পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

মুনাফা, পুলিশ এবং স্বাস্থ্য জনস্বাস্থ্যের জরুরী অবস্থা মানে, পুলিশি ব্যবস্থা

  • 09 July, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1814 view(s)
  • লিখেছেন : ডাঃ অমিতাভ ব্যানার্জি
সাম্প্রতিক অতিমারী নিয়ে পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মারাত্মক আতঙ্কিত প্রতিক্রিয়ায় মানবাধিকার, নৈতিকতা অনেক বেশি লঙ্ঘিত হওয়া সত্ত্বেও জনসাধারণের আক্রোশ কিন্তু নজরে পড়ল না। শুরু থেকেই কোভিড-১৯এর অতিমারীতে অতিনির্মম স্বাস্থ্য নীতি গ্রহণ করা হল, যা কিনা সেই আদিম যুগের থেকেও কঠিন, ভয়ঙ্কর।

(এই নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে ন্যাশনাল হেরাল্ড পত্রিকায় (ইপেপার), ১৯ জুন, ২০২২)

মনে করুন, ধরে নেওয়া হল যে, রোগীদের মাথার মধ্যে পাপাত্মা ঠাঁই নিয়েছে, তাই তারা অন্যদের ক্ষতি করে ফেলতে পারে। এবার ধরুন, একদল রোগীকে ধরে বেঁধে, তাদের মাথার খুলিতে গর্ত খোঁড়া হচ্ছে যাতে পাপাত্মা দূর করে দেওয়া যায়। এমন দৃশ্য আপনার কেমন লাগবে? মনে হবে, কোনও ভৌতিক ছবির চিত্রনাট্য, নয়তো সেই মধ্যযুগের ডাইনিচর্চা! তাই না? এবার কল্পনা করুন, রোগী বা রোগীর বাড়ির লোকের কোনও সম্মতি ছাড়াই তাদের শরীরে নতুন নতুন পরীক্ষামূলক ওষুধ ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যাতে তারা রোগ ছড়িয়ে অন্যদের ক্ষতি করে দিতে না-পারে।ধরে নেওয়া হয়েছে যে, এইভাবে মানবসভ্যতাকে রক্ষা করা যাবে।

সেই আদিম যুগে এই ধরনের অস্বাভাবিক ব্যবস্থার রীতি প্রচলিত ছিল। আজকে কিন্তু এইধরণের ব্যবস্থা গুরুতর নৈতিক সমস্যা সৃষ্টি করবে, ব্যাপক বিক্ষোভের জন্ম দেবে।

অবশ্য সাম্প্রতিক অতিমারী নিয়ে পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মারাত্মক আতঙ্কিত প্রতিক্রিয়ায় মানবাধিকার, নৈতিকতা অনেক বেশি লঙ্ঘিত হওয়া সত্ত্বেও জনসাধারণের আক্রোশ কিন্তু নজরে পড়ল না। শুরু থেকেই কোভিড-১৯এর অতিমারীতে অতিনির্মম স্বাস্থ্য নীতি গ্রহণ করা হল, যা কিনা সেই আদিম যুগের থেকেও কঠিন, ভয়ঙ্কর। এমনকী, অতীতে এর চেয়ে অনেক বেশি মারণক্ষমতা সম্পন্ন রোগ, যেমন অ্যান্টিবায়োটিকের আগের যুগের প্লেগ, কিম্বা টিকা প্রচলিত হওয়ার আগে গুটিবসন্ত, সেই সময়েও এমন ভয়ঙ্কর স্বাস্থ্যব্যবস্থার কথা শোনা যায় নি। অ্যান্টিবায়োটিক এবং ভ্যাকসিন আবিষ্কারের আগে গুটিবসন্তে কিম্বা প্লেগে মৃত্যুর আশংকা ছিল ৪০ শতাংশেরও বেশি।

অথচ কোভিড-১৯ এর মৃত্যুহার মাত্র ০.১% থেকে ০.৩%। তবু এক্ষেত্রে অনেক অনেক বেশি কঠোর, নির্মম ব্যবস্থা নেওয়া হলো। যদিও কোভিড ভ্যাকসিনের কার্যক্ষমতা প্রমাণিত নয়, ভ্যাকসিনটি নতুন এবং পরীক্ষামূলক, এর দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া কী হবে তাও অজানা, তবু শিশুদের এবং গর্ভবতী মহিলাদের ওপর এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হলো। যারা যথার্থ কারণেই ভ্যাকসিন নিতে দ্বিধাগ্রস্থ, তাদের অসম্মান করা, তাদেরকে কলঙ্কিত করা, তাদের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকানো শুরু হলো। সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য সম্প্রতি আইনি ব্যবস্থার ওপর আস্থা বজায় রেখে আদেশ জারী করেছেন যে, ভ্যাকসিন নেওয়া বাধ্যতামূলক করা যাবে না এবং ভ্যাকসিন-এর শংসাপত্র না-থাকলে কোনও ধরনের সামাজিক বৈষম্য করা যাবে না।

