অনুপ্রবেশ এবং পরিযান নিয়ে কয়েকটি কথা তৃতীয় পর্ব
অনুপ্রবেশ এবং পরিযান নিয়ে কয়েকটি কথা ২য় পর্ব
অনুপ্রবেশ এবং পরিযান নিয়ে কয়েকটি কথা ১ম পর্ব
অনুপ্রবেশ এবং পরিযান নিয়ে আগের তিনটি পর্বে কিছু কথা বলেছিলাম। আমার লেখার মূল উদ্দেশ্য ছিল, SIR নিয়ে যে জনমতগুলি গড়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে, তার পশ্চাতে অঙ্কের সত্যিটা কতটা? আর অন্য একটা প্রচেষ্টা অবশ্যই ছিল। সেটা হল, আমার বয়সের কারণে হয়ত আজকের নাগরিক বাঙালিকে আমি চিনতে পারছি না, হয়ত নজরের চালসের কারণে আমিই অন্যরকম ভাবছি, এটাই হয়ত সময়ের লক্ষণ। সেই লক্ষণটা দেখে আমি কিছুটা আতঙ্কগ্রস্তই। আমি ধরতে চাইছিলাম, আর কেউ আমার মত ভাবছেন কি না। নাগরিক বাঙালি এত বদলে গেল কোন অভিঘাতে? আরেকজন বাঙালি অন্যত্র অপমানিত হচ্ছে, চূড়ান্ত নিগৃহিত হচ্ছে শারীরিক এবং মানসিক ভাবে, হঠাৎ করেই অন্ধ ক্ষমতার দাপাদাপিতে জীবন ও জীবিকা চ্যুত হচ্ছে, আর অন্যদিকে একদল বাঙালি সেই নিগ্রহের পশ্চাতে, অত্যাচারের পশ্চাতে যুক্তিসঙ্গত কারণ হাজির করছে, নিদান দিচ্ছে, কই, কোথাও তেমন কিছু হচ্ছে না, সব লিবারেলদের মনগড়া গল্প। বক্তব্য টা এইরকম, বাঙালি নিজের রাজ্যে ভাত জোগাড় করতে পারে না, ভাতের খোঁজে অন্য রাজ্যে পাড়ি দিতে হয়, তার আবার এত কথা! নাগরিক বাঙালির ( আদতে সাংস্কৃতিক বোধহীন বাঙালির) এই স্বকল্পিত বয়ানটিকে আমি মিথ্যা প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম।
SIR কার্যক্রম, অর্ধেক গড়াতে না গড়াতেই শুরু হয়ে গেল বাংলা মিডিয়ার TRP এর দৌড়। দলে দলে মানুষ ওপার বাংলায় পালাচ্ছে। ‘দলে দলে’ বলে দিলে আর কোন দায় থাকে না সংখ্যা দিয়ে প্রমাণের। এই রাজ্যের সবাই নাকি স্বরূপনগরের হাকিমপুর সীমান্ত দিয়ে ওপার বাংলায় পালাচ্ছে। কেন পালাচ্ছে? SIR এর ভয়ে পালাচ্ছে। নিউ টাউন এর বস্তি অঞ্চল ফাঁকা, কেষ্টপুর শূন্য, রাজারহাট খালি হয়ে গেল। তার দিন দুয়েক পরে একটি চ্যানেল নির্লজ্জের মত ক্ষমা চাইল এই বলে, যে ভিডিওটা অন্য জায়গার ছিল, ওটা হাকিমপুর দিয়ে পালানোর ছবি নয়। অনেকে আবার ভুল স্বীকার করার পথ মাড়ায়নি। ‘দলে দলে’ পালাচ্ছে আর আমরা সেটা দেখানো থেকে পিছিয়ে থাকব! এইভাবে ‘দলে দলে’ পালানো যায় স্বীকৃত এন্ট্রি পয়েন্ট দিয়ে? বাংলাদেশ এত অবৈধ অনুপ্রবেশকারীকে বিনা প্রতিবাদে ফিরিয়ে নিচ্ছে? কেউ এসবের প্রতিবাদও করে না! কেন করে না? প্রতিবাদ করলে কি দেশদ্রোহীর তকমা জুটে যাবে? কবে থেকে এত লজ্জাহীন হয়ে গেল বাঙালি? পশ্চিমবঙ্গের মাননীয় রাজ্যপাল আরেকজন টিআরপি খোঁজা মানুষ। তিনি চলে গেলেন, হাকিমপুর সীমান্তে। এটা