এই মুহূর্তে রাজনৈতিক মহলে একটা বিতর্ক চলছে। বাঙলাতেও কি প্রতিবাদের বা আন্দোলনের বর্শামুখ বিজেপির দিকেই রাখা উচিত, নাকি এখানে যেহেতু অন্য একটি সরকার চলছে— বিরোধিতা তার দিকেই মুলত রাখা উচিত? এই বিতর্কের একটি অন্য দিক নিয়েও কেউ কেউ সোচ্চার, যেহেতু তৃণমূলের আমলেই বিজেপির বাড়বাড়ন্ত হয়েছে, যেহেতু এই দুই দলের মধ্যে একটা প্রতিদন্দ্বিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা বিদ্যমান, তাই এই দুই দলকে একই বন্ধনীর মধ্যে রেখে, দুই দলকে একই রকম আক্রমণ করা উচিত। কিন্তু, এখানে কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। কী করে এটা প্রমাণ করা সম্ভব যে মোদী এবং মমতা, দুজনেই একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ? শুধু বলে দিলেই তো হয় না। যারা এটা বলছেন, তাঁদের দায় বর্তায় এটা প্রমাণ করার। শুধুমাত্র এক জনকে ব্যক্তি আক্রমণ করলে, বা সিবিআই বা অন্য কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এই রাজ্যের বিভিন্ন নেতা নেত্রীর বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির তদন্ত করছে না বললেই কি এটা প্রমাণিত হয়? নাকি আরও কিছু করার থেকে যায়? প্রতিবেশী রাজ্য বিহারে ভোটের পরে যে নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হল, সেখানে একজন মন্ত্রীর নাম এসেছিল যিনি অতীতে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিরোধীরা এই নিয়ে সোচ্চার হতেই, ওই মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয় শপথ নেওয়ার ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই। এই ঘটনা দেখিয়ে দেয় যে সঠিক বিষয়ে সঠিক সময়ে আন্দোলন করা গেলে সুফল মেলে।
এবার ফিরে যাওয়া যাক, ২০১১ সালে, বাংলায় ভোটে বামপন্থীদের পরাজিত করে ক্ষমতায় এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কী বলেছিলেন? বলেছিলেন যে ৩৪ বছর বামেরা রাজত্ব করেছেন, এবার যেন পরের দশ বছর তাঁরা চুপ করে থাকেন। এখন তিনি বাংলার উন্নয়ন করবেন এবং তাঁর এই কর্মকাণ্ডে কেউ যেন বাধা সৃষ্টি না করে। উন্নয়ন, কী হয়েছে না হয়েছে সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ,কিন্তু বামপন্থীরা যে চুপ করে গেলেন, রাস্তা থেকে সরে সোশ্যাল মিডিয়াতে মনোনিবেশ করলেন এবং সেখানে সংখ্যা এবং প্রভাব বিস্তার করার দিকে পা বাড়ালেন, রাস্তার লড়াইটা সেখানেই শেষ হয়ে গেল। সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম নিয়ে তাঁদের যাবতীয় হা-হুতাশ বেরিয়ে আসতে লাগলো সোশ্যাল মিডিয়ায়। ২০২০-তেও তাঁরা এদিক ওদিকে বলছেন যে সিঙ্গুরে শিল্পস্থাপন হলে, আজকে রাজ্যের এই দশা হতো না, এতো বেকার থাকতো না, সেটার মধ্যে দিয়ে তাঁদের আক্ষেপ ছাড়া কিছু বেরিয়ে আসে না। তাঁরা এখনো মনে করেন যে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের আন্দোলন আসলে বুর্জোয়া মিডিয়া এবং তৎকালীন বিরোধী সব দলের একটা চক্রান্ত। কিন্তু এই বাম সরকারের পতনের পিছনে যে আরও বেশ কিছু কারণ ছিল, তা তাঁরা ভুলে যেতে চান। স্থানীয় নেতাদের ঔদ্ধত্য, দাদাগিরি বা দুর্নীতি বা স্বজনপোষণের অভিযোগগুলোও যে ছিল তা তাঁরা হয় ভুলে যেতে চান বা বালিতে মুখ গুঁজে উটপাখি সাজতে চান।
