পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

নট আউট : সিক্স

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 202 view(s)
  • লিখেছেন : মালবিকা মিত্র
বাংলায় বোকা গাধা বলতে গরু ছাগল বলা হয়। কিন্তু খুব বড় মাপের বোকা গাধা বোঝাতে গেলে রামছাগল, রামপাঁঠা, এগুলোই বলা হয়। আমরা তো গোবরকে মাটির উপর শক্ত প্রলেপ হিসেবে ব্যবহার করি। মাটির ক্ষয়কে কিছুটা রোধ করে, তাই গোবরের ব্যবহার মাটির বাড়িতে, উঠোনে, মাটির মেঝেতে দেখা যায়। কিন্তু গোবরে দেবত্ব আরোপ হয় না।

ছোটবেলায় দেখেছি পাড়ায় রাত্রিবেলা লন্ঠন ঝুলিয়ে রামযাত্রা পালা হত। প্রতিদিন একটি করে অংশ হত, আর তারপর রাম সীতা লক্ষণ হনুমান এইসব বিভিন্ন চরিত্রের গলার মালা বিক্রি করা হতো -- "কে আছো আজ মহাদানী দানের আসরে", এই বলে মালা নিলামে উঠতো। সেটাই হত তাদের উপার্জন। রামযাত্রা ছাড়াও হতো শিব পার্বতীর নৃত্য, মহাকালীর নৃত্য। দেখতাম অবাক হয়ে মা কালী যখন অসুর সংহারে প্রলয় নাচন নাচছেন, তখন দর্শকদের মধ্যে দাঁড়িয়ে শিব বিড়ি নিয়ে কানের কাছে একটু রগড়ে, দুবার ফুঁ দিয়ে, আগুন জ্বালছে। আবার সীতা হরণের পর রাম এবং লক্ষণ কুটিরে ফিরে এসেছেন ও দুশ্চিন্তা নিয়ে তারা হা হুতাশ করছেন। তখন সীতা তার পরচুল টা খুলে রেখে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ধূমপান করছে। এই সমগ্র দৃশ্যাবলী রামযাত্রা বা মহাকালির নৃত্য, শিবের নৃত্য এগুলোকে যত না দেবত্ব দিয়েছে, তার চেয়ে বেশি রঙ্গ রসিকতা দিয়েছে। এক কথায় নির্দোষ বিনোদন। সাধারণত শীতকালে এই সমস্ত পালাগুলি চলতো। পরদিন আমাদের মত ছোটরা টিন বাজিয়ে ঢাকের শব্দ করে, রাংতার মকুট পরে, পুনরাভিনয় করতাম। আর একটু বড় যারা চ্যাংড়া ফাজিল, তারা কিছু রঙ্গ তামাশা করত এইসব পালা গান নিয়ে। বিশেষ করে পুরুষদের মহিলা সাজা নিয়ে। লক্ষ্মণের অতিরিক্ত বৌদি প্রীতি নিয়ে। এই অন্ধ আনুগত্য নিয়ে একটা বাগধারা চালু আছে -- "ধরো লক্ষ্মণ"। লক্ষ্মণও ধরে আছে। কি ধরেছে, কেন ধরবে, কতক্ষণ ধরবে প্রশ্ন নেই। 

প্রসঙ্গত বলে রাখি এইসব রাম যাত্রা করতে আসা ছোট দলগুলো কয়েকদিন একই জায়গায় থেকে যেত। রান্নাবান্না করে খেতো, ঘুমতো। ওখানেই পুকুরে স্নান কার্য হতো, আর আদারে বাদাড়ে প্রাতঃকর্ম সম্পন্ন করতো। পাড়ার চ্যাংড়া ছোকরাদের কথিত ও বর্ণিত একটি পালার অংশের কথা বলি -- 
গৃহে প্রবেশ করে রামচন্দ্র ভাইয়ের জন্য উতলা হয়ে চিৎকার করে বলছেন : "লক্ষ্মণ, ও ভাই লক্ষ্মণ! কোথায় গেলি? লক্ষ্মণ মোর প্রাণাধিক প্রিয় ভাই লক্ষ্মণ?" এই সময় পশ্চাৎ চুলকাতে চুলকাতে, মানে খাউজাইতে   লক্ষণের প্রবেশ। 

