সাম্প্রতিক সময়ে উড়িষ্যার বালাসরে যে ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে, তাতে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। কার গাফিলতিতে এই ঘটনা ঘটলো? ক্যাগের রিপোর্ট কী বলছে? প্রধানমন্ত্রী বা রেলমন্ত্রী যে এতো অভিনয় করলেন, তা কি লোকদেখানো? শুধুমাত্র বন্দে ভারত বা অন্যান্য দ্রুতগতির ট্রেন নিয়ে হইচই করলেই কি রেলের সমস্যার সমাধান হবে, না কি রেলযাত্রা প্রতিদিন আরও বিপদ ডেকে আনতে পারে?
কম্পট্রোলার অডিটর জেনারেল... সংক্ষেপে ক্যাগ। ভারতীয় সংবিধানের ১৪৮ নং ধারা অনুসারে গঠিত, রাষ্ট্রপতি দ্বারা নিয়োজিত একটি সংস্থা.... মহাগণনা পরীক্ষক, ভারতের সরকারী বেসরকারী সমস্ত ক্ষেত্রে হিসাব নিয়ন্ত্রণ ও গণনা পরীক্ষায় চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী একমাত্র সংস্থা... যা সরকারের নিজস্ব। সবাই জানেন।
২০১৭ থেকে ২০২১ পর্যন্ত ভারতীয় রেলের বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে রেল দুর্ঘটনার কারণ, বিশেষত ডিরেলমেন্টের কারণ অনুসন্ধান করে এই ক্যাগ এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত এবং পরামর্শ সম্বলিত একটি রিপোর্ট পেশ করেন পার্লামেন্টে..২০২২ সালে।
ভারতীয় রেলওয়ে কীভাবে চলছে , রেলের নানারকম টেকনিক্যালিটিজ, প্রযুক্তি এবং পরিদর্শনঘটিত ক্ষেত্রে রেলের কী পরিস্থিতি, কী অগ্রগতি, কোথায় কী ঘাটতি, কী খরচ, কী প্রয়োজন .... সবকিছু নিয়েই এই পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট।
রিপোর্টটি অনুধাবন করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে... এর যা অবজার্ভেশন বা বক্তব্য তা কিন্তু রেলের অবস্থা, নিরাপত্তা, খরচ, নিয়োগ ইত্যাদি সবকিছু নিয়ে.... তা সাম্প্রতিক প্রধানমন্ত্রীর কথাবার্তা এবং দাবীর সাথে মিলছে না। রিপোর্টটি শুরুই হচ্ছে একটা এক্সিকিউটিভ সামারি দিয়ে এবং তার পরপরই রয়েছে সংক্ষিপ্ত সিদ্ধান্ত সমূহ (summary of conclusions)।
তারপর মোট সাতটি অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
প্রথমেই বলে রাখা উচিত অ্যাক্সিডেন্টের কারণ বিশ্লেষণ করতে ক্যাগ Swiss cheese model প্রয়োগ করেছেন এবং এই পদ্ধতি টি কী সেটি খুব প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যাখ্যাও করেছেন... যার মূল কথা হলো অ্যাক্সিডেন্ট মোটেই আলটপকা হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নয়। কারণ মহতী একটি রেল ব্যবস্থায় চার পাঁচটি নিরাপত্তার স্তর থাকে.... চীজ স্লাইসের মতোই.... তার সবকটাতেই যখন ফুটো থাকে এবং সবকটা ফুটো যখন এক লাইনে এসে পড়ে...(মানে পরপর সবকটা ফল্ট একাদিক্রমে ঘটে আর কি...) ঠিক তখনই অ্যাক্সিডেন্ট বা দুর্ঘটনা ঘটে।
এবার মূল রিপোর্টে আসা যাক।
