আজ দুপুরে আত্ম-বিবেকে জর্জরিত, কীটদষ্ট বাঙালির একটি ফেসবুক-বাহিত প্রলাপের সম্মুখীন হলাম। জনৈক পদ্মনাভ দাশগুপ্ত (বোধ হয় তিনি এক কালে খবর পড়তেন টিভিতে) অপরাধবোধে দগ্ধ হয়ে গিয়ে লিখেছেন:
'আমার একটা প্রস্তাব আছে। আগামী এক বছর আমরা কোন ব্র্যান্ড ব্যবহার করব না। জামাকাপড় হাতিবাগান গড়িয়াহাট বা ভবানীপুরের দোকান থেকে কিনব। প্রসাধন থেকে শুরু করে মুদির যাবতীয় জিনিস ছোট ব্যবসায়ীদের থেকে কিনব। পৃথিবী জোড়া ব্র্যান্ড র ঠিক সামলে নেবে কিন্তু আমার দেশের ছোট ব্যবসায়ীদের ভরসা আমরা। যদি সম্ভব হয় সমস্ত কেনাকাটার ক্ষেত্রে এই পাশে থাকা সম্ভব হয় তাহলে কিছুটা পাশে দাড়ানো যাবে। কিছু লোক শপিং মলে যাবেন তাদের আটকানোর ইচ্ছেও নেই। কিন্তু আমাদের মতো কিছু মানুষ যারা এখনো মনে করি আমাদের কিছু করার আছে , চেষ্টা করা যাক একটু। সবাই মিলে যদি এটা কিছুটা করা যায় অনেক মানুষ বেঁচে যাবেন।'... ইত্যাদি।

পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের দর সর্বদাই উঠতির দিকে। আর পদ্মনাভ মশাইয়ের পোস্টের জনগ্রাহ্যতা আছে ভাল মত– নেটরাজ্যে স্বতঃস্ফূর্ত সোচ্ছ্বাস সমর্থনের তোড় দেখে তা ঠাওর হল। কিন্তু পাপীর মন, তাই থেকে থেকে এ' কথাটাও মনে হচ্ছে– পোস্টের উদ্দিষ্ট জনতা তারাই, যাদের কাছে মলে-মলান্তরে ব্র্যান্ড-চকমকে পণ্য খরিদ করাটা স্বতঃসিদ্ধ। এই প্রতিজ্ঞা থেকেই লেখক উপনীত হয়েছেন পরবর্তী মহৎ অনুসিদ্ধান্তে: আগামী বছর তাঁরা বড় ব্র্যান্ডের জিনিসপত্তর কিনবেন না, এবং এই মর্মে আহ্বান রাখছেন জাতির উদ্দেশে– তাই তো?
কথাটা হল, গত কুড়ি বছরে দক্ষিণ কলকাতাস্থ নিওলিব মধ্যচল্লিশ বং প্রজন্মের ট্যাঁকের জোর এবং সামাজিক ক্ষমতা এই মুহূর্তে সংশয়াতীত। বিশ্বায়িত ধনতন্ত্রের প্যানোরামায় এঁদের বাজারদর তুমুল। কেন না এঁরা খদ্দের, এই শ্রেণির ক্রয়ক্ষমতা বিপুল, অতএব এঁদের হাতেই লুকোনো সেই গূঢ় জাদুকাঠি যা সর্বস্বান্ত কাপড়-বিক্রেতা থেকে নমো-নমো ক্ষীণ পুঁজির আশ্বাসে ব্যবসা-চালানো রোল-বানিয়ের জীবন ফতুর করে দিতে পারে এক লহমায়। তার জন্য কী লাগবে? ক্রেতাশক্তি? ধুচ্ছাই। কী লাগবে? পণ্যের গুণমান? আজ্ঞে, না। লাগবে সেই সর্বরোগহর অপরাধবোধ, যাতে উপনীত হয়ে লেখক নিজেও বুঝে গ্যাছেন তাঁর প্রায়শ্চিত্ত পালনের মেয়াদ– 'আগামী এক বছর।' অর্থাৎ চৈত্র যখন বৈশাখে সমে মিলবে, এঁদেরও অশৌচপর্ব শেষ হবে, বাবুদের ঠিক যে রকম পণ্যাসক্ত ও মলবিহারী অবস্থায় দিন কাটত প্রাক্-করোনা আমলে– তেমনটিই স্বমহিমায় বহাল থাকবে।
