অনিচ্ছুক রাজনীতিবিদ, রাজপুত্র, পোগো চ্যানলে ছোটা ভীম দেখা পাপ্পু, গত এক দশক ধরে রাহুল গান্ধী সম্বন্ধে লাগাতার এই সব ব্যঙ্গ বিদ্রুপ চলছেই। যদিও, আমি কখনই তার বিরুদ্ধে মিডিয়ার এই কুৎসা বিশ্বাস করিনি, তবে আমি এও বিশ্বাস করিনি যে রাহুল ভারতকে নেতৃত্ব দিতে পারে।
"একজন চমৎকার লোক, কিন্তু ভারতীয় রাজনীতির জন্য উপযুক্ত নয়", কয়েক মাস আগে পর্যন্ত তার সম্পর্কে আমার এটাই ধারণা ছিল। এবং তারপরে রাহুল ভারত জোড়ো যাত্রা-র ব্যানারে ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করার ভাবনা নিয়ে কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত ৩৫০০ কিলোমিটার পদযাত্রা শুরু করেন। একজন রাজপুত্র কি ৩৫০০ কিমি হাঁটেন, তাও এমন ধারাবাহিক ভাবে ? একজন অনিচ্ছুক রাজনীতিবিদ মূলধারা এবং সোশ্যাল মিডিয়া চ্যানেলে এমন জঘন্যভাবে অপমানিত হওয়ার পরেও কি রাজনীতিতে থাকেন? তাঁর তো ভারত ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে তার পারিবারিক সূত্রে প্রাপ্ত বিশাল সম্পদ ভোগ করার কথা। পোগো চ্যানেল তো অন্যান্য দেশেও পাওয়া যায় এবং ছোটা ভীম সেখানেও দেখা যায়। কেন তিনি আরও ইটপাটকেল গালিগালাজ এবং আইটি সেল ক্যাডারদের ট্রোলিংয়ের মুখোমুখি হবার জন্য এখনো এই দেশে পড়ে আছেন? তাঁকে, তাঁর মা, বোন¸ পুরো পরিবারকে লক্ষ্য করে যেভাবে নোংরামির বিষ ছড়ানো হয়, অপমান করা হয়, তাতে তাঁর অবস্থায় থাকা অন্য যে কেউ ভেঙে পড়বে।
তবু তিনি এখনো কেন লড়ে যাচ্ছেন? অনিচ্ছুক রাজনীতিবিদ বা যুবরাজের তো এমন করার কথা নয় !!!
এটা ভেবেই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে এই লোকটি কী তা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। সৌভাগ্যবশত, আমি রাহুলের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম তাঁর পাশে হাঁটার সময় এবং সেই সু্যোগে তাঁর সম্বন্ধে একটি ছোট মূল্যায়ন করার সুযোগ পেয়েছি ।
প্রথমেই স্পষ্টভাবে বলে রাখি, রাহুল পোগো দেখা কোনো পাপ্পু নন যেটা বিজেপি তার পোষা মিডিয়াকে দিয়ে বলানোর চেষ্টা করে। তিনি একজন অত্যন্ত শিক্ষিত এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তি।তাঁর কথা বলার ধরন আপনার দেখা অন্য কোনো রাজনীতিবিদদের মতো নয়। বেশিরভাগ রাজনীতিবিদ, তাদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক যতই ভালো হোক তারা বড্ড মাতব্বর হয় , কথা বলার সময় তারা হয় আপনাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে অথবা আপনার উপর জোর খাটানোর চেষ্টা করে। এমনকি যখন তারা আপনার কোনো উপকারও করে, তারা সেটাকে বিরাট অনুগ্রহ করছে বলে মনে করে এবং আপনাকে তাদের প্রতি অনুগৃহীত ভাবতে বাধ্য করে। রাহুল আপনার চেনা প্রতিবেশীর মতো। তিনি অনেকটা সেই লোকটির মতো যে রোজ চায়ের দোকানে এসে আপনার সঙ্গে আড্ডা মারে। তিনি মৃদুভাষী, সহজ সরল এবং অত্যন্ত স্পষ্টবাদী। তিনি গুটিয়ে থাকেন না আবার সব জানেন এমন ভাবও করেন না বরং তিনি যেন আপনার থেকেও জানতে চান। তিনি আপনাকে প্রশ্ন করেন, আপনার উত্তর আগ্রহ নিয়ে শোনেন, আপনার উত্তরগুলির সঙ্গে নিজের প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করেন, তবে আরেকজনের মতো নিজের “মন কি বাত” একতরফা ভাবে বলেও যান না। তিনি যখন আপনার চোখের দিকে তাকান , আপনি সে চোখে দয়া দেখতে পান। তিনি যখন আপনার দিকে তাকিয়ে হাসেন, আপনি উষ্ণতা অনুভব করেন। যখন আপনার কাঁধে তাঁর হাত রাখেন, আপনার একটুও অস্বস্তি হয় না। যখন তিনি আক্রমণাত্মক হতে চান, তখন তিনি যথেষ্টই আক্রমণাত্মক, কিন্তু সেটা জোর করে বা অভিনয় করে নয়। তিনি নিজের সংকল্পে অবিচল, কিন্তু