পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

বিজেপি বনাম আরএসএসঃ রাগ-অভিমান না নাটক

  • 08 July, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 813 view(s)
  • লিখেছেন : সোমনাথ গুহ
বাজারে জোর খবর বিজেপির নির্বাচনী রথ ২৪০ আসনে আটকে যাওয়ায় আরএসএস বেজায় ক্ষুব্ধ। অনেকে বলছেন দল যদি ৩০০ আসন পেত তাহলে নাগপুরের গুরুরা বিশ্বগুরুর একাধিপত্য মাথা পেতে মেনে নিতেন। অনেকে বলছেন বিজেপি বিপাকে পড়লে সংঘ খুশিই হয় কারণ তখন তাঁদের গুরুত্বটা প্রতীয়মান হয়ে ওঠে। কিন্তু সত্যিটা কী? বিজেপি এবং আরএসএসের মধ্যে কি দূরত্ব বাড়ছে?

      

বাজারে জোর খবর বিজেপির নির্বাচনী রথ ২৪০ আসনে আটকে যাওয়ায় আরএসএস বেজায় ক্ষুব্ধ। অনেকে বলছেন দল যদি ৩০০ আসন পেত তাহলে নাগপুরের গুরুরা বিশ্বগুরুর একাধিপত্য মাথা পেতে মেনে নিতেন। অনেকে বলছেন বিজেপি বিপাকে পড়লে সংঘ খুশিই হয় কারণ তখন তাঁদের গুরুত্বটা প্রতীয়মান হয়ে ওঠে। আবার অনেকে বলছেন এটা পুরো নাটক, সেম-সাইড খেলা! দল ও সংঘের মধ্যে তথাকথিত এই সংঘর্ষের মূলে রয়েছে প্রধানত দুজনের বক্তব্য ও ‘অর্গানাইজার’ পত্রিকায় একটি লেখা ---- নাগপুরে সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগওয়াতের একটি ‘প্রবচন’, আরএসএস নেতা ইন্দ্রেশ কুমারের মন্তব্য এবং অর্গানাইজার পত্রিকার ১০ই জুন সংখ্যায় রতন শারদার একটি লেখা। এঁরা কী বলেছেন সেটা দেখে নেওয়া যেতে পারে।

ভাগওয়াত সংঘের মূল চালিকা শক্তি ‘সেবক’ এর আচরণ, তাঁর ভাবমূর্তির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন, দল এবং সমাজ পরিচালনায় তাঁদের ভূমিকা স্মরণ করিয়েছেন। তিনি বলছেন সেবকের কোন অহঙ্কার থাকতে পারে না, এমনকি বলছেন তিনি কারো ক্ষতি করেন না। বাস্তব চিত্রটা কি? গত দশ বছরে সেবকদের সেবার পরিণাম তো দেশ দেখেছে, গোরক্ষার নামে কত মুসলিম নিধন হয়েছেন, কত মানুষের ঘরবাড়ি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ধর্ষকদের কীভাবে মালা পরিয়ে বরণ করা হয়েছে, বরেণ্য মহিলা কুস্তিগিরদের কী ভাবে হেনস্থা করা হয়েছে। একটু অতীতে যদি যাওয়া যায়, লালকৃষ্ণ আদবানীর রথ কীভাবে দেশজুড়ে দাঙ্গা ছড়িয়েছে, ২০০২ সালে গুজরাটে গণহত্যার সময় কীভাবে বিজেপি সরকার নিষ্ক্রিয় থেকেছে, অনেকের মতে সেই হত্যাযজ্ঞে ইন্ধন পর্যন্ত যুগিয়েছে। সরসঙ্ঘচালক কিন্তু তখন একটিও কথা বলেননি। মূলত তাঁরই সুপারিশে, তাঁরই আশীর্বাদে  ২০১৪ সালে বিজেপি নির্বাচনে জেতার পর নরেন্দ্র মোদী সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হয়েছেন।

