৯৯২-৯৩ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে কৃষি মজুরদের প্রকৃত মজুরি বৃদ্ধির সম্মিলিত হার ছিল ২.৮০ শতাংশ, যা সারা ভারতের মধ্যে ছিল সর্বোচ্চ। এই সবকিছু পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে বামফ্রন্টের রাজনৈতিক ভিত, বিশেষত সিপিআই(এম) দলের সাংগঠনিক-রাজনৈতিক ভিত, মজবুত করে তুলল।

কিন্তু এই প্রাতিষ্ঠানিক সাফল্যের ভেতরেই লুকিয়ে ছিল বামফ্রন্ট তথা সিপিআই(এম)-এর দুর্বলতা বা ক্ষয়ের দিক। নিম্নবর্গের প্রতিষ্ঠান বিরোধী চেতনাকে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সংকীর্ণ কাঠামোয় কখনোই আটকে রাখা যায় না। রাষ্ট্রের আইনি-রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে নিপীড়িত মানুষের উদ্যোগ-উৎসাহ-সৃজনশীলতা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে, আমলাতান্ত্রিক পার্টি ও সরকারী ব্যবস্থাপনার সাথে নিম্নবর্গের মানুষের বিরোধ বেড়ে যায় এবং তা বিকাশলাভের পথ খুঁজে ফেরে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা এই বিরোধ মীমাংসা করতে পারেনি। ভারতবর্ষের শোষণভিত্তিক রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে কীভাবে এই বিরোধ মেটানো যাবে?

পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে তাই পঞ্চায়েতি রাজ ব্যবস্থা একটা মাত্রায় উৎসাহ উদ্দীপনা তৈরি করলেও, তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা গ্রামাঞ্চলে কোনও মৌলিক পরিবর্তনে নিম্নবর্গের মানুষকে নেতৃত্ব দেবে এটা যেমন এই শাসন কাঠামোয় সম্ভব নয়, তেমনি এই ব্যবস্থার প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণও সম্ভব হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে আসল ক্ষমতা রয়ে গেল পার্টির হাতেই। যে পার্টি অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত, যেখানে উঁচুতলা থেকে নিচুতলায় নির্দেশ প্রবাহিত হয় নিয়মিতভাবে এবং নিচুতলা সেই নির্দেশ পালন করতে বাধ্য থাকে। ক্ষমতাসীন পার্টি পঞ্চায়েতের সকল কাজকর্ম পরিচালনা করে পঞ্চায়েতের ভেতরে পার্টি সদস্যদের মারফত। পঞ্চায়েত সদস্য পার্টি সদস্য না হলে তার হাতে প্রকৃত কোনো ক্ষমতাই যে থাকে না, বিভিন্ন গবেষণামূলক কাজে তা ধরা পড়েছে। ফলে যতোদিন গেল, পঞ্চায়েতি রাজের প্রতি মানুষ আগ্রহ হারালেন। একটা গ্রাম-সমীক্ষায় দেখা গেল, হুগলীর রঘুনাথপুরের ৯০ শতাংশ ভোটদাতা এবং বর্ধমানের জোগ্রামের ৮০ শতাংশ ভোটদাতা পঞ্চায়েতের কাজকর্মে সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।

পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চল এমনই নানান বৈচিত্র্য আর স্ববিরোধিতায় ভরা। একদিকে কৃষি উৎপাদনে অগ্রগতি, অন্যদিকে কৃষিপণ্যের লাভজনক দাম না পাওয়ার সমস্যা। একদিকে মজুরির হারবৃদ্ধি, অন্যদিকে কৃষি ব্যবস্থায় ঘনীভূত সংকটের ফলে কাজের দিন কমে আসা। একদিকে নিয়মিত পঞ্চায়েতি নির্বাচনের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা, অন্যদিকে ভোট দেওয়া থেকে শুরু করে পঞ্চায়েতের দৈনন্দিন কাজকর্মে পার্টির কড়া শাসন। শুধুমাত্র বিরোধী দলকে ভোট দেওয়ার জন্য যেখানে বহু মানুষকে লাঞ্ছিত, এমনকি গাঁ-ছাড়া হতে হত। একদিকে নিম্নবর্গের মানুষের মান-মর্যাদা-জীবনযাত্রার মানে লক্ষণীয় উন্নতি, অন্যদিকে আমলাতান্ত্রিক পার্টি ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণে পুরোনো কৌম-সমাজের অবক্ষয়। একদিকে পার্টি ও পঞ্চায়েতের নীচু স্তরে নিম্নবর্গের মানুষের প্রতিনিধিত্ব, অন্যদিকে আর্থিক সম্পদ ও সমৃদ্ধি স্বল্প মুষ্টিমেয় ধনীয় ঘরে সঞ্চিত হওয়া। একদিকে পার্টি এবং সরকারের সাথে একটা একাত্মতা বোধ, অন্যদিকে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী পুঞ্জীভূত বিক্ষোভ-অসন্তোষ প্রকাশের পথ না পেয়ে গুমরে ওঠা এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ।

