হিন্দু হোটেল বা হালাল খাবারের পৃথকভাবে চাহিদা সমাজে বরাবরই ছিলো। কিন্তু তাতে রাজনীতি ছিলো না। অন্নপূর্ণা হিন্দু হোটেলে মুসলিমরা এখনও সবজি বা মাছভাত তৃপ্তি করে খান, উল্টোদিকে আমিনিয়ার মতো মুসলিম রেস্টুরেন্টে মুরগির ঠ্যাং চিবিয়ে আসেন অমুসলিমরা। এতে এতোকাল সমস্যা হয়নি। কারণ এটাই স্বাভাবিক। আজ হঠাৎই পরিকল্পিত বিদ্বেষের কারণে সমস্যা হচ্ছে৷ নইলে রাস্তার ধারে কচুরি বিক্রি করা শ্যামলকাকু বা রোলের দোকানের ইলিয়াসদার ছোঁয়াছুঁয়িতে সমস্যা দেখিনি গত দেড় দশকের বেশি সময়ে। 'বিশেষ ধর্মের কারো বহন করা খাদ্যদ্রব্য নেবো না' ট্যুইট করে খোঁচানোর অর্থ বিশেষ ধর্ম বা শ্রেণীকে বয়কটের মতবাদ প্রচারের চেষ্টা৷ এগুলো পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা। প্রথমে কৌশলে হিন্দু-মুসলিম আনা হলো। তারপর এলো হারাম-হালাল প্রসঙ্গ। এভাবেই পরস্পর লড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা। এই ডামাডোলে দেশের মূল ইস্যুগুলো অগোচরে রয়ে যাবে। মাঝখান থেকে ফিক্সড ডিপোজিটে সুদের হার কমিয়ে দেওয়া হল, সেটা নিয়ে খেয়াল নেই কারো। জোম্যাটো বিতর্ক সামনে আসার পর জোম্যাটোর অ্যাপে হালাল খাবার দিয়ে সার্চ করে হালাল রেস্তোরাঁর লিস্ট খুঁজে, সেটার স্ক্রিনশট তুলে জোম্যাটোকে মেকি ধর্মনিরপেক্ষ বলে চালাতে চাইছেন একটা অংশ। কিন্তু একইভাবে জৈন ফুড সার্চ করলেও পেঁয়াজ-রসুন-আদা ছাড়া নিরামিষ রান্নার তালিকা আসে। জৈনরা নিরামিষ খাবেন; এটি যেমন একটি বিশ্বাস, তেমনি কেউ হালাল খাবেন; সেটাও সমগোত্রীয় চিন্তাভাবনা। কিন্তু জ্যোমাটোর মতো খাদ্য পরিবহণ সংস্থায় 'অমুকের হাতে খাবো না' বলাটাকে নিরামিষ খাওয়ার প্রচেষ্টার সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে রাজনীতির শিকার হতে হয়। গোমাংস, শুয়োর, এমনকি ১০০% নিরামিষ-- কে কী খাবেন সেটা একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু কে খাবার ডেলিভারি করবেন এটা নিয়ে ধর্ম বাছা কি সমীচীন ? হালাল ফুড বা জৈনদের নিরামিষ খাদ্যের চাহিদার সঙ্গে খাবার পরিবহণকারীর ধর্ম এক পংক্তিতে আলোচনা চলতেই পারে না। আগামীদিনে ব্রাহ্মণ যদি দলিতের ডেলিভারি করা খাবার নিতে অস্বীকার করে তাহলে সমাজে জাতপাত এবং ছোঁয়াছুঁয়ির নিয়ম ব্যাপকভাবে পুনর্বহালের সম্ভাবনা তৈরি হবে। খাদ্যের ধর্ম আছে কি নেই, সেই তর্কের মধ্যেই জ্যোমাটো তাদের প্রচার সেরে নিলো। বিতর্কে বিনাপয়সায় ভালো বিজ্ঞাপন হয়৷ খাদ্য সত্যিই ধর্ম কিনা সেই তর্ক উস্কে দিয়ে ২০১৮ সালের একটি ঘটনার কথা উঠে আসে। ফুড ডেলিভারি করতে বেরিয়ে ক্ষুধার তাড়নায় ডেলিভারির প্যাকেট থেকে খাবার বের করে খান জনৈক ডেলিভারি বয়। সেই ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে পড়তেই নানান ট্রোল, নিন্দার ঝড় সোশাল মিডিয়া জুড়ে চলতে থাকে। দলবেঁধে সবাই জ্যোমাটো বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন। তার ফল হিসেবে প্রফেশানালিজমের দোহাই দিয়ে ওই যুবককে বরখাস্ত করা হয়। কর্মহীন অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়া হয় তাঁকে। ক্ষুধার জ্বালায় কেউ খাবার তুলে খাওয়ার পর সেই ক্ষুধাধর্মকে শ্রদ্ধা জানানোর ক্ষমতা দেশবাসী ও ওই বিশেষ সংস্থার ছিলো না। তলিয়ে ভাবলে দেখা যায় জ্যোমাটোর বার্তাটি সুন্দর হলেও জোমাটোর মতো সংস্থার কাছে ফুড কোনো রিলিজিয়ন নয়। প্রচার ও মুনাফাই শেষকথা। খাদ্য ধর্ম হলে ধর্মসর্বস্ব ভারতবর্ষে প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি মানুষকে অভুক্ত বা আধপেটা অবস্থায় ঘুমোতে হতো না। 'মুসলিমদের হাতে খাবার ডেলিভারি নেবো না' এই দাবীর মধ্যে রাজনীতি আছে, রয়েছে সচেতনভাবে বয়কটের অভিপ্রায়। এমনিতেই সরকারি চাকরিতে যোগ্যতা অনুযায়ী মুসলিমদের অন্তর্ভুক্তি কম। এমনকি প্রতিবেশী বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের সরকারি চাকরিতে অন্তর্ভুক্তির চেয়ে অনেক পিছিয়ে ভারতীয় সংখ্যালঘুরা। সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের নেওয়া যাবে না, ব্যবসায় বয়কট, প্রাইভেট কোম্পানিতে মুসলিমদের নিয়োগ করতে অস্বীকার করার ঘটনাও প্রকাশ্যে এসেছে সাম্প্রতিক অতীতে। কিছু সঙ্ঘী নেতার ভাষণে মুসলিমদের দোকান, ব্যবসা ইত্যাদি বয়কটের কথা শোনা গেছে। এমনকি মুসলিমদের বাড়িভাড়া দিতেও একশ্রেণীর হিন্দু সরাসরি অস্বীকার করেন। কেউ যদি দাবি করে বসে মুসলিম শিক্ষকের কাছে পড়বো না, মুসলিম চালকের বাসে চড়বো না, মুসলিম সেনার উপর ভরসা করবো না। তা দেশের সার্বিক অবক্ষয়ের রাস্তা প্রশস্ত করবে। ধর্মনিরপেক্ষতা ভীষণভাবে ব্যাহত হবে, তাই এর সমাধান খোঁজা জরুরি। নতুন ভারতের একটা অংশ অশিক্ষিত মুসলিমদের ভিখারি বা পকেটমার করে রাখতে চায়, আর শিক্ষিত মুসলিমদের কর্মহীনতার দিকে ঠেলে দিতে পারলেই বাঁচে।তাদের বক্তব্য, 'মুসলিম হটাও, শান্তিতে ব্যবসা করো' । জ্যোমাটো বিতর্ক কি সেদিকেই ইঙ্গিত করছে না?