১। ক্যাগ রিপোর্ট ২০২২ বলছে ২০১৭ থেকে ২০২১ পর্যন্ত মোট ২০১৭টি রেল দুর্ঘটনা ঘটেছে যার মধ্যে ১৩৯২টি ঘটনা ডিরেলমেন্ট এর জন্য, যে সংখ্যাটা কিনা মোট ঘটনা সংখ্যার ৬৯ শতাংশ। আর এর মধ্যে শুধু যদি কন্সিকোয়েনশিয়াল অর্থাৎ খুব বেশি অভিঘাতযুক্ত ঘটনা ধরা যায় .... (যেমন এই বালাশোর এর ঘটনাটা) তাহলে মোট ২১৭ টি ওরকম দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং তার মধ্যে ১৬৩ টি ঘটনা ঘটেছে ডিরেলমেন্ট এর জন্য। এটাও ৭৫ শতাংশ। এর সঙ্গে কলিশনের জন্য ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা যোগ করলে হয় ৮০ শতাংশ।
২। ক্যাগ আরো বলছেন ১৩৯২টি ডিরেলমেন্টের মধ্যে যে ১১২৯টি ঘটনার বিশ্লেষণ হয়েছে তার মধ্যে ২৮৯টি ডিরেলমেন্টের ঘটনার জন্য দায়ী ট্র্যাক রিনিউয়ালের অভাব। অর্থাৎ ২৬ শতাংশ। অর্থাৎ এই ডিরেলমেন্টের জন্য দায়ী হলো যথা সময়ে ট্র্যাক রিনিউয়াল না হওয়া।
(এই বিষয়ে পরে একটু বিশদে বলা যাবে। )
৩। এবার কথা বলা যাক ট্র্যাক মেনটেনেন্স নিয়ে। অডিট রিপোর্টের সবচেয়ে বেশি জায়গা দখল করেছে এই ট্র্যাক মেনটেনেন্সের আলোচনা , বৃহত্তম দু নম্বর চ্যাপ্টার । যা ৬৭ পাতার ক্যাগ রিপোর্টের মোট ২৪টি পাতা দখল করে আছে।
ট্র্যাক রেকর্ডিং কার, TRC বলে একটা ব্যাপার আছে যা ট্র্যাক পরিদর্শনের জন্য ব্যবহৃত হয়.... কোথায় কী ফল্ট আছে দেখার জন্য)....ক্যাগ এর মতে ভীষণই গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যবস্থা।এই TRC ব্যবহারের ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত ঘাটতি ( shortfall) দেখা গেছে। এ কথার মানে হলো ১৬টি রেলওয়ে জোনের কোথাও ৩০ শতাংশ, কোথাও এর চেয়ে বেশি, এবং কয়েকটি জোনে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত ঘাটতি রয়েছে। এর মধ্যে ইষ্টার্ন রেলে ৫০ শতাংশ এবং ইষ্ট সেন্ট্রাল রেল, নর্থ ফ্রন্টিয়ার রেল, নর্থ ওয়েষ্টার্ন রেল, সাউথ ওয়েষ্টার্ন রেল, এই জোন গুলোতে ১০০ শতাংশ ঘাটতি দেখা গেছে TRC পরীক্ষায়। এই TRC পরীক্ষা না হওয়ার দরুণ ট্র্যাকের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করা যায় নি এবং ফলতঃ দুর্ঘটনা ঘটেছে।
এ সম্পর্কে একটি উদাহরণ দিয়েছেন ক্যাগ। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে সীমাঞ্চল এক্সপ্রেসের যে দুর্ঘটনা ঘটে তার রিপোর্ট বলছে ঐ ট্র্যাকে বিগত চারমাস ধরে ট্র্যাক রান ডিউ ছিল। এই ঘাটতির কারণ দেখানো হয়েছে, "main reasons assigned for the shortfall in the inspections was non-receipt of the programme for the running of TRCs..... "
৪। এরপর ক্যাগ বলছেন ট্র্যাকের মেকানাইজড মেনটেনেন্স প্রসঙ্গে। যেসব ট্র্যাকে কংক্রিট স্লিপার বসে গেছে, আধুনিক উন্নত ব্যবস্থা সম্বলিত যে ট্র্যাক গুলো রয়েছে সেগুলোতে ম্যানুয়াল নয়, এই যান্ত্রিক মেনটেনেন্স কার্যকরী। কিন্তু এরকম হেভি মেশিনের সংখ্যা খুব সীমিত, ৫১৭টি মাত্র। এই কারণে নির্দেশ ছিল কোথাও মেশিন যেন খালি বসে না থাকে। অথচ ক্যাগের পর্যবেক্ষণ বলছে ২০১৭ থেকে ২০২১ পর্যন্ত ৭,৫৪,৮২০ টি available machine days এর মধ্যে ১,২০,১৩০ টি machine days নষ্ট হয়েছে!! অর্থাৎ এই সংখ্যাটি idle machine days হিসেবে তথ্য ভুক্ত!!
