আজ সকলেই জানি যে, বিশ্বজুড়ে কোভিড আমাদের বিভিন্নভাবে ক্ষতি করে গিয়েছে। মৃত্যুকে দিনের পর দিন খুব কাছ থেকে দেখেছি আমরা। দৈনন্দিন দেখেছি জীবাণুর সঙ্গে মানুষের অসহায় লড়াই। দেখেছি কীভাবে বর্তমান পরিস্থিতি মানুষের কর্ম জীবনের অনিশ্চয়তা তৈরি করে দিয়ে গেল এক ধাক্কায়। নানারকম ক্ষতির মাঝে কোভিড আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়ে গেছে স্কুল পড়ুয়া ও কলেজের ছাত্রছাত্রীদের জীবনযাপনে।
ক্যাম্পাস-লাইফ হোক অথবা বন্ধুর সঙ্গে ক্লাসের ফাঁকে আড্ডা,মাঠে খেলাধুলো--- সব যেন কেমন থমকে গিয়েছিল এদের জীবনে। রিমোট লার্নিং অর্থাৎ বাড়িতে বসে ল্যাপটপে পড়াশুনো করার মাধ্যমে শিক্ষালাভ কিছুটা হলেও,তাদের মনের কতটা বিকাশ ঘটছে অথবা মানসিক উত্তরণ ঘটছে সে-বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
চলতি বছরের প্রথম দিকে আমেরিকায় টিকাকরণ শুরু হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে শিক্ষকদের টিকাকরণ শুরু হয়ে যায়। তখন থেকেই তাঁরা ২০২১-২০২২ অ্যাকাডেমিক সেশানের জন্য প্রস্তুতি শুরু করেন। এরপর দ্বিতীয় ধাপে প্রস্তুতি শুরু হয়। এই বছরের মে মাস থেকে শুরু হয় ১২-১৭ বছরের কিশোর কিশোরীদের জন্য Pfizer-BioNTech Covid-19 এর টিকাকরণ।
সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে নানাধরণের বাধাবিপত্তি পেরিয়ে,অবশেষে আমেরিকার সমস্ত স্কুল এবং কলেজ শুরু হয়। সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোলের নিয়ম অনুসারে স্কুল এবং কলেজ চলাকালীন সব ছাত্রছাত্রীকে ক্লাসের মধ্যে মুখোশ পরে থাকতে হবে। শুধু বাইরে মাঠে খেলাধুলোর সময় মুখোশ খোলা যাবে। লাঞ্চের সময় ছাত্রছাত্রীদের কিছুটা দূরত্বে বসানো হচ্ছে এবং প্রত্যেকটি স্টুডেন্টের মাঝে পারটিশান দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক ক্লাসে প্রবেশ করার মুখে দেওয়ালে স্যানিটাইজার বসানো হয়েছে। ক্লাসরুমের জানলা অধিকাংশ সময় খুলে রাখা হয়। ছাত্রছাত্রীদের মাঝেমধ্যে উন্মুক্ত আকাশের নীচে 'মাস্ক-ব্রেক' দেওয়া হচ্ছে।খুব ছোট বাচ্চাদের যাতে টানা মুখোশে মুখ ঢেকে থাকতে না-হয় সেই জন্য তাদের একাধিক ক্লাস আউটডোরে করার ব্যবস্থা করেছেন শিক্ষকরা।
স্কুল কিংবা কলেজ অথবা বিশ্ববিদ্যালয় চলাকালীন যদি কোনও স্টুডেন্ট এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্য বা অন্য দেশে ট্র্যাভেল করে তাহলে ফেরার পর তাকে এক থেকে দু'সপ্তাহ কোয়ারেনটিন থাকতে হবে। স্কুলে ফেরার আগে কোভিড টেস্ট নেগেটিভ হলে তবেই সে স্কুল বা কলেজে ফিরতে পারবে। এই কোয়ারেনটিনের সময় ছাত্রছাত্রীরা জুমে রিমোট ক্লাস করতে পারবে। এছাড়া দৈনন্দিন স্কুল কলেজের আগে পরে চলছে ক্লিনিং ও স্যানিটাইজেশনের ব্যবস্থা।
বিগত দেড় বছর ধরে কোভিড-পরিস্থিতির কঠিন সময় অতিক্রম করেছে ছোটরা। ছাত্রছাত্রীদের চ্যালেঞ্জগুলো এক ধরনের নয়।একদিকে অনেকের বাড়িতে সবসময় ক্লাস করার মতো পরিস্থিতি পাচ্ছে না বাড়িতে। কিছু স্টুডেন্টের বাড়িতে পড়াশুনো করার সঠিক ডিভাইস নেই। অন্যদিকে রিমোট লার্নিং এর সময় টানা স্ক্রিনের দিকে মনঃসংযোগ ধরে রাখতে পারেনি ছোটরা। অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে কেউ ভুলে যেত, কেউ জমা দেওয়ার তাগিদ খুঁজে পায়নি। দিনের পর দিন এভাবে বাড়িতে বসে ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষকের,বন্ধুবান্ধবের সংস্পর্শ না-পেয়ে অনেক বেশি অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছিল।