অন্যের উপর জোর খা্টিয়ে নয়। তাঁর মধ্যে নির্মমতার অভাব আছে কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে তিনি অটল থাকেন। হয়তো সেই কারণেই যখন তাঁর দলের নেতারা বিজেপিতে ঝাঁপ দিয়ে পড়েন, তখন তিনি তাদের যে কোনো উপায়ে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করার পরিবর্তে, পুনর্গঠন শুরু করেন। তিনি এমন একজন লোক, যিনি তাঁর নীতির সঙ্গে আপস করবেন না। হয়তো সে কারণেই যখন তাঁর দল নির্বাচনে হেরে যায় তখনও তিনি নিজের অবস্থান পরিবর্তন করেন না, বরং তাঁর আদর্শে অটল থাকেন। রাহুল নিশ্চিতভাবেই এমন একজন ব্যক্তি, যিনি আপনি যদি ন্যায়ের পক্ষে হন তাহলে আপনার হয়ে লড়বেন। তাতে যদি তাঁর ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিও হয় তাও তিনি পিছিয়ে যাবেন না। এই বিশ্বাস, এই আস্থা তাঁর কাছেই পাওয়া। রাহুল সম্পর্কে সব কিছু জানার জন্য ২০ মিনিট যথেষ্ট সময় নয়। তবে ২০ মিনিটই এটুকু জানার জন্য যথেষ্ট যে তার বিরুদ্ধে যা কিছু বলা হচ্ছে তা একেবারেই কদর্য মিথ্যা।
এখনও আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত নই যে এই ধরনের লোকেরা আদৌ ভারতে নির্বাচনে জিততে পারবে কিনা (আমি আশা করি তাঁরা পারবে), তবে যদি একজন রাজনীতিবিদ হতে ধূর্ত, নিষ্ঠুর, নির্দয় এবং ক্রূঢ় হতে হয় তবে আমি ইতিমধ্যে এমন একজনের কথা মনে করতে পারি , যে লোকটিকে আমি লম্বা লাঠির ডগা দিয়েও স্পর্শ করব না......
আর রাহুল, যাকে আমি আবার সু্যোগ পেলেই জড়িয়ে ধরব। আপনি যদি কখনও কাউকে বলতে দেখেন "কিন্তু আর তো বিকল্প নেই", বিশ্বাস করুন, তারা ভুল বলছে। রাহুল একজন বিকল্প এবং খুবই শক্তিশালী বিকল্প। অবশ্য আপনি যে বিকল্প খুঁজছেন তা যদি ভালবেসে জড়িয়ে থাকার কথা বলে, বিভেদ বা ঘৃণার কথা নয়। রাহুল এবং ভারতের জন্য ভবিষ্যতে যাই থাকুক না কেন, আমি আন্তরিকভাবে আশা করি যে রাহুল এবং তার ভারত জোড়ো যাত্রা যেন অসাধারণ সাফল্যমণ্ডিত হয়।
এবার সেই গোপন কথাটায় আসা যাক, আমি কিভাবে রাহুলের সঙ্গে দেখা করতে পারলাম? আমি যখন সিদ্ধান্ত নিই, যে আমি ভারত জোড়ো যাত্রায়, অংশ নেবো, তখন আমার মাথাতে একবার ও আসেনি, আমি রাহুলের সঙ্গে দেখা করবো, বা ওঁর সঙ্গে ২০ মিনিট কথা বলার সুযোগ পাবো। আসবেই বা কি করে, আমার মতো একজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে রাহুল গান্ধীর মতো মানুষ কেনই বা দেখা করবেন? তারপরে, যত আমার ভারত জোড়ো পদযাত্রাতে হাঁটার দিন কাছে আসতে লাগলো, ততই বন্ধুরা আমায় ফোনে যোগাযোগ করতে শুরু করলো, তাঁদের যত রকমের যোগাযোগ আছে, কংগ্রেসে, তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন, যাতে আমি রাহুল গান্ধীর সঙ্গে কথা বলতে পারি, সেই চেষ্টা করতে শুরু করলেন। কত নাম করবো, নিরঞ্জন ট্যাকলে, অক্ষয় কুলকার্নি, আসিফ মোদক সহ বহু মানুষ নিজের নিজের মতো করে চেষ্টা করতে লাগলেন, যাতে আমার সঙ্গে রাহুলের দেখা হয়। এই পুরো প্রক্রিয়াতে আমার একটাই কথা মনে হয়েছে, এই কঠিন সময়ে যত বন্ধু বাড়াতে পারবেন, ততই ভালো, তাঁদের প্রয়োজনে তাঁদের পাশে দাঁড়ান, কোনও প্রত্যাশা ছাড়াই পাশে দাঁড়ান, একদিন দেখবেন কোন জাদুবলে, সবাই আপনাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে। আমার ক্ষেত্রেও ঠিক এটাই ঘটেছে। মানুষের ভালবাসাই হচ্ছে আসল সম্পদ।
পুণঃ আপনি হয়তো লক্ষ করেছেন যে রাহুলের সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠ ভাবে কথোপকথন করা সত্ত্বেও, আমি তাকে রাহুল বলেই ডাকি, রাহুল জি নয়, রাহুল স্যার নয়। এবং এতেও তাঁর প্রতি পূর্ণ সম্মান ও ভালোবাসা অক্ষুণ্ণই থাকে¸কারণ রাহুল এমনই মানুষ।