যখন ফলওয়ালার ঝাঁকায় মুসাম্বিকে রিপ্লেস করে কমলালেবু, আর গুড়ের নাগরি জমে, মুড়ির দোকানে, পাড়া বেপাড়ার মিষ্টির দোকানে সন্দেশ, রসগোল্লার স্বাদ গন্ধ মোহময় হয়ে ওঠে; কদিন আগের কড়া ঝাঁঝালো রোদ্দুর, হয়ে যায় নতুন বৌ’র মতো নরম আর মিষ্টি, আজকাল ঠিক তখনই সোস্যাল মিডিয়ার গ্রুপগুলো মাইক হাতে দেশি বিদেশি বিভিন্ন পদ প্লেটে সাজিয়ে পিকনিকের দিন ঘোষণা করে।
আজ থেকে বছর পঁইতিরিশ, তিরিশ কিংবা চল্লিশ, বছর আগে শুরুর সব শর্ত মেনে যখন আমাদের ছাদে মিঠে রোদের আনাগোনা শুরু হত, সেই দিনগুলোতে, পিকনিকের পিতা হিসেবে বিরাজমান ছিলেন ফিস্টি বাবু। হ্যাঁ, নামের পরে বাবুও বিসর্জিত হয়েছে ইংরেজের দান বলে। বাবুরা এখন মিস্টার আর ফিস্টি জবাই হয়ে তার জিন-গত পরিবর্তন করে হয়েছে পিকনিক। জিন বদল নিয়ে পৃথিবীর বৈজ্ঞানিক মহলে এত চিন্তা ভাবনা, গবেষণা তার এক টুকরো যেভাবেই হোক, জুটে গেছে আমাদের ফিস্টির কপালে।
শীতের শুরু আসতেই আমাদের মাথায় ভুট্টার খই ফুটত। পুড়ুক্ পুড়ুক্ জেগে উঠতো ফিস্টি। অনেকটা আজকালের কম্পিউটারের পপাপ্ মেসেজের স্টাইলে। আমাদের সেই প্রাগৈতিহাসিক ছোটবেলায় যখন সোস্যাল মিডিয়া ছিল না, ভোট এসেছে এটা বোঝা যেত আশেপাশের বাড়ির দেওয়ালের চুনকাম দেখে, আর ফিস্টি আসছে আশেপাশে, সেটা বোঝা যেত উঠোনের বুড়ি নিমগাছ, কমলালেবু আর পাটালিগুড় দেখে।
আমরা বালখিল্যের দল তখন দৈর্ঘ্যে, আশে পাশের লোকেদের হাঁটু ছুঁয়েছি আর তারা ভুল করে আমাদেরকে তাদের হাঁটুর বয়সী বলতেন। সেই সময়ে আমাদের ডিকশনারিতে পিকনিক বলে কোনো শব্দ ছিল না। তবে জেনেছিলাম, কেন জেনেছিলাম জানি না, বড় জেঠিমার বাপের বাড়ি পার্ক সার্কাসের আশেপাশে একটি এলাকা আছে, তার নাম পিকনিক গার্ডেন। পিকনিক গার্ডেনের কোনো গার্ডেনে পিকনিক হত কিনা তা অবশ্য আমার জানা নেই, পাঠক আশাকরি আমার এ অজ্ঞতাকে ক্ষমা করে দেবেন। ফিস্টি হত ছাদে, মাঠে, ছ্যাঁদলা পড়া উঠোনে, রাস্তার কোণায়। সোজা কথায়, যেখানে সেখানে। ম্যাটাডোরে করে গঙ্গার ধার বা কোনও বাগানবাড়ি হলে আমরা বলতাম, দি লা গ্রান্ডি মেটিস্টোফিলিস।