-- ভাই লক্ষ্মণ কোথা ছিলি এতক্ষন? 
-- গিয়াছিলাম কচু বনে হাগিবার তরে। 
-- সেথা তো জল নাই। জল না পাইয়া কি করিলি বাছা? 
--  বনের কচু পাতায় মুছিয়া ছিলাম পাছা। লক্ষণ পাছা চুলকাতে চুলকাতে উত্তর দেয়। 

নর্তন কুর্দন হতো, পালা গান হতো। কিন্তু সেগুলো মানুষের কাছে বিনোদন ছিল এবং মানুষ সেই বিনোদনকে নিজেরা সাজিয়ে গুজিয়ে পরিমার্জন করে, আরো বেশি বিনোদনের ব্যবস্থা করতো। কোথাও আদিরস, কোথাও করুণ রস মিশে যেতো। প্রসঙ্গটা এই জন্য আসছে যে এখানে এই বাংলায় শিব, পার্বতী, মা কালী, রাম, সীতা, লক্ষন এরা কেউ কৈলাসের দেবত্ব নিয়ে আসেনি। গঙ্গা নদী যত বেশি ভাঁটির টানে ভাঁটির পাণে এগিয়ে চলেছে, তার দেবত্ব ততই কমতে থেকেছে। তাদের ওপর নরত্ব আরোপ হয়েছে। এখানে রাম যাত্রা দেখে বাঙালির দু চোখে অশ্রু ধারা নামে না। অথচ এই বাঙালি নিমাইয়ের নামে ও গানে, শচীমাতার করুন আবেগে, বিষ্ণুপ্রিয়ার বিরহে দু চোখে ঝরঝর ধারায় ভাসিয়ে দেয় অষ্টপ্রহর হরিনাম সংকীর্তন। এই বাংলায় শব যাত্রায় "রাম নাম সত্য হায়" বলা হয় না। হরিবোল ধ্বনি দেওয়া হয়। এখানে ভিক্ষুক ভিক্ষুনি বৈরাগীরা এসে "হরে কৃষ্ণ, জয় রাধে" বলে ভিক্ষা প্রার্থনা করে। বাংলার এই স্বাতন্ত্র্য গোবলয় হিন্দি বলায় বুঝতে পারে না, চিনতেও পারে না। বাংলার সুমিষ্ট মর্মস্পর্শী প্রভাতী সংগীতে কোথাও রাম থাকেন না, থাকে শচীমাতার আঙিনা। সেথায় গোরাচাঁদ দেয় হামাগুড়ি। 

মনে করে দেখুন কমেডিয়ান ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় তার কমেডিতে এক জায়গায় বলছেন, লক্ষ্মণ আবার বীর হইল নাকি? ও তো সারাক্ষণ বৌদির আঁচলের তলায় থাকে। একবারই মাত্র সফল হইছে, হেইডাও মাইয়া মানুষের লগে - সুর্পনখার সাথে। হনুমান যদি বিন্ধ্য পর্বত থিকা বিশল্যকরণী না আনতো, তাইলে তো ওইহানেই লক্ষ্মণের খেলা শ্যাষ। ওইডা আবার পুরুষ মানুষ নাকি? আবার সুকুমার রায় তার লক্ষণের শক্তিশেল কৌতুক নাটকে লিখছেন --
রাবণের সাথে যুদ্ধে লক্ষণ তো শেলাঘাতে মূর্চ্ছিত এবং কার্যত কোমাচ্ছন্ন। জাম্বুবান আয়ুর্বেদ বিধান দিয়েছে বিন্ধ্যর অরণ্য থেকে বিশল্যকরণী আনতে হবে। কে যাবে? ছাই ফেলতে ভাঙ্গা কূলো হনুমান যাবে। হনুমান চলে গেলে এদিকে দরবারের কাজ কে সামলাবে? সিদ্ধান্ত হলো, বিভীষণ সামলাবে। রাত্রি একটু বাড়তেই রামচন্দ্র সহ যে যার ঘুমোতে চলে গেল। এদিকে বিভীষণ একা কোমাচ্ছন্ন লক্ষণকে পাহারা দিয়ে বসে আছে। যমদূত এসে লক্ষণকে টেনে নিতে যায়, ওদিকে বিভীষণ লক্ষণকে ছাড়ে না। যাকে বলে যমে মানুষে টানাটানি। এমন অবস্থায় যম নিজেই এসে হাজির। আর ঠিক সেই সময় হনুমান বিশল্যকরণীর গাছ চিনতে না পেরে, গোটা বিন্ধ্য পর্বত তুলে নিয়ে চলে এসে প্রাসাদের সামনে নামায়। ফলে পাহাড়ের তলায় চাপা পড়ে যায় যম। অতঃপর বিশল্যকরণী সেবনে লক্ষণ যখন জ্ঞান ফিরে পায় তখন সকলের নজরে আসে, স্বয়ং যম পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ে আছে। 