৫। কংক্রিট স্লিপার গুলোকে বলে RT- ৮৫২৭ স্লিপার। খুব সংক্ষেপে যদি বলা যায়, ক্যাগ লক্ষ করেছেন যেখানে যেখানে স্লিপার রিনিউয়াল হয়েছে, সেই সব জোন গুলোতে provision থাকা সত্ত্বেও ৫৭ শতাংশ ক্ষেত্রে RT- ৮৫২৭ স্লিপার তৈরি করা হয় নি!! বরং আদ্যিকালের স্লিপারই বসানো হয়েছে।
এবং এ সম্পর্কে কোনো জোনেরই উত্তর ক্যাগের কাছে সন্তোষজনক মনে হয়নি।
৬। এবার আরেকটা যান্ত্রিক কচকচিতে চলে আসা যাক। একটু ঝামেলার মনে হলেও এ বিষয়ে ঢুকে পড়াটা জরুরি মনে হয়েছে। অ্যালুমিনো থার্মিট- AT, এবং ফ্ল্যাশ বাট- FB, এই দু রকমের ওয়েল্ডিং পদ্ধতি আছে রেললাইন গুলো জুড়ে দেওয়ার জন্য। এর মধ্যে AT হলো পুরনো পদ্ধতি এবং তাড়াতাড়ি ভেঙে যায়। FB পদ্ধতি আধুনিক আবিষ্কার এবং মজবুত পদ্ধতি।
অথচ ২০১৭ থেকে ২০২১ এর মধ্যে যেখানে ১৭, ৩৫, ২৬১ টা FB পদ্ধতিতে জোড়া লাগানোর টার্গেট ছিল, সেখানে ৪, ৮০,৯৬৪ টা লাগানো হয়েছে। বাকিটা হয়নি। অর্থাৎ খামতি আছে।
এ প্রসঙ্গে কিন্তু, পার্লামেন্টে স্ট্যান্ডিং কমিটির প্রশ্নের উত্তরে বিবৃতি দিতে গিয়ে রেলমন্ত্রী বলেছেন... "Technology upgradation in the laying and maintenance of track is being carried out continuously, switching over to Mobile FB Welding in place of AT Welding to carry out weld renewals. The quality of Mobile FB Welding is superior to AT Welding"। রেল দফতরের কথা ও কাজে এইপ্রকার স্ববিরোধিতায় ক্যাগ বিস্ময় প্রকাশ করেছেন রিপোর্টেই।
শুধু তাই নয়, ক্যাগ আরো দেখেছেন এবং দেখিয়েছেন যে ৮৬ শতাংশ ক্ষেত্রে FB Weld এর জন্য বরাত দেওয়া হয় নি।(এই চার বছরে) AT Weld এর জন্যই বরাত দেওয়া হয়েছে। এই বরাত দেওয়ার হিসেব টেবল করে তুলে দেওয়া হয়েছে ক্যাগ রিপোর্টে।
৭। USFD অর্থাৎ Ultrasonic Flaw Detection Testing, আরো একটি আধুনিক ব্যবস্থা রেললাইন এবং জয়েন্ট এ কোনো ত্রুটি আছে কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য। এই পদ্ধতি ব্যবহার করার ক্ষেত্রে নর্দার্ন জোনে ৫০ শতাংশ shortfall এবং এই ঘাটতির রেঞ্জ ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত, সবকটা জোন মিলিয়ে। এই পর্যন্ত এসে একটা জিনিস পরিষ্কার বোঝা যায় যে, রেলের আধুনিকীকরণ বা যন্ত্রীকরণ সম্পর্কে যা প্রচারিত জনধারণা তার দশ শতাংশ ও সত্য কিনা তা নিয়ে প্রশ্নের জায়গা আছে।
৮। এবার একটা অন্য পরিসংখ্যানে যাওয়া যাক। ৪২২টি ডিরেলমেন্ট ঘটেছে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের ত্রুটির কারণে। যার মধ্যে ট্র্যাক মেনটেনেন্সের ঘাটতির জন্য ঘটেছে ১৭১ টি ঘটনা এবং ১৫৬টি ঘটনা ঘটেছে "deviation of track parameters beyond permissible limit" এর জন্য। ১৮২ টি ঘটনার দায় মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্টের। রেলের চাকার ডায়ামিটার ভ্যারিয়েশন এবং কোচের খুঁত ইত্যাদি বিষয় এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ১৫৪ টি ঘটনার জন্য লোকো পাইলট অর্থাৎ চালকের দায় রয়েছে। ২৭৫টি ঘটনার জন্য দায়ী অপারেটিং সিস্টেমের ত্রুটি। লোকো পাইলটদের দায় সম্পর্কে অডিট রিপোর্টে বলা হয়েছে পাইলটদের Streching of duty hours (একটানা 10 ঘন্টা পর্যন্ত) এবং তাদের প্রয়োজনীয় টেকনোলজিক্যাল সাপোর্ট না দেওয়া। এগুলো প্রধানতঃ দায়ী। এ সমস্যা মেটাতে অনলাইন কাউন্সেলিং ছাড়া অন্য কোনো পদক্ষেপ রেলের তরফে নেওয়া হয় নি।