এখন নতুন স্কুল খোলার আনন্দ চোখেমুখে ফুটে উঠছে ছোটদের। একটি শান্ত,নির্জন ঘরের মধ্যে একলা বসে পড়াশুনো করা যে সম্ভব নয়, তা অতিমারি আমাদের সকলকে প্রবলভাবে ধাক্কা দিয়ে বুঝিয়ে গেছে। বহুধরনের কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার ক্ষমতা তৈরি হয়েছে ছোট্ট মনের গভীরে।কিন্তু তাদের স্বাভাবিক মানসিক গঠন প্রচণ্ড নাড়া খেয়ে গেছে। বন্ধুরা নেই… তাই বাচ্চারা আশ্রয় খুঁজেছে গ্যাজেটে! অতিরিক্ত গ্যাজেট ব্যবহার করতে-করতে গ্যাজেটের কম্যান্ড অনুসরণ করার প্রবণতা তৈরি হয়ে উঠেছিল তাদের মনে।
কিন্তু স্কুল কলেজ শুরু হওয়ার পর তারা তাদের নির্দিষ্ট কো-কারিকিউলার অ্যাক্টিভিটিগুলোও সুন্দরভাবে চালিয়ে যাচ্ছে পাশাপাশি ডিবেট, বুক ক্লাব, জার্নাল, স্কুল ড্রামা-- সবকিছু স্টুডেন্টরা নতুন উদ্যমে শুরু করেছে আবার। যা সত্যিই চমক দেবার মতো।
আমেরিকায় প্রতি বছর স্কুল শুরু হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে স্কুলে আয়োজন করা হয় ব্যাক-টু-স্কুল নাইট।এই দিন স্কুলের নির্দিষ্ট সময়ের পর শিক্ষকরা অভিবাবকদের স্কুলে আমন্ত্রণ করেন। স্কুলের বিভিন্ন চত্বর ঘুরিয়ে বাবা-মায়েদের দেখানো হয় তাঁদের সন্তান দৈনন্দিন কোথায় কোথায় কি কি ক্লাস করছে।সারা বছরের সিলেবাস, ক্যারিকিউলাম একটি স্মার্ট বোর্ডে প্রেজেনটেশন করে দেখানো হয়।এবছর অবশ্য খুব কম সময় পরিধির মধ্যে মুখোশ পরে একটিমাত্র রুমের ভেতর অভিবাবকদের বসিয়ে শিক্ষকরা এই প্রেজেনটেশন দিয়েছেন।
এখন ছোটদের পাশাপাশি শিক্ষকদের মুখেও হাসি ফুটেছে। ভয়,অনিশ্চয়তা তো রয়েছেই। কারণ এখনও বিপুল পরিমাণ শিশুদের টিকাকরণ হয়নি।আপাতত স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা বিধি মেনে দৈহিক দূরত্ব এবং মুখোশ-ই ভরসা। হয়তো জীবনের বহু প্রতিকূলতার মুখোমুখি হওয়ার হাতেকলমে শিক্ষা এখন থেকে হয়ে গেল ছোটদের।হঠাৎ করে দৈনন্দিন সকালে রিমোট লার্নিং এর জন্য নিজেকে মানসিকভাবে তৈরি করতে-করতে এদের জীবনে এসেছে নানারকম চ্যালেঞ্জ!যা সহজে কেউ ভুলবে না। স্কুল এবং কলেজের লেখাপড়া অত্যন্ত প্রয়োজন। স্কুল কলেজের অনুশাসন প্রয়োজন। কিন্তু সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সমবয়েসী বন্ধুর সঙ্গে মন খুলে খেলাধুলো করা,ও মেলামেশা করা। মোবাইল বা আইপ্যাড ছোট বাচ্চাদের মনের সঙ্গী কখনওই হয়ে উঠতে পারে না। তাই বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হতে না-পারা, ছোট-ছোট বাচ্চারা কখনও মানিয়ে নিতে পারে না। অতিমারির এই কঠিন সময় আমাদের, বিশেষত অভিবাবক, শিক্ষক, শিক্ষিকাদের বুঝিয়ে দিয়েছে যে, মানুষের মানুষকে প্রয়োজন কতখানি!
নিউ নর্মাল কনসার্ন থাকবে।বিভিন্ন পদক্ষেপে এই দেশের বাচ্চারা বয়েসভেদে অবশেষে স্কুল কলেজ শুরু করেছে।জীবাণুর আতঙ্ক পেরিয়ে এই পদক্ষেপগুলো শুনতে যতটা সহজ,করতে হয়তো ঠিক ততটা নয় সবসময়।স্কুল কিংবা কলেজ চত্বরে তাদের নানা ধরণের সাধারণ ম্যানারস বা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হচ্ছে।
রিমোট লার্নিং এই বয়েসে ভয়ঙ্কর মানসিক চাপ সৃষ্টি করেছিল তাদের মনে।ভাললাগার জিনিসগুলো যেন ক্রমশ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।পড়াশুনো,খেলাধুলো-- সবকিছুতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছিল তারা।নতুন বছর,নতুন স্কুল,নতুন নিয়ম এবং জীবনের অনেক ছোট-বড় নানা বিষয়ে আনন্দ খোঁজার গুরুত্ব বুঝেছে তারা। এখন পাড়ায় বা স্কুলের মাঠের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালে বোঝা যায় জীবন দৈনন্দিনের আনন্দে কত সুন্দর,কত বাঞ্ছনীয়!