যম। । আজ্ঞে চিত্রগুপ্ত ব্যাটা আমায় ভুল বুঝিয়েছিল। আমি এখনই গিয়ে ব্যাটার চাকরি খাচ্ছি। (যমের প্রস্থান) 
লক্ষণ।। (এতক্ষণে জ্ঞান ফিরে পেয়ে) হনুমান বেটা বুঝি ওকে চাপা দিয়েছিল? বেটার বুদ্ধি দেখো! 
হনুমান। । তা বুদ্ধি থাকুক আর না থাকুক, ওষুধ এনে বাহাদুরি টা তো আমিই নিয়েছি। 
বিভীষণ।। আমি পাহারা না দিলে ওষুধ কি হতো রে? ওষুধ আনতে আনতে লক্ষণ যমের বাড়ি পৌঁছে যেত। আমারই তো বাহাদুরি। 
সুগ্রীব।। অর্থাৎ কিনা আসল বাহাদুরি আমার। আমি বললুম, তবেই তো বিভীষণ পাহারা দিলো। আর বিভীষণ পাহারা দিল বলেই তো যমদূত গুলো আটকে পড়ল। 
জাম্বুরান।। আরে ব্যাটা ওষুধের ব্যবস্থা করল কে? তোদের বুদ্ধি সে সময় উড়ে গিয়েছিল কোথায়? 
রাম।। হ্যাঁ, এ তো ঠিক। কিন্তু আমি যুক্তির কথা না জিজ্ঞেস করলে, তুমি তো এখনো পড়ে পড়ে নাক ডাকতে জাম্বুবান। আসল কৃতিত্ব আমার। 
লক্ষণ।। আর আমি যদি শক্তিশেল খেয়ে না পড়তাম, তবে তো এসব কান্ড হতোই না। আর তোমরাও কেউ বাহাদুরি জাহির করতে পারতে না। 
প্রত্যেকে নিজের নিজের বাহাদুরি জাহির করতে ব্যস্ত। এটাই বাঙালি, বাংলার সাহিত্য। এর নাগাল পাওয়া সবার কাজ নয়। 

বাংলায় বোকা গাধা বলতে গরু ছাগল বলা হয়। কিন্তু খুব বড় মাপের বোকা গাধা বোঝাতে গেলে রামছাগল, রামপাঁঠা, এগুলোই বলা হয়। আমরা তো গোবরকে মাটির উপর শক্ত প্রলেপ হিসেবে ব্যবহার করি। মাটির ক্ষয়কে কিছুটা রোধ করে, তাই গোবরের ব্যবহার মাটির বাড়িতে, উঠোনে, মাটির মেঝেতে দেখা যায়। কিন্তু গোবরে দেবত্ব আরোপ হয় না। তা না হলে নির্বোধ হিসেবে আমরা বলি কেন "মাথার মধ্যে গোবর পোরা"। সুকুমার রায়ের কবিতায় আছে, "মগজে তোর গোবর গুলো হচ্ছে ঘুঁটে শুকিয়ে"। বাংলার এই রঙ্গ তামাশা গুলো স্মরণে রাখলে বোঝা যায়, এখানে রাম গরু গোবর কিছুই সেভাবে দেবত্বে উন্নীত হয়নি। বানর হনুমান এই বাংলায় লোককে গালাগালি হিসেবে ব্যবহার হয়। তাছাড়া এই দুই প্রাণীকে খুব ক্ষতিকারক হিসেবে দেখা হয় না। কারণ বোধহয়, মানুষের সাথে তার বিশেষ সাদৃশ্য। খেতে দেয়, তাকে নাচিয়ে, খেলিয়ে পয়সা উপার্জন করে এবং সেই খেলার কাহিনী থাকে মানুষেরই কাহিনী। 