তিনি অহঙ্কার, ঔদ্ধত্য, আমিত্ব বর্জন করার কথা বলেছেন। বলছেন সংঘের আদর্শ অনুযায়ী না কি প্রথমে দেশ, দ্বিতীয় সংঘ, সবশেষে ব্যক্তি। কিন্তু বিজেপি তো ব্যক্তি সর্বস্ব হয়ে গেছে, মোদী কি গ্যারান্টি চলছে, মোদীর পার্টি হয়ে গেছে, হিন্দুত্বর পরিবর্তে মোদীত্ব হয়ে গেছে। এতে স্পষ্টতই আরএসএসের খুব গাত্রদাহ হচ্ছে, যাবতীয় কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রী পাচ্ছেন, পুরো আরএসএস দুর্গাপুজোর সাইড পুতুল, কার্তিক, গণেশের মতো হয়ে গেছে, কারো চোখেই পড়ে না; এতোটাই যে জে পি নাড্ডা বলছেন প্রথম দিকে বিজেপির আরএসএসকে প্রয়োজন হলেও এখন আর তাঁরা সংঘের ওপর নির্ভরশীল নন, নিজেদের কাজকর্ম তাঁরা নিজেরাই সামলাতে পারবেন! এই মন্তব্য আরএসএস কে ক্ষুব্ধ করেছে। রতন শারদা নিরুপায় হয়ে একটা নৈতিক অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করেছেন, বলেছেন আরএসএস কোনদিনও বিজেপির পদাতিক বাহিনী ছিল না। তাঁরা নাকি শুধুই সমাজ সচেতনার কাজ করেন, যেমন গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে তাঁরা ২০১৪ সালে ১০০% ভোট প্রদানের ডাক দিয়েছিলেন। শারদা আরও বলেন আরএসএস নাকি ১৯৭৩-৭৭ সময়টা ছাড়া আর কখনই সরাসরি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেনি। অর্থাৎ জরুরি অবস্থার সময় ছাড়া আরএসএস শুধু সমাজকে তথাকথিত সচেতন করেছে, রাজনীতি সম্পর্কে নিস্পৃহ থেকেছে! জরুরি অবস্থার সময় তাঁদের রাজনীতির আসল রূপ কী ছিল? সম্প্রতি ওই ঘটনার পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে তাঁরা নিজেদের ভুমিকাকে গৌরবান্বিত করার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। তাঁদের ভূমিকা বাস্তবে কী ছিল সেটার ওপর আলোকপাত করা দরকার।

এটা ঘটনা জরুরি অবস্থা ঘোষণার আগে আরএসএস তানাশাহির বিরুদ্ধে গণআন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার পর তাঁরা গোপনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সমঝোতা করার চেষ্টা করেছেন,  এমনকি তাঁকে নানা ভাবে সমর্থন করেছেন। সুব্রামনিয়াম স্বামীর একটি প্রবন্ধ ‘দ্য আনলার্ন্ট লেসনস অফ এমার্জেন্সি’ (১৩ জুন, ২০০০) থেকে জানা যায় কয়েক দিন হাজতবাস করার পর অটল বিহারি বাজপেয়ি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে একটা বোঝাপড়া করেন। উনি আশ্বাস দেন যে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হলে তিনি সরকার বিরোধী কোন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করবেন না। ওই একই প্রবন্ধে স্বামী লিখছেন ডিসেম্বর, ১৯৭৬ আরএসএস নেতারা একটি ডকুমেন্ট সই করেন যাতে তাঁরা জরুরি অবস্থাকে সম্পূর্ণ সমর্থনের সিদ্ধান্ত নেন। এছাড়া সেই সময়ের সরসঙ্ঘচালক বালাসাহেব দেওরস ইন্দিরা গান্ধীকে তিনটি চিঠিতে (২২ অগস্ট, ১০ নভেম্বর, ১৯৭৫, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৬) জরুরি অবস্থার প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন এবং আশ্বাস দেন যে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আরএসএস ভলেন্টিয়াররা দেশের প্রগতির জন্য কাজ করবেন।