এমন নানান স্ববিরোধের মধ্যে কোনও একটা বা দুটো দিক কখনও প্রকট হয়ে দেখা যায়। আবার, অন্যসময় অন্য কোনওদিক হয়তো প্রকট হয়ে ফুটে ওঠে। শাসক দলের প্রতি আনুগত্য ও বিরোধিতার মধ্যে দোল খায় গ্রামসমাজের জীবন। উচ্চবর্গ-নিম্নবর্গের বিভাজন অন্য একটা স্তরে কাজ করে চলে আজকের গ্রামবাংলাতেও। পুরোনো শাসন কাঠামো ও সমাজ কাঠামোয় নানান ভাঙচুর হলেও, আর্থিক কাঠামোটা যেহেতু চূড়ান্ত বৈষম্যের ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে, তাই পশ্চিমবাংলার গ্রামাঞ্চলে উচ্চবর্গ-নিম্নবর্গের বিভাজন অটুট থাকে। কিন্তু সেখানে কিছু পুনর্বিন্যাস ঘটে চলে। যেখানে নিম্নবর্গের কিছু মানুষ শাসনকাঠামোয় প্রভুত্বকারী অবস্থানে চলে আসার সুবাদে কার্যত উচ্চবর্গের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। তেমনি উচ্চবর্গের কিছু মানুষ আর্থিক সামাজিক সমস্ত দিক থেকে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে হতে নিম্নবর্গের মধ্যে চলে আসতেও পারেন। এই বিন্যাসটা জটিল রূপ নিয়েছে বাংলার গ্রামাঞ্চলে, যেখানে কিনা অর্থনৈতিক ক্ষমতা যাদের হাতে আছে, রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে তারা প্রায়শই বঞ্চিত। অন্যদিকে, পার্টিকেন্দ্রিক রাজনৈতিক ক্ষমতার বিন্যাসে কিছু নিম্নবর্গের মানুষও ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠেন। গ্রামস্তরে এমন স্ববিরোধ হামেশাই দেখা যাচ্ছে।

  তাই চিনে যেভাবে সামন্তপ্রভুদের অর্থনৈতিক সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তির বিরুদ্ধে কৃষকসমাজের উত্থান সমাজবিপ্লবের সূচনা করেছিল, তেমন কোনও সরল একমাত্রিক ছকে ফেলে গ্রামবাংলার সমাজকে বিশ্লেষণ করা যাবে না। তাকে দেখতে হবে নানা জটিল প্রক্রিয়া ও বহু বিচিত্র বৈশিষ্ট্যের সমাহার হিসাবে। এই বৈশিষ্ট্যগুলো যেমন একই এলাকার এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে তফাৎ হয়ে যায়, তেমনি সময়ের সাথে একটা নির্দিষ্ট গ্রামেও তা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। এই বৈশিষ্ট্যগুলোকে তাই দেখতে হবে তাদের চলমানতার মধ্যে, স্থান-কাল ভেদে পরিবর্তনশীল রূপে।

(চলবে)     

Agricutural Growth in West Bengal 1950-1996 by Vikas Rawal and Madhura Swaminathan, Economic and Political Weekly, 3 October 1998 issue।

সূত্রঃ ঐ

Moitree Bhattacharya, Panchayeti Raj in West Bengal, Manak Publications, 2002।  

0 Comments

Post Comment