৯। রিপোর্ট আরো বলছে যে, TMS অর্থাৎTrack Monitoring System নামে একটা অনলাইন ওয়েব বেসড সিস্টেম আছে ট্র্যাক গুলোর স্বাস্থ্য ভালো আছে কিনা তা অনলাইন মনিটর করার জন্য। এটা বিভিন্ন উচ্চ পদস্থ আধিকারিকদের দ্বারা করার কথা। কিন্তু এটা নাকি আদপে চালুই নেই কোনো জোনে "নট অপারেশনাল", ক্যাগ এর ভাষায়।
১০। এবার ফিরে আসা যাক ট্র্যাক রিনিউয়াল প্রসঙ্গে। রেলমন্ত্রকের সেফটি পারফরম্যান্স ডকুমেন্টে বলা আছে। " It is essential to carry out not only the track maintenance operations, but also to renew the track as and when it becomes due for renewal. " রেলের স্ট্যান্ডিং কমিটির রিপোর্ট বলছে ২০১৫ সালে মোট রেললাইনের দৈর্ঘ্য
১, ১৪,৯০৭ কিলোমিটার, এবং প্রত্যেক বছর এর মধ্যে ৪৫০০ কিলোমিটার করে ট্র্যাক রিনিউয়াল করা বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। দিনের পর দিন এই বাৎসরিক ট্র্যাক রিনিউয়াল ডিউ থেকে গেছে। এবং এই অ্যাকুমুলেটেড ডিউ ট্র্যাক রিনিউয়ালের বোঝা বর্তমানে একটা প্রায়-অসম্ভব টাস্কে পরিণত হয়েছে। পরিসংখ্যান আরো বলছে ট্র্যাক রিনিউয়াল ফান্ড ২০১৮ সালে ছিল ৯৬০৭.৬৫ কোটি টাকা। সেটা কমে ২০২০ সাল নাগাদ হয়েছে ৭৪১৭ কোটি টাকা। ওয়েস্টার্ন রেলওয়েতে ২০১৯-২০ সালে মাত্র ৩ শতাংশ খরচ করা হয়েছে ট্র্যাক রিনিউয়ালের জন্য।
১১। RRSK অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় রেল সংরক্ষা কোষ তৈরি হয় ২০১৭ সালে । মূলতঃ সেফটি নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে এই কোষ থেকে সমস্ত টাকা ব্যয় হবে এটাই ছিল বাধ্যতামূলক। আর এর তিনটে প্রায়োরিটি ঠিক করা হয়েছিল। প্রায়োরিটি ওয়ান সেক্টরের মধ্যে আছে ট্র্যাক রিনিউয়াল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এই ট্র্যাক রিনিউয়ালের জন্য ক্রমাগত খরচ কমানো হয়েছে ২০১৭ সালে ৮১ শতাংশ থেকে এই খাতে খরচ কমিয়ে ২০১৯ সালে ৭৩ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। একদিকে এই খরচ কমার কারণ দেখানো হয়েছে ফান্ডের অভাব। আরেকদিকে ট্র্যাক রিনিউয়াল ইত্যাদি আরো অনেক নিরাপত্তা সংক্রান্ত কারিগরির ক্ষেত্রে বরাদ্দ টাকা খরচই হচ্ছে না। ফেরত পাঠানো হয়েছে। ফান্ড সারেন্ডার হচ্ছে। নিরাপত্তা জনিত খাতে "নন ইউটিলাইজেশন অফ ফান্ডস" এর মতো গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন ক্যাগ।