বর্তমান সরসঙ্ঘচালকের বক্তব্যে ফিরে আসা যাক। উনি বলছেন নির্বাচনী প্রচার সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করেছে। কাকে উদ্দেশ্য করে বলছেন তিনি? প্রধানমন্ত্রীর বিখ্যাত ‘মঙ্গলসূত্র’ বক্তব্য, বিরোধীদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের সম্পত্তি, নিম্নবর্ণের জন্য নির্ধারিত সংরক্ষণ ‘যারা বেশি সন্তান জন্ম দেয়’ তাদের বন্টন করার অভিযোগ এনেছিলেন তখন তিনি কোথায় ছিলেন, তখন তিনি এর প্রতিবাদ করেননি কেন? তিনি উপদেশ দিচ্ছেন বিরোধী পক্ষ, শত্রু নয়, ‘অপোজিশন’ ‘অপোনেন্ট’ নয়, তাঁরা প্রতিপক্ষ, নির্বাচন একটা প্রতিযোগিতা, যুদ্ধ নয়। আহা রে! কত বড় বড় কথা! দু দুজন মুখ্যমন্ত্রীকে বিনা কারণে জেলে পাঠালেন, কংগ্রেসের ব্যাঙ্ক একাউন্ট বন্ধ করে দিলেন, নির্বাচন কমিশন সহ সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠান  কুক্ষিগত করলেন, আর এখন বলছেন নির্বাচন যুদ্ধ নয়! তিনি বলছেন এই যুদ্ধে নাকি সঙ্ঘকেও জড়ানো হয়েছে, ফেক নিউজ ছড়ান হয়েছে। এই ভুয়ো খবর ছড়ানতে তো সংঘিরা ওস্তাদ। মিথ্যা, ভুয়ো খবর ছড়ানতে তাঁদের আইটি সেল যে কুখ্যাতি অর্জন করেছে তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। অন্য দেশের ঝামেলার দৃশ্য ছড়িয়ে বিভিন্ন রাজ্যে দাঙ্গা করা হয়েছে, বিরোধী নেতা নেত্রীদের বিরুদ্ধে অকাতরে কুৎসা রটানো হয়েছে, অহরহ মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ ছড়ান হয়েছে। মণিপুর নিয়ে তিনি কুম্ভীরাশ্রু ফেলেছেন, বলেছেন ওখানে ‘গান কালচার’ চলছে। এই বন্দুক রাজের হোতা তো ‘আরাম্বাই টেঙ্গল’, যাদের পিছনে রাজ্যের বিজেপি সরকারের সম্পূর্ণ মদত আছে। সত্যিই যদি গান কালচার বন্ধ করতে হয় তাহলে এই সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করুক।

