পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

বিভেদের বিষে জর্জরিত দেশ

  • 27 May, 2019
  • 0 Comment(s)
  • 2075 view(s)
  • লিখেছেন : অমিত দাশগুপ্ত
নির্বাচনের ফলাফল জানিয়ে দিল দৈনন্দিন জীবনের সমস্যার থেকে, কর্মসংস্থান, দারিদ্র, স্বাস্থ্য, কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম, মজুরি বা অসাম্যের থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নিজের দেশের সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে রূপান্তর করা। কেন? জানিয়েছেন অমিত দাসগুপ্ত।

বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দীর্ঘতম নির্বাচন শেষ হল। ২০১৪ সালে ৯ দফায় নির্বাচন হযেছিল, চলেছিল ৭ এপ্রিল থেকে ১২ মে পর্যন্ত, ফল বেরিয়েছিল ১৬ মে। এবারের লোকসভা নির্বাচনের দফা কম, ৭ দফা, কিন্তু সময়কাল ৩ দিন বেশী। রেকর্ড সংখ্যক নির্বাচক, নির্বাচন কাল সংবলিত নির্বাচনটির ফলাফলেও রেকর্ড হয়েছে। চৌকিদার নরেন্দ্র মোদি নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্টতা নিয়ে পরপর দুবার ভারতীয সংসদে নির্বাচিত হলেন যা ৫ দশক পরে ঘটল। এই ফলে নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ বিষ্মিত কি না বলতে পারব না কিন্তু সমস্ত সিরিয়াস রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাই হতভম্ব হয়েছেন। গত ৫ বছরে দরিদ্রদের জন্য কিছু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত সুবিধে প্রদান ছাড়া ভারত নামক দেশটির জন্য জাতীয গনতান্ত্রিক মোর্চা (এনডিএ) সরকার ইতিবাচক কিছুই করে নি যার দ্বারা এই ফলকে ন্যায্যতা প্রদান করা যায়। পরন্তু, গত ৫ দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ বেকারীর হার, একটি অনাবশ্যক এবং অসংগঠিত ও নিম্নআয়ের ক্ষেত্রের জীবিকা অর্জনকারীদের জীবনকে দু:সহ করে তোলা নোট বাতিল, কৃষকদের অপরিসীম অবহেলা, সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয শ্রেণীর নাগরিকে রূপান্তর, ক্রমাগত রাষ্ট্রাযত্ব ক্ষেত্রের সংকোচন, ঋনখেলাপি ধনীদের বিদেশ গমন, সরকারি প্রতিষ্ঠান সমূহের ধ্বংস, নারীদের উপরে অত্যাচার, উচ্চ বর্ণ কর্তৃক দলিতদের দমন পীড়ণ এরকম অগণিত খারাপ কাজ করার পরেও ভারতীয নির্বাচকেরা কেন মোদি সরকারকে এরকম অভূতপূর্ব নির্বাচনী সাফল্য প্রদান করল তা চর্চার বিষয হয়ে থাকবে বহু কাল।

আগেই বলেছি, মোদি সরকারের আমলে দরিদ্রদের জন্য কিছু সুবিধে প্রদান করা হয়েছে। বিনা ব্যযে গ্যাস সংযোগ, বিনা আমানতে ব্যাঙক এ্যাকাউন্ট, ফসল বীমা, স্বাস্থ্য বীমা ও নির্বাচনের অব্যবহিত আগে নিম্ন আয়ের কৃষকদের খাতায় মাসে ৫০০ টাকা করে প্রদান সেই সব সুবিধে যা নিযে হইচই যত হয়েছে তত কাজ হয় নি বলেই বিভিন্ন রিপোর্টে জানা গেছে।