এর মধ্যে যে ঘটনা কেন্দ্রীয় স্তরে ঘটে গেছে, সেটা নিয়েও এই রাজ্যের ৩৪ বছরের রাজত্ব করা বামেরা উদাসীন। দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের পরিবর্তে কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসেছে এমন একটি দল যাদেরকে শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িক বলে সংজ্ঞায়িত করলে কম বলা হবে। তারা নিজেরাও নিজেদের বদল করেছেন এবং এবার তারা এসেছেন আরও রণংদেহী মুর্তি নিয়ে। তাদের পিছনে সংঘ পরিবারের রাজনীতি আগেও ছিল এখনও আছে। কিন্তু এবার তাদের সঙ্গে প্রচলিত গণমাধ্যম ছাড়াও আছে সামাজিক মাধ্যম, যার মধ্যে দিয়ে তারা সমাজের সব স্তরে বিষ ছড়াচ্ছে। তাদের মুল উদ্দেশ্য শুধু সংবিধান পরিবর্তন নয়, আরও অনেক কিছু। তারা কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা তুলে দিয়েছে, তারা রামমন্দিরের ভিত্তিস্থাপন করে দেখাতে চাইছে যে দেশের স্বাধীনতার আন্দোলনের থেকেও বড় এই রামমন্দিরের আবেগ। তারা ইতিহাসকে পরিবর্তন করতে চাইছে। তারা সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্তরে নিজেরাই একটা বিপর্যয়। এই দিকটা ভুলে গিয়ে যদি এই রাজ্যের শাসক এবং কেন্দ্রের শাসকের মধ্যে ফারাক করতে না পারা যায় তাহলে আবারো একটি ঐতিহাসিক ভুল হতে চলেছে। শুধুমাত্র নিজেরা ক্ষমতায় থাকার জন্যেই তৃণমুল, কেন্দ্রের বিজেপি যারা ইদানিং এই রাজ্যের মূল বিরোধীপক্ষ হয়ে উঠেছে তাদের বিরোধিতা করবে, পলিসিগত কোনও কিছুরই বিরোধিতা করবে না। তাই বামেদের দায়িত্ব ছিল বিজেপিকে সর্বস্তরে বিরোধিতা করার, যাতে তারা কেন্দ্রের বিজেপির বিরুদ্ধে আন্দোলনে তৃণমূলের প্রতিযোগী হয়ে উঠতে পারে। বামেরা যদি অনেকদিন আগে থেকে বিজেপির বিরুদ্ধে আরও সংগঠিত গণআন্দোলন গড়ে তুলতে পারত, তাহলে শুধু রাজ্য নয়, কেন্দ্রীয় স্তরেও তারা আরও প্রাসঙ্গিক থাকতে পারত। ঠিক যে ঘটনাটি ঘটেছে, হিন্দি বলয়ের অন্যতম প্রধান রাজ্য বিহারে। পরিযায়ী শ্রমিক থেকে শুরু করে, আশা কর্মীদের স্থায়ী চাকরির দাবীতে আন্দোলন বা অন্যান্য যে কোনও কেন্দ্রবিরোধী আন্দোলনে তাঁরা সামনের সারিতে থেকে যে নেতৃত্ব দিয়েছেন তার ফলই মিলেছে বিহারের নির্বাচনে।
কী কী বিষয়ে আন্দোলন সংগঠিত করা সম্ভব, তা নিয়ে দীর্ঘ তালিকা দেওয়া যায়। বিভিন্ন সময়ে যে বামেরা বলে এসেছে রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতা দিতে হবে, সেই বামেরা যদি তাঁদের কেরালার কমরেডদের মতো, জিএসটির বিরুদ্ধে আরও সুর চড়াতেন, তাহলে কি আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতেন না তাঁরা? এই মুহূর্তে দাঁড়িয়েও তাদের হাতে