অবশেষে সরসঙ্ঘচালক ‘কনসেন্সাস’, সম্মতির ভিত্তিতে সরকার পরিচালনা করার বাণী দিয়েছেন। যে কোন ঘটনার দুটি দিক আছে, উভয়ের মধ্যে সম্মতির মধ্যে দিয়েই কোন সিদ্ধান্তে আসা উচিত, তাঁর উপদেশ। প্রায় এক মাস হল নতুন সরকার এসেছে, সম্মতির ভিত্তিতে সরকার চালানর বিন্দু মাত্র ইঙ্গিত এখন অবধি পাওয়া যায়নি। নিট-নেট কেলেঙ্কারি এবং রেল দুর্ঘটনার কারণে বিরোধীরা ওই দপ্তরগুলির মন্ত্রীদের পদত্যাগ দাবী করেছে, সরকার কোন গুরুত্বই দেয়নি। বিরোধী দলের থেকে ডেপুটি স্পিকার নিয়োগ হবে, এরকম কোন ইঙ্গিতও এখন অবধি পাওয়া যায়নি। বরঞ্চ এই সরকার প্রতিহিংসামূলক। পুরানো ঘটনা খুঁচিয়ে তুলে বরেণ্য লেখিকা এবং সমাজসেবী অরুন্ধতী রায় এবং মেধা পাটকারকে হেনস্থা করার চেষ্টা করছে। আসলে মোদীর দাপটে আরএসএস প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। দেশে-বিদেশে প্রচারের সমস্ত আলো, রাজনীতি থেকে ধর্ম সমস্ত ক্ষেত্রে ওই একটি ব্যক্তির ওপরে। আবার একই সাথে আরএসএস জানে শুধুমাত্র মোদীর কারণেই আজ তাঁরা সাফল্যের শিখরে পৌঁছিয়েছে। তাই তাঁকে তাঁরা না পারছে গিলতে, না পারছে ফেলতে। নির্বাচনে আশাপ্রদ ফল না হওয়ায় সংঘীরা নিজেদের পুঞ্জিভুত রাগ প্রকাশের একটা সুযোগ পেয়ে গেল। ব্যস এটুকুই মাত্র……..

যেটা আসল ক্ষোভ সেটা রতন শারদার লেখায় প্রকাশিত। তিনি লিখছেন এবারের নির্বাচনে বিজেপির প্রার্থীদের মধ্যে ২৫% ছিল ‘সিজন্যাল মাইগ্র্যান্টস’। এদের মধ্যে অনেকে এক সময় ‘স্যাফ্রন টেরর’-এর কথা বলেছে, ২৬/১১র ঘটনাকে ‘আরএসএস কি সাজিশ’ বলেছে। এরা এখন ঘরের লোক হয়ে গেছে এটা সংঘীরা মানতে পারছে না। শারদার অভিযোগ আরও গুরুতর। তিনি বলছেন গরুচোরদের চেয়ে গোরক্ষক নাকি বেশি মারা গেছে, তাদের বেশি হেনস্থা করা হচ্ছে। যারা রাম’কে অপমান করছে তাদের জন্য লাল কার্পেট বিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে, অথচ নুপুর শর্মা (যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ যে তিনি হজরত মহম্মদ সম্পর্কে কটু কথা বলেছিলেন) তাঁকে সর্বসমক্ষে তিরস্কার করা হচ্ছে। তাঁর বক্তব্য আগা খান ট্রাস্টের পয়সায় মুসলিম সৌধ রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে, অথচ হিন্দু সৌধ অবহেলা হচ্ছে। তিনি ওয়াকফ আইন বাতিলের দাবী তুলছেন কারণ সেটা মুসলিমরা অপব্যবহার করছেন। রামমন্দির উদ্বোধনের সময় আরএসএসের একটি চরমপন্থি অংশ খোদ প্রধানমন্ত্রী এবং মোহন ভাগবতকে নরম হিন্দুত্ব অনুশীলন করার জন্য অভিযুক্ত করেছিল। তারা ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস’ শ্লোগানে বিশ্বাস করে না, পস্মিন্দা মুসলমানদের কাছে টানার প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে না। তারা রামমন্দির গড়ে তোলার জন্য মুসলিমদের থেকে কোনও ধরণের সাহায্য নেওয়ারও চরম বিরোধী ছিল। অর্থাৎ বিজেপির ওপর আরএসএসের একটা প্রভাবশালী অংশের ক্ষোভের কারণ হচ্ছে তারা যথেষ্ট উগ্র নয়, যথেষ্ট মুসলিম বিরোধী নয়, যথেষ্ট হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান নয়, ‘খাঁটি’ হিন্দু নয়। নির্বাচন পরবর্তী যাবতীয় ক্ষোভের এটাই মূল নির্যাস।

0 Comments

Post Comment