আবার ভাবুন, শিব কে নিয়ে লোকগীতিতে বলা হচ্ছে "মেনকা মাথায় দে লো ঘোমটা। বেছে বেছে করলি জামাই, ও সে সারা জীবন ন্যাংটারে ন্যাংটা"। আর শিবের প্রধান দুই অনুচর নন্দী ও ভৃঙ্গী সে তো বঙ্গ সমাজে সাহিত্যে সর্বত্রই মস্করা ও ব্যঙ্গ বিদ্রুপের পাত্র। বাংলার আগমনী গানে পার্বতী তো অসুর নিধনকারী নয়, সে বৎসরান্তে পিতৃগৃহে আসে। মেয়ে সারা বছর অভাব অনটনে পতিগৃহে থাকে। পতি তার নেশা ভাঙ করে, গায়ে ভস্ম মেখে শ্মশান বাসী। মেয়ের এই চরম কষ্ট মা মেনকা সইতে পারে না। তাই সে অনুরোধ করে তার স্বামীকে "যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী"। তারপর বলে "এবার উমা ঘরে এলে, পাঠাবো না আর ভোলার ঘরে"। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শিবের অনুচরেরা এসে শিব উমাকে সপরিবারে ফিরিয়ে নিয়ে যায় কৈলাসে। তাই নবমীর রাতে উমার চোখে ঘুম নেই। কণ্ঠে বিষাদের সুর -- নবমীর নিশিরে তোর দয়া নাই। এত করে সাধিলাম, এত কাঁন্দিলাম, তবু হইলি ভোর। মাইকেল মধুসূদন দত্ত মা মেনকার এই করুণ প্রার্থনাকে অসাধারণ রুপ দিয়েছেন --

যেওনা রজনী আজি লয়ে তারা দলে। 
গেলে তুমি দয়াময়ী এ পরাণ যাবে।। 
উদিলে নির্দয় রবি উদয় আঁচলে। 
নয়নের মনি মোর নয়ন হারাবে।। 

এ তো পিতৃগৃহে মা বাবার আকুতি। বছর পরে উমা ঘরে ফিরছে। ঘরে ঘরে যে কাহিনী চলে আসে, সেই কাহিনীরই অনুরণন শুনতে পাই, যখন বিবাহিত বোন শ্বশুর বাড়িতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে, কখন তার ভাই এসে তাকে বাপের বাড়ি নিয়ে যাবে -- কে যাস রে, ভাঁটি গাঙ বাইয়া, আমার ভাইজানরে কইও নায়র নিতে আইয়া। এই আকুতি বাংলার দুর্গোৎসবে, উমার আগমনে। দেব দেবীরা এখানে নিজের গৃহের ও পরিবারের একজন সদস্য। ভাঁটির পরিবেশে খাদ্য তালিকায় যা কিছু অন্তর্ভুক্ত এরা তার সবই দেবতাকে উৎসর্গ করে। এখানে লক্ষ্মীপূজায় চিংড়ি দিয়ে লাল শাক, ফুলকপি দিয়ে ভেটকি, ইলিশ মাছ, কৈ মাছ, সব কিছু পরিবেশন হয়। দিল্লিতে বসে দুর্গাপূজোয় আমিষ খাদ্যে সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি হতেই পারে। কিন্তু বাঙালি জানে, মেয়ে মাত্র কদিনের জন্য এসেছে বাপের বাড়ি। অতএব তাকে পঞ্চ ব্যঞ্জনে ভালো-মন্দ সাজিয়ে দিতে হবে। কারণ বাউন্ডুলে জামাই এর ঘরে মেয়ের কিছুই জোটে না।

চিন্তা ভাবনায় বঙ্গ ভূমির সাথে গো বলয়ের এই পার্থক্য রয়েছে। অনেক উপর দিয়ে যাচ্ছে ছক্কা। এই ছক্কায় বলের নাগাল পেতে গেলে ফিল্ডার কে মাঠের বাইরে চলে যেতে হবে। এই বাংলাকে কি করে জানবে গো বলয়? কি করে বুঝবে হিন্দি বলয়। দোর্দণ্ড প্রতাপ দিল্লি সুলতানী শাসনেও দুশোরও বেশি বছর বাংলা ছিল স্বাধীন। মুঘল শাসকরাও বারংবার টের পেয়েছে বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি।

0 Comments

Post Comment