কিন্তু অনেক বিষয় আছে। ২০১৮ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালত আধারের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার পরে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় বলেছিলেন, যে কোনও নাগরিক যেন তাঁদের কোনও ব্যক্তিগত ফোনে বা ব্যাঙ্কে আধার সংযোগ না করেন। অথচ, সেই তিনিই আজ যখন ডিজিটাল রেশন কার্ডের সঙ্গে আধার এবং মোবাইল সংযোগের নির্দেশাবলি জারি করেন, তখন কি এই বিষয়ে মানুষকে সচেতন করার কাজটা বাম কর্মী সমর্থকদের ছিল না? কেন তারা এটা করে উঠতে পারলেন না? আসলে ৩৪ বছরের শাসন এবং তার পরবর্তীতে কোন বিষয় নিয়ে পড়াশুনা বা ‘স্টাডি ক্লাস’ চালানো উচিত সেটা কি তাঁদের মনে আছে? শুধু পুঁজিবাদ বললে মানুষ এমনিতেই বোঝে না, আজকের সময়ে নজরদারি রাষ্ট্র বা সারভেইলেন্স ক্যাপিটালিসমকেও যে সহজ করে মানুষের কাছে পৌঁছতে হয়, তাই তাঁরা ভুলে গেছেন। উল্টে ফেসবুকের মতো সামাজিক মাধ্যমে প্রভাব বিস্তারে প্রাধান্য দেন এবং সেই নজরদারির আওতাধীন হবার চেষ্টা করতে থাকেন প্রতিনিয়ত। আধার এবং রেশন সংযুক্তির ফলে প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খণ্ডেই অন্তত ৫০-এর বেশী মানুষ মারা গেছেন, সন্তোষী নামে একটি ১১ বছরের মেয়ে, ‘ভাত ভাত’ করতে করতে মারা যায়, তার পরেও যদি এই রাজ্যে এই একই প্রক্রিয়া চালু হয়, তখন এই নিয়ে আন্দোলন করার বা কথা বলার অধিকার কার থাকে? কেন আধারের বা নির্বাচনী বন্ডের বিরোধিতা করতে হবে, কেন লকডাউনেও সরকার কোনও মানুষকে সহায়তা করেনি, এই সমস্ত বিষয়গুলো নিয়ে কি এ রাজ্যের বামপন্থীরা সোচ্চার হতে পারত না? শ্রম আইন, বা কৃষি বিলের আরও জোরালো প্রতিবাদ কি তারা করতে পারত না? ঋণমুক্তি নিয়ে কি কেন্দ্রের বিরুদ্ধে কোনও লড়াই গড়ে তোলা যেত না ? কেন্দ্রের তদন্তকারী সংস্থা যখন মুর্শিদাবাদ থেকে ৬ জন মুসলমান যুবককে সন্ত্রাসবাদী সন্দেহে ধরে নিয়ে গেল, তখন তো বামেরা কোনও প্রতিবাদ করল না, উল্টে কেন্দ্রের সুরে সুর মেলাল। তাহলে কি তারাও বিশ্বাস করে, মুসলমান মানেই সন্ত্রাসবাদী? নাকি বিজেপি যে প্রচার করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুসলমানদের তোষণ করেন, সেটা তারা বিশ্বাস করে?
আসলে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে থাকতে ক্ষমতার একটা অভ্যেস তৈরি হয়, যেই অভ্যেসের ফলে কেন্দ্র বিরোধী বনধ বা ধর্মঘট ডাকলেও সরকারী বদান্যতায় ধর্মঘট পালন করাটাও অভ্যেসের পর্যায়ে চলে যায়। কিন্তু তাঁরা যদি বিস্মৃত হন, যে ক্ষমতা চলে গেলেও, তাঁদের হাতে শ্রমিক সংগঠন আছে, ছাত্র আছে, মহিলারা আছেন, লকডাউনে কাজ হারানো হাজার হাজার শ্রমিক আছেন, সর্বোপরি তাঁদের হাতে লাল পতাকা আছে, যা দিয়েই অনেক লড়াই লড়া সম্ভব, তাহলেই মুশকিল। যা দিয়েই কেন্দ্র-রাজ্যের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠা যায়। কিন্তু সেটুকু ভাবার আত্মবিশ্বাস কি আর তাদের অবশিষ্ট আছে?