সেই সময় যখন আমাদের আপেল/লপ্টপ/এন্ড্রেড কেউ ছিল না, তখন আমাদের নিমগাছ ছিল। ক-দিন পর, পাড়াশুদ্ধু সবাই তামা রঙের কচি নিমপাতা ভাজা খাবে বেগুন আর আলুসেদ্ধ দিয়ে, তাই উঠোনের বুড়ি নিম তার মোটা মোটা সবুজ পাতা ঝরিয়ে ঝরিয়ে, গাছতলা ভরিয়ে ফেলত। ঠিক যখন থেকে উঠোনের নিমগাছ পাতা ঝরাত, ঠাকুমার অর্ডারে মা, জেঠি, কাকি, টঙের থেকে লেপ কম্বল, আলমারি থেকে সোয়েটার, চাদর সব নামিয়ে রোদ্দুরে দেওয়া শুরু করত, তখন জুকু সাহেবের ঠাকুরদা-ও কম্পুটারের নাম লপ্টপ, আর ফোনের নাম আপেল না এন্ড্রড এসব শব্দ শোনেননি। সোস্যাল মিডিয়া খায় না মাথায় মাখে, তাও কেউ জানতেন না, সোস্যাল মিডিয়ার পিতাশ্রী জুকু সাহেবের জন্মই হয়নি। সেই সময় বুড়ি নিম আমাদের ফিস্টির ফেস্টুন টাঙাত!
দুপুরের খাবার পর বাজারে আসা নতুন টক টক কমলালেবু নিয়ে টুল পেতে বসা শুরু হত পশ্চিমের বারান্দায়। আর সেখানেই শুরু হত টুকরো টুকরো কথা।
-শীত এলেই মনটা কী রকম কমলালেবু কমলালেবু করে!
-নতুন গুড়ের সন্দেশ।
-পাঁউরুটির ওপর একটু ঝোলা-গুড় সঙ্গে এক কাপ কড়া কফি। আ-হ!
এসব ছিল শীত শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ফিস্টের বিক্রিয়া ত্বরান্বিত করার ডায়ালগ। যাকে বলা যেতে পারে, ক্যাটালিস্ট ডায়ালগ। আমাদের বাড়িতে, পাড়ায় ছাদে, উঠোনে, গলিতে, রোদ্দুরে টুল পেতে বসার শুরু আর এইসব ডায়ালগ ছিল সমানুপাতিক। যেমন যেমন টুলের সংখ্যা বাড়ছে, ডায়ালগ ততই প্যাসেঞ্জার থেকে মেইল হয়ে এক্সপ্রেস ট্রেনের গুরুত্ব নিত।
-শীত তো এসেই গেল, তাহলে একটা ফিস্টি প্ল্যান করা যাক কি বলো।
সবাই জানতো, রিয়াকশন দেবেই দেবে আমাদের ফিস্টি-গুরু ছোটকা। ক্যাটালিস্ট টোপ সে গিলবেই। অতঃপর ছোটকা এবং তার বাহিনী নেমে পড়ত পাড়া বেপাড়ার সব টুকরো ডায়ালগ জুড়ে ফিস্টির লং-প্লেইং রেকর্ড বানাতে। ছোটকাকে মইয়ে তুলে, ক্যাটালিস্ট ডায়ালগ বক্তারা নীরব ও নিরাসক্ত ভাবে চলে যেতেন। ঠিক যেন, বৎস, তোমাকে রাস্তা দেখানোই আমাদের কাজ, সে পথ তুমি চিনে নিয়েছ, এবার এগিয়ে যাও।
ফিস্টির সলতে পাকানো, খুব খেলা কথা ছিল না। পাড়া বেপাড়াকে যুক্ত করে, ছোট ছোট মিটিং করে লোক এবং চাঁদা জোগাড়ে লেগে যেত ছোটকা বাহিনী। এর পরেও জায়গা দেখা, বাসন জোগাড়, বাজার ইত্যাদিতে হ্যাপা নেহাৎ কম ছিল না। সব থেকে বেশি হ্যাপা হত চাঁদা জোগাড়। সবাই ডিসকাউন্টের ভক্ত। সবাই আপনজন।
তাই তো বলছি, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই যে প্রদীপেরই সলতে থাকে আর ফিস্টির নেই!