তবু হয়তো আমরা তেমন সৌভাগ্যবান নই। কারণ, ভবিষ্যতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে বিতর্কিত অতিমারী চুক্তি আর ভারত সরকার যে নয়া জনস্বাস্থ্য বিল ২০২২ প্রস্তাব করেছে সেটা যদি সত্যি সত্যি রূপায়িত হয়, আমাদের দুর্ভাগ্যের সীমা থাকবে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) অতিমারী থেকে রক্ষা পাবার জন্য, অতিমারীকে রুখতে তৈরি থাকার জন্য এবং অতিমারীর বিরুপ প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য এমন একটি আন্তর্জাতিক চুক্তির প্রস্তাব করেছে, যেখানে জনস্বাস্থ্যের নীতিমালা, নৈতিকতা এবং ন্যায্যতাকে বিসর্জন দিয়ে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রাক্তন বিজ্ঞানী ডক্টর ডেভিড বেল ইতিমধ্যেই সতর্ক করেছেন যে, এই অতিমারী চুক্তির ফলে আমাদের বারবার লকডাউনের সম্মুখীন হতে হবে এবং বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়বে।

তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন, “যদিও এই চুক্তি সরাসরি কোনও দেশের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করছে না কিন্তু কার্যত সেই দেশের সাধারণ মানুষের নিজেদের সিদ্ধান্ত নেবার স্বাধীন অধিকার সম্পূর্ণভাবে কেড়ে নেওয়া হবে”। তিনি আমাদের এই বলে সতর্ক করেছেন যে, এই ধরনের চুক্তির প্রস্তাব এমন এক নয়া আমলাতন্ত্রের জন্ম দেবে “যা কেবল অতিমারীর ওপরেই ভরসা করে বেঁচে থাকবে”। তিনি এও বলেছেন যে, “স্বাভাবিকভাবেই এই ধরনের অতিমারী বারবার ঘোষণা করার একটা কূটনৈতিক স্বার্থ নয়া আমলাতন্ত্রের মধ্যে কাজ করবে। এই আমলাতন্ত্র নিজের অস্তিত্ব এবং প্রাসঙ্গিকতা টিকিয়ে রাখার, নিশ্চিত করার চেষ্টাই করে যাবে। আর তার জন্য হয়তো তারা এই সর্বনাশা লকডাউনকেই অতিমারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার একটি স্থায়ী ব্যবস্থা করে তুলবে”।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিভিন্ন সময়ে যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার পিছনে যে কর্পোরেট গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব ছিল বা থাকে সেকথা অতীতে এবং সাম্প্রতিক কালেও প্রমাণিত হয়েছে।

তাই ডক্টর বেল হতাশ হয়ে বলছেন, যেকোনোও বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পিছনে কর্পোরেটদের একটাই ভাবনা থাকে। তা হল, তারা যাতে এমন পরিমাণে মুনাফা লুঠতে পারে যাতে তাদের শেয়ারহোল্ডাররা সর্বোচ্চ রিটার্ন পায়। “সেই কর্পোরেট সংস্থা যদি কোনও ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানি চালায়, তাহলে সে দেখবে, জনসাধারণ যেন কিছুতেই শারীরিকভাবে সুস্থ না-থাকে, তাদের শরীরে যাতে স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি না হয়। তারা বরং এমনভাবে ওষুধ তৈরি করবে আর চিকিৎসার সরঞ্জাম বিক্রি করবে যাতে রোগ জিইয়ে থাকে”।