পোস্টটির গভীরে বিপজ্জনক একটি স্তর রয়েছে, একটু নাড়াচাড়া করলেই তা চট করে উঠে আসে। তার মর্মার্থ: অ-ব্র্যান্ডের যে সমস্ত জিনিসপত্র, তা এমনিতে পণ্যমানে খুবই এবড়োখেবড়ো, কিনে হাত না-পোড়ানোই মঙ্গল। এই পরিস্থিতিকে বলে 'স্বাভাবিক অবস্থা'– এমতাবস্থায় বাজারের নিয়মেই বাজার চলবে, অর্থাৎ, গরিব দোকানি মাছি তাড়াবে, আর বাঙালিবাবুরা ধুতি পরে কোয়েস্টে গুচ্চির বানানো ব্র্যান্ডেড সজনেডাঁটা কিনবেন। পৃথিবীর যে কোনও সমাজে, যে কোনও সময়ে এমনটাই হয়ে থাকে– একে বলে নিয়ম। আর ব্যতিক্রমটা কখন? যখন করোনাটরোনার মত যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজে, যখন অসহায় বিক্রেতার ট্যাঁক জুড়ে শুধু শূন্যতা: বড় বেদনার সেই কাল। এমতাবস্থায় বাঙালি ফেসবুকারের সঙ্গে তার বৈষম্য পরতে পরতে বেড়ে চলে– শেষে এমন একটা অবস্থা হয়, বাঙালি ফেসবুকারের প্রাসাদে এত পয়সা ম-ম করছে, যে আস্ত একটা পলিটিক্যাল কারেক্টনেসই সে আজ কিনে নিতে পারবে! অথচ বাইরে লকডাউন। অতঃপর অসহায় বেদনায় গুমরি গুমরি পোস্টকর্তা ও তাঁর একশো জনের টার্গেট অডিয়েন্স ফেসবুকে তা প্রকাশ করেন। প্রকাশভঙ্গিটি চমৎকার: এমনিতে জিনিসগুলো পাতে দেওয়ার যোগ্যই নয়, কিন্তু এই দুঃসময়ে আমাদের নৈতিক কর্তব্য ওঁদের পাশে দাঁড়ানো৷ ক্রেতাশক্তির স্বাভাবিক ন্যায়বোধ নয়, এই মানসিকতার উৎসবিন্দু অপার করুণা ও দাক্ষিণ্য। সেই অমোঘ বিবেক যা পুরাকাল থেকে জাতিকে আছড়েপিছড়ে ফেলেছে, এবং তার সঙ্গে পাপস্খালনের দায়।
এই পাপস্খালনের জায়গাটা, আরও তলিয়ে দেখলে, পাতি ট্রেন্ড। সহজ হিসেব বুঝে নেওয়া ভাল। বিশ্বায়নের দিনকাল বিদায় নিয়েছে। এমনিতে ব্রেক্সিটফেক্সিটে বহু দিন হল নিয়েছিল, করোনা এসে তাকে বৈধতা দিয়েছে। যাকে প্রমাদে নীতি বলে মনে হচ্ছিল, মানে কচি রোঁয়া– তা আদতে অন্য কিছু। তা: ট্রেন্ড। সারা দুনিয়ার এয়ারপোর্ট বন্ধ, সমস্ত মোবিলিটি শিকেয় উঠেছে, ট্রান্সকন্টিনেন্টাল ব্যবসাট্যাবসা মাথায়, দিনের শেষে গ্লোবালাইজড ডিকশনারিতে পরিত্যক্ত হতভাগা রাষ্ট্রকে ময়দানে নামতে হচ্ছে নাগরিকদের সুরক্ষিত রাখার জন্য। এই অবস্থায় বাঙালি কী করবে? কেন, বিগত দিনের জন্য বুকফাটা হাহাকার করবে! তার মনে তো পাপবোধ ক্রমশ জমে উঠছে, কারণ সে বিশ্বায়নের আগে ছিল এক, আর বিশ্বায়ন-পরবর্তী সে হয়েছে বীভৎস বকচ্ছপ, এখন বিশ্বায়ন চুলোয় উঠেছে, সংকটকালে পাড়ার মুদিখানা সাপ্লাই দিচ্ছে এ দিকে সাউথ সিটি আজ এক মাস হল বন্ধ, সারা পৃথিবী গ্লোবালাইজেশনের অসারতা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরে তাকে রিজেক্ট করেছে, অতএব স্মার্ট ও কারেক্ট বাঙালিরও ঠিক অমনটিই করা চাই। সে ক' দিন এখন হবিষ্যি খাবে, আলুর খোসার তরকারির রেসিপি শেয়ার করবে, লব্জ মানলে ভেগান হয়ে উঠবে, মাটির গন্ধওলা তালপাতার পাখায় হাওয়া