তখনকার দিনে একান্নবর্তী বলে এক রকমের পরিবার হতো। যার অস্তিত্ব এখনও টিভি সিরিয়ালে দেখা যায়। সেখানে কাকা জ্যাঠা ঠাকুমা ঠাকুর্দা আর তাদের ছেলেপুলে, বউ ইত্যাদিদের নিয়ে এক-একটা পরিবার হত। কোথাও কোথাও অকেজো পিসি, বেকার কাকা, বটঠাকুমা, ছোট্টহাকুমা ইত্যাদি নিয়ে কুড়ি পঁচিশ তিরিশ জনের লম্বা ফ্যামিলিও হত। ফিস্টিতে অনেক যদি, অতএবের সঙ্গে জনসংখ্যাও একটা বড় রোল প্লে করতো।
শেষ পর্যন্ত যখন বিশাল লোহার কড়াইতে মাংস চাপত, জনসংখ্যা শ দেড়েক ছাড়িয়েছে। ফিস্টি হত পাড়াজোড়া এক্সটেনডেড ফ্যামিলি নিয়ে। তাতে কখনও সখনও বেড়াতে আসা আত্মীয়স্বজন মিশে যেতেন। এসব ফিস্টির রান্নাবান্নার দায়িত্ব অবধারিত ভাবে থাকত ফিস্টি-গুরু এবং তাদের বিশ্বাসভাজনদের ওপর। কারণ রান্না হতে হতে ঠিক কতটা মাংস টেস্ট করা যাবে এবং সেটা কে টেস্ট করবে সেটা ফিস্টি-গুরু ছাড়া, আর কে জানবে! মাঠে বানানো গর্ত করে তৈরি করা উনুনে, কাঠের আঁচে; ফিস্টির উনুন, ধোঁয়া যত উগরাত, রান্নাটা ঠিক সেই স্পিডে এগোত না। অবশেষে প্রায় সন্ধের কাছাকাছি, গরম ফ্যানা ভাতের উপর পোড়া গন্ধের মাংস, আধসেদ্ধ আলু, ট্যালট্যালে টমেটোর চাটনি আর হাপুস হুপুস শব্দ।
ফিস্ট আদরে ই-কারান্ত হয়ে ফিস্টি। বাঙালি ঘরে সব বাচ্চারই একখানা ডাক নাম থাকে। বুড়ো হয়ে গেলেও থাকে। খাতা কলমের নামের থেকে তার গুরুত্ব চিরকালই অনেক বেশি। ফিস্টের বেলায় তা হবে না কেন।
ফিস্ট গ্রাহকের, বয়স এবং পছন্দ অনুযায়ী ফিস্টির বেশ কিছু গ্রেড থাকত। মেনুতেও তেমনি গ্রেড। মাংসভাত/মুরগী ভাত/ডিমভাত/খিচুড়ি-আলুভাজা/। এগুলোকে ফিস্টির মেনু ভাবার কোনও কারণ নেই, এগুলোই ফিস্টির গ্রেড। ফিস্টি-গুরুর শারীরিক দৈর্ঘ্য এবং দৈহিক ক্ষমতা ও সামর্থের ওপর নির্ভর করে।
ডিমভাত/খিচুড়ি আলুভাজা ফিস্টিঃ সেসময় আমাদের এলাকায় বনধ্ ও ফিস্টির একটা মেলবন্ধন হয়েছিল। বাংলা কিংবা ভারত বনধ্ সেসময় বছরে দু-তিনটে হত-ই, এপক্ষ বা ওপক্ষের ডাকে। শুক্লপক্ষ, কৃষ্ণপক্ষ যে পক্ষই সে বনধের দাবিদার হোন না কেন! এক পাড়ার বিভিন্ন স্কুলের দু এক ক্লাস আগে-পিছে পড়া আমাদের ঐক্যে তাতে ফাটল ধরানোর প্রশ্নই ছিল না। ঐ বনধ্ আমাদের কাছে ছিল মিলনের সেতু। নির্ভেজাল আড্ডার ভরা কোটাল। এরকম ফিস্টিতে খিচুড়ি ডিমভাজা অথবা ডিমের ঝোল ভাত ছিল সর্বোচ্চ লেভেল।
তাই এরকম সব দিন আসার আগেই আমাদের এবং আমাদের লিডারদের চোখে চোখে বেশ কিছু প্ল্যান কষা হয়ে যেত। পাড়ার সেনকাকুদের বাগানের একটা সাইড এই সবের বেশ উপযোগী করেই বানানো হয়েছিল; মাঝেমধ্যে সেটার ব্যবহার হলে, সেনকাকু আর কাকিমা বেজায় খুশি হতেন। আমরা এতটাও পাষণ্ড ছিলাম না যে অকারণে ওনাদের দুঃখ দেব।
অতএব!