তাঁর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে? কেউ জিজ্ঞেসও করে না মহামান্যকে। তা তিনি গেলেন, আবার ফিরেও এলেন সীমান্ত পরিদর্শন সেরে। সংবাদপত্রের খবরে দেখলাম, রাজ্যপাল ফিরে যাওয়ার পরেই সীমান্তে মানুষের ঢল! রাজ্যপাল সীমান্তে গিয়েছিলেন সীমান্তে, তাই অনুপ্রবেশকারীরা সীমান্ত পার হতে দ্বিধা করছিল, সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী তিনি ফিরে আসার পরেই ‘ঢল’! তারপর অনুসন্ধানে জানা গেল, সেইদিন হাকিমপুর সীমান্ত দিয়ে আইন মোতাবেক পার হওয়ার জন্য গিয়েছিলেন ৭০ জনের মত। তারমানে ৭০ জন প্রতিবেশী দেশের বৈধ মানুষ হয়ে গেল অনুপ্রবেশের ‘ঢল’!
এই দিন দুয়েক আগে, এক দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদীকে চ্যানেলের ক্যামেরায় বলতে শুনলাম , এই রাজ্যের বর্তমানের ভোটার তালিকা অনুযায়ী সাড়ে সাত কোটির মধ্যে চার কোটির মত মানুষের নাকি ২০০২ এর তালিকার সঙ্গে লিগ্যাসি ম্যাপিং করা যাচ্ছে না, তাই এই চার কোটিই অবৈধ অনুপ্রবেশকারী! ভাবছিলাম, এরা কোথাকার গঞ্জিকা সেবন করে, মনিপুরী না আফগানী? এনাকে তো ফটো করে বাঁধিয়ে গ্যানেশজীর চেম্বারে ঝুলিয়ে রাখা উচিত।
যেটা প্রথম পর্ব থেকে বলার চেষ্টা করে এসেছি, সেটাই আবার এই উপসংহারে ফের বলি, পুনরাবৃত্তির অভিযোগ শুনতে হবে, এই আশঙ্কা নিয়েই বলি, সব রকম ধ্যাষ্টামো বাদ দিয়ে, ভোটের রাজনীতির নোংরা কুম্ভীপাক ছেড়ে কেন্দ্রের সরকারের সময় এসেছে প্রকৃত অর্থে সরকারের দায়িত্ব পালন।
অনেক বাজে অজুহাত দেওয়া হয়েছে। ২০২১ এর সেনসাস চালু করেননি, করোনার অজুহাতে। কিন্তু বিহার, পশ্চিমবং, তামিলনাড়ু, কেরালা, আসামে বিধানসভার নির্বাচন করতে করোনা বাধা হয় নি। আজ বলছেন, সেনসাস-২০২৭ শুরু হবে, তার মানে পরের সেনসাসের তথ্য আসতে ২০৩২। অজুহাত হিসাবে খাড়া করা হচ্ছে সংবিধানের ৮৪ তম সংশোধনী। পাশাপাশি এটাও ধরে নিতে হবে মহিলাদের সংরক্ষণ ২০৩৫ এর আগে শুরু করা যাবে না।
একটা গোটা দেশের জনগণনা প্রক্রিয়া আদতে দেশকে নতুন করে অনুসন্ধান। এটা একটা সাংবিধানিক মুহূর্ত যখন এক গণতন্ত্র চিনে নিতে চেষ্টা করে, কাদের নিয়ে আমি। কাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। দীর্ঘ ১৪৩ বছর ধরে একটা প্রক্রিয়া চলছিল, যাঁরা চালাচ্ছিলেন, তাঁরা নিশ্চয়ই সবাই নির্বোধ ছিলেন না, যেমনভাবে সঙ্ঘীরা ভেবে নেয়। সেই কর্মসূচিকে কেবল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ১৬-১৭ বছর পিছিয়ে দেওয়া হল, এই পিছিয়ে দেওয়া আসলে সামগ্রিক উন্নয়ন ভাবনাকে পিছিয়ে দেওয়া। নাকি বৃহদাংশের জন্য উন্নয়ন ভাবনা বলে আজ আর কিছু হয় না?
