হাত কতক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বন্দীরাম সৎপথী চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, তবে আর কলিকাল কাকে বলে। এক পা ও রাধা বিনে চলে না।
সদ্য তিন মাস মাতৃহারা পাঁচ বছরের অজিতেশও মামার সঙ্গে জোর শব্দ করে কেঁদে উঠেছিল সেদিন।
মন্মথর নতুন বৌ শৈলবালা এটাচিখানা দোর দিকে তুলে রেখে অজিতেশকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কাঁদছ কেন বাবা। আমি যখন এসে গেছি তোমাদের আর কোনো কষ্ট হবে না।
কথা শেষ করে অজিতেশের গালে চুম্বন করলেন শৈলবালা।
নলিনী খুড়ি ঈষৎ মুচকি হেসে মুখ বিকৃত করে বললেন, সুখে রাখবে জগতের সকলেই বলে। কিন্তু সৎ মা সে তো সৎ ই কিনা।
এমন সময় মন্মথর খুড়িমা মাথায় একহাত ঘোমটা টেনে উঠোন পেরিয়ে চৌকাঠে পা দিয়েই বললেন, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে চলবে? না কি নতুন বৌমাকে বরণ করবে!
মন্মথদের বাড়ির ঝি চঞ্চলা এতক্ষণ দুয়োরের খুঁটিটা ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব আলাপ আলোচনা শুনছিল। খুড়িমার আদেশ বলবত হতেই ঘরের ভেতর থেকে সাজানো বরণ ডালাটা এনে খুড়িমার হাতে দিল চঞ্চলা।
মন্মথর খুড়িমা প্রদীপ, দই এর ফোঁটা দিয়ে কোনরকমে বধূ বরণ সেরে নতুন বৌকে ঘরে তুললেন।
সে আজ বছর কয়েক আগের কথা।
যত দিন যেতে লাগলো মন্মথ বাঁড়ুজ্যের নতুন বৌ এর রুপটিও ক্রমশ প্রকাশ হতে লাগল।
অজিতেশকে খেতে দেবার পরিমান যেমন কমতে লাগলো। তেমনই অজিতেশের পড়াশোনা বাবদ খরচ খরচা, পড়ার সময়ও কমতে লাগল।
মন্মথ অফিস বেরিয়ে গেলে বাজার করা, ছোট ভাইকে টিউশন থেকে আনা, জল তোলা থেকে শুরু করে ঘরের যাবতীয় কাজ শেষ করে তবে অজিতে শের স্কুলে যাবার অনুমতি হল।
সৎ মায়ের এই নববিধান ছোট্ট অজিতেশ বাবাকে কোনদিন বলতে পারল না।
দিনে দিনে অজিতেশের স্কুলের রেজাল্ট খারাপ হলে মন্মথ ছেলেকে বকাঝকা করলে অজিতেশ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করত আজ বাবা অফিস থেকে ফিরলে বাবাকে সব কথা বলব।
কিন্তু সন্ধ্যেবেলা বাবার ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফেরা ছোট্ট অজিতেশকে সব কথা ভুলিয়ে দিত।
এরমধ্যে সব ওলটপালট হয়ে গেল। মন্মথর অফিস থেকে খবর এলো অফিসের টেবিলেই স্ট্রোক হয়ে মন্মথর অকাল প্রয়াণ হয়েছে।
মন্মথ দেহ রাখার পর আর একদিনের জন্যেও অজিতেশের এ বাড়িতে ঠাই হয়নি।
সেই থেকে আজ অবধি অজিতেশ এক অনাথ আশ্রমের আবাসিক।
২
এ বছর অজিতেশ ইঞ্জিনিয়ারিং এ কানপুর আই আই টি তে চান্স পেয়েছে। এখন অজিতেশ আর এক সমস্যাই পড়েছে।
সরকারি কলেজে না হয় পড়ার খরচ লাগবে না। কিন্তু সুদূর কানপুরে পড়তে গেলে থাকা খাওয়ার খরচ তো সামান্য হলেও একটা আছে।
এমন উদ্বেগের সময় ডাকে এলো একখানা ছোট্ট চিঠি।
অজিতেশ চিঠির মোড়ক খুলে দেখে একটি খোলা চিঠি। আর একটি মুখ বন্ধ খাম। খামের ভেতর যে কাগজ আছে তা বোঝা যাচ্ছে।
অজিতেশ প্রথম খোলা চিঠিটিতে চোখ রাখল।
প্রমথ কাকুর হাতের লেখা চিনতে অসুবিধে হল না অজিতেশের। বাবা চলে যাওয়ার পর প্রমথ কাকুই ওকে অনাথ আশ্রমে রেখে এসেছিল। অনাথ আশ্রমে মাঝে মাঝে দেখা করতে যেত।
চিঠিতে লেখা
‘বাবা অজিতেশ, তোমার আঠারো বছর বয়স পার হয়ে গেছে। এবার আমি দায়মুক্ত হতে চাই। তাই তোমাকে এই চিঠি। মুখ বন্ধ খামের ভেতর চিঠিটি পড়ে তোমার জিনিষ বুঝে নাও বাবা।
ইতি
তোমার প্রমথ কাকু।’
অজিতেশ প্রমথ কাকুর চিঠিটি পড়ে চিঠিটি টেবিলে রেখে মুখ বন্ধ খামের ভেতরের চিঠিটি খুলল।
এতদিন পর বাবার হাতের লেখা চিঠির ওপর হাতটা রাখল সে। তারপর বাবার হাতের লেখা চিঠিতে চোখ রাখল অজিতেশ। পড়া শেষ হলে অজিতেশ বাকরুদ্ধ।
চিঠিতে লেখা –
' বাবা অজিতেশ,
কয়েকদিন ধরেই শরীরটা আমার ভালো যাচ্ছে না। তাই আমাকে দ্রুত এই সিদ্ধান্ত নিতে হল। বর্ধমান শহর ছাড়িয়ে দুই কামরার বাড়িসহ পাঁচ বিঘার একটি জমি তোমার নামে আমি ক্রয় করে রাখলাম। আমার অবর্তমানে ১৮ বছর বয়স হলে তুমি এই সম্পত্তি ভোগ দখল করবে তোমার জীবনব্যাপী। এখান থেকে কিছু জমি বিক্রয় করে তোমার পড়াশুনার খরচ চালাবে। জমির কাগজপত্র আমার বন্ধু প্রমথর কাছে রেখে গেলাম। তোমার ১৮ বছর বয়সের পর সে সম্পত্তির দলিল তোমার হাতে তুলে দেবে। ভালো থেকো আশীর্বাদ নিও।
ইতি তোমার বাবা মন্মথ ব্যানার্জি। '