এত সব কিছুকে এক গ্রন্থিতে বেঁধে এসব দিনে আমরা ঝাঁপাতাম আজ আমরা ফিস্টি করব-তে। বেলা বারোটা নাগাদ পার্মিশন পাওয়া যেত। এর পরের স্টেপগুলো ঠিক যেমনটা হতঃ
১। মা কাকিমা কারুর একটা শাড়ি গাছ থেকে গাছে বেঁধে ত্রিপলের একটা ইমিটেশন তৈরী করা।
২। এর আগেই সবার বাড়ি থেকে ভবতী ভিক্ষাং দেহি স্টাইলে দুটো ব্যাগে সংগ্রহ করা হত মুঠো মুঠো চাল ডাল আর অবশ্যই ডিম ও আলু।
৩। ডিম জোগাড় করাটা যদিও একটা চ্যালেঞ্জের মধ্যেই পড়তো। সেখানেই ছিল লিডারদের মুন্সিয়ানা, কে এই সমবেত মা কাকিমাদের বুঝিয়ে ডিম জোগাড় করতে পারে। (সে যুগের মা কাকিমারা বাচ্চাদের হাতে আস্ত একখানা ডিম তুলে দেওয়াকে প্রায় একভরি সোনা তুলে দেবার মতনই ভাবতেন।)
৪। এ পয়েন্ট খুব ঘোলাটে। এসময় অবধারিত ভাবে আসত কিছু দার্শনিক মূহুর্ত। সেদিন যার বাড়িতে ডিম নেই, সে গম্ভীর মুখে ঘোষণা করে বসত, লাগবে না ডিম, তারপর কোনও বদান্য অভিভাবক দুটো ডিম বেশি দান করে দিতেন। আর যার মা এমন বদান্য হতেন তার ল্যাজ সেদিন এমন মোটা হত, সে প্রায় পরমকৃষ্ণ স্টাইলে অন্য বন্ধুদের দেখত।
৫। রান্নার স্টোভ, কেরোসিন সহ, এবং কড়াই জোগাড় করা।
৬। উপরের এই সমস্ত পয়েন্ট আমাদের দলের যে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারত, তার সম্বন্ধে, আমরা নিশ্চিত হতাম ভবিষ্যতের ফিস্ট ম্যানেজারের পোস্ট নিয়ে।
৭। এর পরে রান্না শুরু। ফিস্টের পার্মিশন, লিডারশিপ আর জোগাড়টাই তো আসল, রান্না খাওয়া তো বাহ্য। আমাদের জানা ছিলই, আমাদের দুর্দশা দেখতে না পেরে, সাহায্য এসে পৌঁছাবেই; মা কাকিমাদের কাছ থেকে। খেতে বসতে বেলা সাড়ে চারটে। সে তো হবেই। এ-ত যে কাজ করলাম, তার বেলা!