যা কিছু সিদ্ধান্ত, তাহলে সেগুলো নেওয়া হচ্ছে ২০১১ এর সেনসাস তথ্যের ওপরে ভর করে। আজকের অভিবাসী প্রধান শহরগুলোর কোন প্রকৃত তথ্য এই সরকারের হাতে নেই, এই না থাকাটাই কি রাজনীতির সুবিধা? তাহলে রাজনীতির গাঁটবন্ধনের জন্য, জোট সরকার করে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বিহার আর অন্ধ্রপ্রদেশকে অর্থনৈতিক প্যাকেজ জুটিয়ে দেওয়া যায় আর এই রাজ্যের প্রাপ্য যেনতেন প্রকারে নানা ছলচাতুরি করে আটকে রাখা যায়। আজকের ফিন্যান্স কমিশন কিসের ভিত্তিতে রাজ্যগুলিকে অর্থ প্রদান করছেন? ২০১১ এর তথ্যের ভিত্তিতে নিশ্চয়ই, তার মানে এখনই ১৪ বছর পিছিয়ে থেকে!
সেনসাস-২০২৭। তার মানে আগামী সেনসাস শুরু হওয়ার আগেই আমরা ১৬ বছর পিছিয়ে যাচ্ছি মাইগ্রেশনের প্রকৃত তথ্য থেকে। এই ১৬ বছরের ফাঁকে পরিযায়ী নির্মাণ শ্রমিক শহর মুম্বাই গড়ে তুলেছে, বাস করছে সেখানে আর তার তথ্য রয়ে গেছে বিহারে, উত্তরপ্রদেশের গ্রামে। রাজস্থানের জরি শিল্পে বা হরিয়ানার কারখানায় যে শ্রমিক ঘাম ঝরাচ্ছে সে সংখ্যায় রয়ে গেছে মুর্শিদাবাদ বা ওড়িশার গ্রামে।
শহরগুলির ব্যবস্থার মধ্যে এই পরিযায়ীরা রয়ে যাচ্ছে তাদের দৈনন্দিন জীবন নিয়ে কিন্তু তাদের কোন রাজনৈতিক অধিকার নেই এই আধুনিক শহরগুলিতে কেননা ১৪-১৫ বছর ধরে তারা কোন হিসাবের খাতায় নেই। শহরগুলির উন্নয়নের বাজেটে এরা নেই আবার যে গ্রাম ছেড়ে তারা চলে এসেছে সেখানকার উন্নয়নের বাজেট তাদের ধরেই হিসাব করা হচ্ছে। সরকার এগুলি জানে, কিন্তু এটাও ভাবে সব সংখ্যা জনগণেশের হাতে তুলে দিলে মুস্কিল , উন্নয়নের খেরোর খাতা নিয়ে তারা আর্বান নক্সালদের মত প্রশ্ন করবে। তার থেকে সেনসাস মুলতুবি রাখো।
দেশের সরকার আদতে নাগরিকদের অধিকারহীন রাখতে চায়, গণতান্ত্রিক অধিকার। যে গণতন্ত্র নিজেকে গণনা করতে ভুলে যায় বা করতে চায় না সে আদতে গণতন্ত্রের রোগ সৃষ্টি করে। এটা কেবল সংখ্যা নির্ধারণ নয়, এটা আত্ম অনুসন্ধান।
SIR প্রহসন বাদ দিন, সেনসাস শুরু করুন অনতিবিলম্বে, অনেক দেরী হয়ে গেছে। সৎ নাগরিকও জানতে চাইছে কত অনুপ্রবেশ আর কত পরিযায়ী।