তাহলে এই নির্বাচনী সাফল্য এল কোথা থেকে? গ্রাম গঞ্জের মানুষ এনডিএকে ভোট দিল কেন? বহু বিশ্লেষন হবে, কাটা ছেড়া হবে, কিন্তু একটি বিষয় সকলেই মোটামুটি মেনে নেবেন যে, মোদি-শাহ এর প্রচার নৈপুণ্যকে সমস্ত বিরোধীরা কোনভাবেই টেক্কা দিতে সক্ষম হয় নি। সাধারণভাবে বলতে গেলে প্রভূত অর্থ, পেশী শক্তি, একপেশে কর্পোরেট প্রচার মাধ্যমের আনুকূল্য, সমস্ত প্রতিষ্ঠান সমূহ এমনকি নির্বাচন কমিশনের পৃষ্ঠপোষকতা বিজেপি নেতৃত্বকে সহায়তা করেছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ধারাবাহিক মিথ্যে প্রচার, যাকে হোযাটসএ্যাপ ফেসবুকের মধ্য দিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৈছে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই প্রচারের মধ্যে কী এমন ছিল যা সমস্ত বাস্তব অনুভূতিকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল? প্রধানত, দুটি বিশেষ দিক ছিল, একে অপরের পরিপূরক। মুসলমানদের সম্পর্কে অপরিসীম ঘৃণা ও বিদ্বেষকে প্রচার ও সেই বিদ্বেষের উপর ভর করে পাকিস্তানকে আক্রমণ ও পর্যুদস্ত করার স্বপ্ন ফেরি করা।

এটি অনস্বীকার্য যে, যে কোন রাষ্ট্রনেতার কাজ স্বপ্ন দেখানো, এক উজ্বল সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের স্বপ্ন, এমন এক দেশের কথা অধিবাসীদের মগজে ঢোকানো যেখানে গরিবী, বেকারি, অস্বাস্থ্য, অনাহার, অসাম্য থাকবে না, থাকবে না ঘৃণা, দ্বেষ, হিংসা। কিন্তু এমন এক রাষ্ট্রনায়কের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করছি আমরা যিনি দারিদ্র, কর্মহীনতা, ক্ষুধা, বৈষম্যকে নিকেশ করার স্বপ্ন দেখানোর বদলে প্রতিবেশী দেশকে ধ্বংস করার নেশায় নাগরিকদের বুঁদ করে তুলে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওযাকেই শ্রেয় বলে মনে করেন। অন্যের ঘরে ঢুকে মেরে আসার মস্তানিকেই যিনি গর্বের কাজ বলে মনে করেন। এমনই এক শাসকের উত্থান ঘটেছে এই দেশে যার হাতের দাঙ্গার রক্ত আজীবন শুকোবে না। যিনি নিজেকে গর্বিত হিন্দু বলেন কিন্তু যার আচরণ নাদির শহের মত বীভৎস, যিনি নিজের দেশের অধিবাসীদের মধ্যে বিভেদের বিষ ছড়িয়ে ১৪-১৫% নাগরিকদের প্রতি ৭৯% সংখ্যাগুরুর ঘৃণা উদ্রেক করাতে সচেষ্ট হন। তেমনই এক রাষ্ট্রনেতা বিপুল সংখ্যাগরিষ্টতা নিযে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসীন হলেন।

সংখ্যাগুরুর মধ্যে অদ্ভুত উপায়ে এক ভীতিকে ছড়িয়ে দেওয়া গিয়েছে। ৭৯% সংখ্যাগুরুকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে বিজেপি-আরএসএস। আশঙ্কা তৈরী করেছে যে, ১৪-১৫% সংখ্যালঘু মুসলমান হিন্দুদের বিপদে ফেলছে, প্রচার করা হয়েছে, হিন্দু খতরে মে হায়। বিভিন্ন নকল ভিডিও, ছবি, খবর প্রভৃতি হোযাটসএ্যাপ, ফেসবুকের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যেখানে মুসলমানদের দাঙ্গাবাজ, হিন্দু বিদ্বেষী বলে দেখানো হয়েছে। একইভাবে সরকারি জনগণনার তথ্যকে বিকৃত করে বা তাকে পাত্তা না দিয়ে অচিরেই মুসলমান জনসংখ্যা হিন্দু জনসংখ্যাকে ছাপিয়ে যাবে বলে দেখানো হয়েছে। এভাবেই বিদ্বেষকে সচেতনভাবে রোপণ করা হয়েছে বিশাল সংখ্যক জনগণের অন্তরে। বিভাজিত করা হয়েছে দেশটাকে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িযে।

জানি না কী ভয়ঙ্কর পরিস্তিতির মুখোমুখি হতে চলেছে আমাদের দেশ, কী ভাবে বিভেদের এই যাতাকল থেকে বেরোব আমরা, আদৌ কি সম্ভব এই ভয়ঙ্কর মিথ্যে প্রচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িযে সত্যটাকে সকলের কাছে নিয়ে যাওয়া?

0 Comments

Post Comment