এসব ফিস্টের কত যে রকম ফের ছিল, বয়স-ভেদে। সময় সুযোগ পাওয়া গেলেই একখানা ছোট মাপের ফিস্ট; বিশেষ করে যদি সময় সুযোগ এসে হাজির হত শীতকালে। এভাবেই বিভিন্ন বয়সের সবাই আমরা হাত আর মাথা পাকাতাম ফিস্ট ম্যানেজারের পোস্টের জন্য।
মুরগী ভাত ফিস্টঃ সেবার ডিসেম্বরের শেষ দিকে দাদাভাইদের স্কুলের অঙ্কের মাস্টারমশাই গেলেন সপরিবারে পুরী। বাঙালি মধ্যবিত্তের দৌড় চিরকালই পুরী দার্জিলিং। বাড়ি পাহারা দেবে কে? কে আবার ? ছাত্ররা। সেযুগে এমনই হত। বাড়ি পাহারার লটারিতে দাদাভাইয়ের নাম উঠল। সঙ্গে কোচিং-এর আরও তিন বন্ধুর। সামনে ওদের উচ্চমধ্যমিক। খেয়ে দেয়ে তাড়াতাড়ি চলে যেত ও বাড়িতে। খুব মন দিয়ে পড়াশুনা হচ্ছে। এর মধ্যে একদিন শুনলাম স্যারের বাড়ির বাগানে ওরা ফিস্টি করবে। কিন্তু দাদাভাই কিছুতেই আমাদের ওর মধ্যে ঢোকাল না।
কী আর করতে পারি আমরা, প্রাণভরে অভিশাপ দিতে পারি। দিলাম। শিশু ভট্টাচার্য্যদের সে অভিশাপের যে কি জোর, সেটা দাদাভাই একা নয়, সব বন্ধু মিলে সেদিন টের পেয়েছিল। আমি নিশ্চিত; দুর্বাসা, বিশ্বামিত্রের যুগ হলে সেদিন আমাদের প্রতিভার দাম মিলত।
চৌর্য্যবৃত্তের পরীক্ষা দিতে, সেদিন ওদের কোনও বন্ধু দুখানা মুরগি নিয়ে এসেছিল (এটা বাড়িতে বলা যেত না তাই আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার)। সে মুরগি রান্না হোল। খাওয়াও হোল। সকালবেলা বাইরে বেরিয়ে দাদাভাইরা দ্যাখে, মুরগে মালকিন সামনে দাঁড়িয়ে।
ভট্টাচার্য্য মাস্টারমশাইয়ের বাড়ির কড়াইয়ে মুরগি রান্না হয়েছে আর খেয়েছে যোগেন ভট্টাচার্য্যের নাতি। দাদাভাই জানত, বাড়িতে যদি খবর যায় তাহলে জেঠুর একমাত্র শাস্তি বেল্ট পেটা। পুরোটাই পিঠে, একটাও মাটিতে না। মুরগি তো মুরগি, তাও আবার চুরির। শোনা কথা, জমিয়ে রাখা তিনমাসের টিফিন খরচ গেছিল মুরগির পেটে।
ছোটকা শুনে বলেছিল, ছ্যাঃ। কিন্তু এই ছ্যাঃ কেন? এর কোনও, ব্যাখ্যা ছোটকা কিছুতেই দিল না। এব্যাপারে প্রশ্ন করলেই, স্রিফ মৌনীবাবা হয়ে যেত।
এ রকম সব দিন পেরিয়ে আমরা ধুরধার বড়ো হতে হতে এতটাই বড় হয়ে গেলাম যে ৯৮ সালে দাদাভাইয়ের বিয়ে হয়ে গেল।
এমন একখানা ভালো সুযোগকে হাতছাড়া করা যায়! ফিস্টিদা ছোটকা প্ল্যান কষে ছক তৈরী করল, বেহালা থেকে রায়চক। পচাদার ডেকরেটারের দোকানের গ্যাস উনুন, ডেকচি এবং রান্নার ঠাকুর ভাড়া করা হল। ওই দোকানে বাসনপত্রের সঙ্গী রান্নার ঠাকুরও ভাড়া পাওয়া যেত।