ভারতের মত দেশে চিকিৎসাযোগ্য এবং প্রতিরোধযোগ্য এমন অনেক স্থানীয় অসুখ আছে যা খুব ছোঁয়াচে এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, যার মারণ ক্ষমতা এইসব নতুন ভাইরাসের চেয়ে অনেক বেশি। এবার প্রস্তাবিত চুক্তি অনুযায়ী এইসব দেশের জনস্বাস্থ্যের রাশ যদি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হয়, যদি সিদ্ধান্তের অধিকার ওই বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হাতেই চলে যায়, তাহলে এইসব স্থানীয় ব্যাধি-দুর্ব্যাধিগুলোর দিকে যত্ন নেওয়ার বদলে তারা বারবার আপাত-নিরীহ ভাইরাসের প্রেক্ষিতে অতিমারী ঘোষণা করবে। সেই পরিস্থিতি আদতে মানবসভ্যতার শেষের সূচনা।

একদিকে যেমন বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা তার নতুন প্রস্তাবিত অতিমারী চুক্তি দিয়ে বিভিন্ন স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্ব কেড়ে নেবার আতঙ্ক তৈরি করছে, অপরদিকে ঠিক তেমনি ২০২২ সালে সংসদের বাদল অধিবেশনে নতুন যে-জনস্বাস্থ্য বিল ভারত সরকার নিয়ে আসবে বলে শোনা যাচ্ছে, সেই বিল যে কোনও ব্যক্তি মানুষের স্বাধীনতা এবং মানবাধিকার কেড়ে নেবার আইনী সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। এই প্রস্তাবিত চুক্তি বা বিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অতীতের সেই নাৎসি যুগের নুরেমবার্গ ট্রায়ালের কথা বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে।

সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার এই যে, ওই প্রস্তাবিত বিল যদি পাস হয় তাহলে মানুষের নিজের শরীরের ওপরে তার মৌলিক অধিকার, তার নাগরিক স্বাধীনতা সম্পূর্ণ রসাতলে যাবে। কেননা যেকোনও ধরনের অতিমারি কিংবা জনস্বাস্থ্যের যেকোনোও ধরনের কল্পিত সংকটে চিকিৎসার নামে যে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। যে কোনও স্থান বা যে কোনও অঞ্চল গায়ের জোরে প্রবেশ করে দখল নেওয়া যাবে। জোর করে সন্দেহজনক যে কাউকে পৃথক করে বা কোয়ারেন্টাইন করে রাখার মত নানা রকমের কঠিন ব্যবস্থার বিধান এই বিলে রাখা হয়েছে। এবং এই কর্মকাণ্ডের একচ্ছত্র ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে পুলিশের হাতে। আর এগুলো সবই করা হচ্ছে মানবতার বৃহত্তর স্বার্থের অজুহাতে।

মানুষ পুলিশ এবং আমলাতন্ত্রের মর্জির উপর বেঁচে থাকবে। এই নয়া পুলিশ এবং আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে কিন্তু কোনোরকম শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। যদিও জনমানুষের ‘ভাল’ করার নামে তারা যা খুশি তাই করতে পারে। একইসঙ্গে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রস্তাবিত চুক্তি মিলিয়ে সামগ্রিকভাবে বিশ্বব্যাপী এক অদ্ভুত ধরনের চরম স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতার জন্ম নেবার আশংকা তৈরি হয়েছে।

আমরা আশা করতে পারি যে এই প্রস্তাবিত চুক্তি এবং বিল নিয়ে নাগরিক সমাজে দীর্ঘ বিতর্ক হবে, সংসদে দীর্ঘ আলোচনা হবে। আইনী পরামর্শদাতাদের মতামত নেওয়া হবে। যারা জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেন এবং যারা জনস্বাস্থ্যের নীতি নিয়ে আলোচনা করেন তাদের মতামত নেওয়া হবে। আর এই সবকিছুই করা হবে স্বচ্ছতার সঙ্গে।

সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের কিছু কথা থেকে আমরা অবশ্য খানিকটা স্বস্তি পেতে পারি। তিনি বলেছেন “রাষ্ট্র মিথ্যা প্রচার করতে পারে কিন্তু নাগরিক সমাজকে সব সময় সতর্ক নজরদারি করতে হবে। এবং এই মিথ্যা গুলোর পর্দা ফাঁস করে দেওয়ার দায়িত্ব সতর্ক নাগরিকদেরই”।

(নিবন্ধের স্বচ্ছন্দ ভাষান্তর, অরূপশংকর মৈত্র। লেখক ডক্টর অমিতাভ ব্যানার্জি সেনাবাহিনীতে মোবাইল মহামারি টিমের প্রধান ছিলেন। বর্তমানে তিনি পুনের ডক্টর ডিওয়াই পাটিল মেডিক্যাল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের প্রধান।)

0 Comments

Post Comment