করবে সুইচ নিভিয়ে, আরও অর্গ্যানিক, আরও হেলদি লাইফস্টাইল লিড করবে। শুধু তো করবে না– করে দস্তুর মতো মহত্ত্ব অর্জনের চেষ্টা চালাবে। এমনিতে ফুটপাতের জামাকাপড়কে যে অপছন্দ করত, ওমনিতে সে গড়িয়াহাটের মোড়ে লম্ফ মেরে মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় গলবস্ত্র হয়ে লুফে নেবে– ট্রেন্ডে বলেছে, না! দুঃখী, দুঃস্থ, বেদনার্ত হকারভাইদের পাশে দাঁড়াতে চেষ্টা করবে, তাতে তার কারেক্টনেসের টিয়ারপি বাড়ে, আর প্রাক্-বিশ্বায়ন অতীত কণ্ডূয়নের মাধ্যমে এই ভ্যাদভেদে জীবনকে যথাযথ দুচ্ছাই-বর্ষণও করা যায়। কী অসুখী বিশ্বায়ন এল রে ভাই, বাবুরা কোথায় এক মাস কোয়েস্টে গিয়ে গুচ্চির বানানো পটলের দোলমা চিবোতেন, তা নয়– বাড়ি বসে থাকো। নেটফ্লিক্সই বা কত ক্ষণ পোষায়! অতএব এক করাল অপরাধবোধে এই বিবেকবাবু ও বিবেকবিবিরা দষ্ট, এ তো দেখতেই পাচ্ছি।
শ্রেণিচরিত্রের মজা অবশ্য এখানেই বাকি নয়। পীড়িত ভাইবোনদের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দিয়ে যে পোস্ট ঘুরছে, দেখলাম, তাতে সকলে নামের ওজন বাড়াতে পেশা থুড়ি পদবিটিও যুক্ত করে নিচ্ছেন। কেউ লাখপতি ব্যবসায়ী, কেউ বাগানের সমঝদার, কেউ সাঙ্ঘাতিক উকিল। এরই তোড়ে এক নগণ্য মানুষ, কী আর করবেন, ব্যঙ্গার্থেই কি-না, লিখেছেন: 'সুদীপ্ত মণ্ডল, সাধারণ মানুষ।' আহ্ রে, পেডিগ্রিটা জোরদার ছিল না সুদীপ্তর!
অপরাধবোধ দেখে চোখকান হেজে গেল, মশাই। এখন আপনার লাইফস্টাইলে আটকাচ্ছে বলে আপনি খপাৎ করে অর্গানিক হয়ে ওঠার দুর্দান্ত চেষ্টা করে যাবেন, এমন তো হয় না। পারলে চর্যাটুকু উন্নততর করে তোলা ভাল, আমাদের মধ্যবিত্তের প্রত্যেকেরই। যেখানে কোনও মহত্ত্ব আর কারেক্টনেসের লোভে এঁদো ফুটপাত থেকে কিনে পোস্ট মারতে হয় না, বরঞ্চ স্বাভাবিক ক্রেতা হিসেবেই কেনা যায়, ঠিক যে ভাবে আপনি এত দিন গুচ্চির সাজানো বাগান থেকে পটল তুলে এসেছেন৷ লেখকবাবু, পারলে ঠ্যাকায় পড়ে নয়, স্বাভাবিক ভাবেই বিশ্বাস করুন, যে, আপনার-আমার কৌম স্বজাতি গ্রামে বসে যা উৎপাদন করে, তার সৃজন, শ্রম ও উপযোগিতা সত্যিই গুচ্চির পটলের চেয়ে সামান্য বেশি। আপনি রামগড়ে বসে বড্ড বেশি ভেবে নিয়েছিলেন যে আপনি ক্যালিফোর্নিয়ায় রয়েছেন, ঠাউরেছিলেন ব্যবস্থা আপনাকে সেই সুযোগ দিয়েছে যা মোতাবেক আপনি ঈশ্বর হয়ে উঠতে পারেন, দিনকে রাত করতে পারেন– এই মুহূর্তেও ভাবছেন হয়তো, আপনার করুণার প্রসাদ পেয়ে বাকি সমাজটা বর্তে যাবে। ইল্লি! এখন আপনার গত কুড়ি বছরের পণ্যরতি-ভ্রান্ত নষ্ট হওয়ার খতিয়ান দেখে 'এই দীনতা ক্ষমা করো প্রভু' জপ করছেন– কিন্তু সেই অনুশোচনার শরিক হওয়ার দায় অধিকাংশেরই নেই, বিশ্বাস করুন!