নতুন বৌদি সহ, এক ম্যাটাডোর লোক হ্যা-হ্যা করতে করতে রায়চকে পিকনিক স্পটে পৌঁছে গেলাম। কিন্তু আমাদের রান্না বান্না না করে ফিরে আসতে হল। সেইখানে তখন এক পাঁচতারা হোটেল খুলেছে, তাদের সিকিউরিটি আমাদের রান্নাবান্না দূর, ম্যাটাডোর থেকে প্রায় নামতেই দিল না। ফেরার পথে রাস্তার মোড়ের দোকানে ওমলেট আর চা পাওয়া গেল। সেই তখন ঢের আমাদের ছুঁচোয় ডন মারা পেটের কাছে।
সেই বিগড়ানো ফিস্টি থেকে ফেরার পথে ছোটকা আর রবীন কাকা বলেছিল, ধুর বয়স হয়ে গেছে আমাদের, খবরই জানতাম না এখানে এমন একটা কেলো হয়ে আছে। নতুন বৌমা কি ভাবল বল তো! না-রান্না না-খাওয়া সারা দিন। এই দুঃখে ছোটকা আর রবিন কাকা ফিস্টি-গুরুর পদ থেকে ইস্তফা দিল।
আর এ রকম সময় থেকেই সম্ভবত ফিস্টিকে রিপ্লেস করতে এগিয়ে এল পিকনিক, তার পেছনে গেট্টু, তারপর মিট ইত্যাদিরা।
তাই স্বাভাবিকভাবেই এখন ফিস্ট, ফিস্টি কিছুই হয় না, হয় সেই সব নব্য নামধারী গেট্টু, মিট নিদেনপক্ষে পিকনিক। আজকালের সেই পিকনিক মানে আমি যা বুঝিঃ
১। একখানা রিসর্ট ভাড়া করো।
২। ভলভো বাসে চড়ো।
৩। রিসর্টে নামতেই তৈরি খাবার খাও।
৪। ডি-জে শুনে নাচো কিংবা বসে বসে পা দোলাও।
৫। পা দোলাতে দোলাতে ভাবো, উফফ্ কি নিশ্চিন্ত জীবন।
৬। সর্বোপরি নিজেরা না পারলে একখানা ইভেন্ট ম্যানেজার খুঁজে তার হাতে দায়িত্ব দিয়ে দাও। আর নিজেরা টাকা হস্তান্তর করার পর শুধু এবং শুধুমাত্র পা দোলাও।
(এইসব ইভেন্ট ম্যানেজাররা পারেন না এমন কাজ নেই; বিয়ে থেকে শ্রাদ্ধ, পিকনিক থেকে স্পোর্টস স-ব। এঁদের স্পেলাইজেশনের ঠ্যালায় ছোটকার মত বিশেষজ্ঞদের কাজ গেছে। ওনাদের এখন কেউ খোঁজে না।)
কিন্তু পাঠক, এই কথকের একখানা বিনীত নিবেদন আছে...
সেই যে ম্যাটাডোর নিয়ে খুঁজে খুঁজে পিকনিক স্পট বার করো। কারণ নিজেদের আগে থাকতে ঠিক করা জায়গাখানায় কোন পার্টি এসে চাদর পেতে দুখানা বাচ্চা বসিয়ে রেখে গেছে।
তাতে যে চ্যালেঞ্জিং ব্যাপারটা ছিল, সেটা কিন্তু মিসিং হয়ে গেছে।
গুগলদাদা আবার বলে জীবনে চ্যালেঞ্জ না থাকলে অ্যাড্রিনালিন উৎপন্ন হয় না।
এখন নিজেরাই ভাবুন জীবনে চ্যালেঞ্জ চাইবেন নাকি, পান্তাভাত মার্কা নিশ্চিন্তি। জীবন আপনার, চয়েস তো আপনার বটেই।