১২। আরো দেখা গেছে কোট আনকোট... রেলওয়ের মধ্যে একটা জেনারেল ট্রেণ্ড অ্যাক্সিডেন্ট এর জন্য হিউম্যান এররের ওপর দোষ চাপানো, যেখানে ক্যাগ দেখতে পাচ্ছে ... মেনটেনেন্সের কাজের জন্য রেল মূলত আউটসোর্সিং এর ওপর ডিপেন্ড করেছে, কিন্তু এই কাজের জন্য, সেফটি ক্যাটাগরিতে যথেষ্ট কর্মীনিয়োগ হয়নি. না দপ্তর থেকে, না আউটসোর্সিং এর দ্বারা.. যার কারণে মেনটেনেন্সের কোয়ালিটি খারাপ হতে থেকেছে। এই সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য প্রদান করেছেন ক্যাগ রিপোর্ট। এই বিষয়ে ট্র্যাক মেনটেনেন্স এর গায়ে গতরে খাটা কর্মী থেকে শুরু করে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার সহ সমস্ত কর্মী দের ক্ষেত্রে একই ঘটনা পরিলক্ষিত হয়েছে। তথ্য টেবল করে দেওয়া হয়েছে রিপোর্টে। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার দের ক্ষেত্রে এই ঘাটতি ৩৬ শতাংশ পর্যন্ত।
১৩।
পুরনো অ্যাক্সিডেন্ট পুরনো ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে চলা জরুরি। সেজন্য অ্যাক্সিডেন্টের এনকোয়ারি রিপোর্ট জমা পড়া এবং সেগুলো পর্যবেক্ষণ করা জরুরি। তার রেকমেন্ডেশন গুলো মেনে চললে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পথে এগোনো যায়। ক্যাগ বলছেন। অথচ যতগুলো অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে তার নাকি ৬৩ শতাংশের রিপোর্ট ই জমা পড়ে নি সময়ের মধ্যে। এমনকি ৪৯ শতাংশের রিপোর্ট গৃহীতই হয় নি ।
(কী কাণ্ড!!)
১৪। এবার রেলওয়ে সেফটি বাজেট নিয়ে কথা বলা যাক। প্রত্যেক বছর ২০ হাজার কোটি টাকা করে এই রেল নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ আছে RRSK অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় সংরক্ষা কোষ অনুসআরে, এর মধ্যে রেলের অভ্যন্তরীণ রিসোর্স থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা দিতে হবে এবং বাজেট থেকে আসবে ১৫ হাজার কোটি টাকা। ট্র্যাক রিনিউয়াল, ট্র্যাক মেনটেনেন্স, অগ্নি নির্বাপক, সিগন্যালিং, ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি ইত্যাদি মিলিয়ে এই টাকা খরচ করার কথা। অন্য ক্ষেত্রে নয়।
কিন্তু অবাক করে দেওয়ার মতো ঘটনা হলো দুটো। তার মধ্যে একটা , ক্যাগ বলছেন,
ক) **** ২০১৭ তে এর মধ্যে এক পয়সাও যোগ করা হয় নি রেলের নিজের রেভিনিউ এর তরফ থেকে এই সেফটি ক্যাটাগরিতে।
খ) **** ২০১৮ সালে বাজেট বরাদ্দের চাইতে ৩৯ শতাংশ কম টাকা এসেছে ।
গ) **** ২০১৯-২০ তে বরাদ্দের ৯৬ শতাংশ কম।
ঘ) ***** ২০২০-২১সালে এই বরাদ্দের ৮০ শতাংশ কম টাকা রেলের তরফে দেওয়া হয়েছে।
ফলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং রেলের অ্যাসেট বাড়াতে যে পরিমাণ টাকা খরচ হওয়ার কথা RRSK থেকে,তা মোটেই হয়নি। আগেই বলা হয়েছে ২০১৭ সালে সালে প্রায়োরিটি ওয়ান খাতে খরচ করা হয়েছে ৮১ শতাংশ। এরপর ২০১৯-২০ তে এটা কমে হয়েছে ৭৩.৭৬ শতাংশ।
দু নম্বর আশ্চর্য ঘটনা হলো, এর পাশাপাশি তিনটে প্রায়োরিটি খাতকে বাদ দিয়ে নন- প্রায়োরিটি ক্ষেত্রে খরচ বাড়ানো হয়েছে। সেটার পরিসংখ্যানও দেওয়া হয়েছে ক্যাগ রিপোর্টে....
২০১৭- ১৮তে যা ছিল ৪৬৩ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ তে নন প্রায়োরিটি খাতে খরচ হয়েছে ১০০৪ কোটি টাকা।
রেলমন্ত্রকের safety documents এর ভাষায়, "Track forms the backbone of railway transportation system " । কিন্তু তারাই আবার RRSK থেকে নিরাপত্তা খাতের টাকা সরিয়ে অন্যান্য খাতে খরচ বুকিং করেছেন। সংরক্ষা কোষের টাকা "incorrect booking" এর অভিযোগ তুলেছেন ক্যাগ। RRSK এর বরাদ্দ টাকা খরচের ভাউচার যা পাওয়া যাচ্ছে তাতে দেখা গেছে রেলের স্টেশন সংক্রান্ত নানা জিনিস, আসবাবপত্র, বাসনপত্র, এলিভেটর ইত্যাদি জিনিস কেনার ভাউচার মিলছে প্রায় ৪৮ কোটি টাকার।
উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে। অর্থাৎ হাই প্রায়োরিটি সেক্টর থেকে খরচ বিপজ্জনক ভাবে কমিয়ে, নন- প্রায়োরিটি সেক্টর এ যথেচ্ছ খরচ বাড়ানো হয়েছে।
রেলের নিয়োগ তো সবার জানা তথ্য। বলার মতো নয়। সুবিশাল সংখ্যা। মোট তিন লক্ষ এগারো হাজারের ও বেশি পোস্ট শূন্য।
আরো আরো অনেক কিছু। ক্যাগ রিপোর্টে আরো অনেক বিষয়ে অনেক পয়েন্ট আছে। বলতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে।
**** মোটমাট ক্যাগ রিপোর্ট summary করলে দাঁড়ায় ....একদিকে... রেলওয়ে ট্র্যাক রিনিউয়াল, ট্র্যাক মেনটেনেন্স, সিগন্যালিং, ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি সহ সমস্ত সেফটি ব্যবস্থা অবহেলিত, টাকা খরচ হচ্ছে না, বরাদ্দ কমছে , অন্যদিকে নিয়োগ কমছে.... কর্মীদের ওপর চাপ বাড়ছে। সেফটি মেজারস্ কমছে । নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং নিয়োগ দুদিক থেকেই খরচ কমিয়ে চকচকে দ্রুতগতির ট্রেন নামানো হচ্ছে। এটা পরিষ্কার। ******
তাহলে বুলেট ট্রেন, বন্দে ভারত, আধুনিকীকরণ, ডিজিটাল ইন্ডিয়া, এগোচ্ছে দেশ...
কীরকম ব্যাপারটা? বোধগম্য হয়?
এই তথ্যগুলো সবই ক্যাগের রিপোর্ট অনুযায়ী পরিবেশিত। যে কেউ উৎসুক হলে রিপোর্ট মিলিয়ে দেখে নিতে পারবেন।
ওড়িশার বালাসোর/ বালেশ্বরে অতিসম্প্রতি গত ২রা জুন, ২০২৩ সালে যে ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা ঘটে গেল এবং যে পরিমাণ মর্মান্তিক মৃত্যু আমরা দেখতে পেলাম তারই অভিঘাত এই লেখাটির প্রণোদনা।
উপসংহারে লেখকের দিক থেকে একটাই নিজের কথা বলবার আছে। আমি যদি উদ্যত হয়ে ইচ্ছে করে কাউকে খুন করি সেটা যেমন হত্যা, তেমনি আমার হাতে ন্যস্ত কোনো গুরুদায়িত্বে আমারই স্বেচ্ছাকৃত গাফিলতির কারণে কারো মৃত্যু ঘটলে সেটাও খুনের চেয়ে কম কিছু নয়...খুব কাছাকাছি একটা অপরাধ। আইনও তাই বলে বোধহয়।
রাষ্ট্রীয় কোনো দপ্তরের ক্ষেত্রেও সেটাই প্রযোজ্য। নইলে ওয়েলফেয়ার স্টেটে দায়বদ্ধতা বলে কোনো শব্দের অস্তিত্ব থাকে না।
তাই দুর্ঘটনা এবং গণমৃত্যু দায়হীন হতে পারে না।
(ছবিগুলো CAG রিপোর্ট থেকে নেওয়া।)