'রজনীশ ভালবাসতেন মিডিয়াকে চমকে দিতে, অবশ্য ঘুরিয়ে বলা যেতে পারে, মিডিয়াও প্রেমে পড়ে গিয়েছিল এই, উজ্জ্বলচক্ষু, উচ্চকিত, চমকপ্রদ দাড়িওয়ালা লোকটির চমকগুলির প্রতি, যাকে তার ভক্তেরা একালের অন্যতম জ্ঞানী মানুষ মনে করতো।'
- ওশো প্রসঙ্গে সুধীর কক্কর
পাগল ছাড়া দুনিয়া চলেনা
রোদ্দুর রায়ের গ্রেপ্তারীর পর একাধিক সামাজিক প্ল্যাটফর্মে তাকে পাগল, মানসিক বিকারগ্রস্ত- অসুস্থ হিসাবে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চলছে লাগাতার। এরিক ফ্রম তার 'The sane society' বইটিতে আধুনিক যন্ত্রসভ্যতার- বিপক্ষে কিছু যুক্তিজাল বুনেছিলেন- একদিকে ওল্ড টেস্টামেন্টের ভাষ্য ও এক সাইকিয়াট্রিস্টের বয়ানে- যেখানে তিনি আমাদের তথাকথিত 'সুস্থ' সমাজের বন্ধনগুলিকে, শেকলগুলিকে তালিকাভুক্ত করেন- যেমন- পৃথিবীব্যপী ধংব্বসাত্মক যুদ্ধ, অর্থনৈতিক অসাম্য এবং অস্থিরতা, এবং অতি অবশ্যই জঘন্যতম মাস-মিডিয়া। ফ্রম এখানেই নিজের দুটি প্রশ্ন রাখেন- 'আমাদের কি এই চলমান চালচিত্র, যা চলছে, তার সাথেই নিয়ত চলতে হবে?- আরও একটি মোক্ষম প্রশ্ন তিনি রাখেন 'That modern civilization fails to satisfy profound needs in man?' এইটিই আসল প্রশ্ন, কোন তাড়নায় ডিজিটাল- ব্যথায় নীল হয়ে আসা, একদা আইটি কর্মী অনির্বান রায়, রোদ্দুর রায় হয়ে ওঠে? কোন তাড়নায় জেনারেশন ওয়াই- জেডরা হয়ে ওঠে তার তথাকথিত 'অসুস্থ' গালিসমৃদ্ধ পারফরম্যান্সগুলির সাবস্ক্রাইবার? এর উত্তর হয়তো মিশেল ফুকো- সাহেবের 'পাগলাগারদের জন্ম' নিবন্ধে খানিক দেখিয়েছেন। ভয়ের উপস্থিতিকে তিনি পাগলাগারদের ক্ষেত্রে 'এসেনশিয়াল' হিসাবে দেখালেন। এবং, এই বন্দিদশাকে তিনি দেখলেন একজন ক্ষ্যাপা লোক ও একজন স্বাভাবিক 'যুক্তি'বোধে পরিচালিত মানুষের মধ্যবর্তী এক সংযোগপথ হিসাবে। কিন্তু, এই পদ্ধতিতে পাগলের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হল তার আদতস্বভাবকে, যা তার পাগলামি। এবং তা কি উদ্দেশ্যে? ফুকো বলছেন- 'Now madness would never- could never- cause fear again.' অর্থাৎ, তথাকথিত 'সুস্থ'দের একজন অসংলগ্ন কথা বলা, পাগলের ছায়াকে দেখে যে ভয় তৈরী হত, তা দূরীভূত করার জন্য পাগলকে আনা হল ভয়ের খাঁচায়। সুস্থ, পরিশীলিতরা আদপে নিজেদের লুক্কায়িত উন্মাদনাকে ঢাকতে, অন্যকে উন্মাদ দাগিয়ে দেন। রোদ্দুরের ক্ষেত্রেও তাই হল, যখনই সে যুক্তিতন্ত্রের বাঁধা সিলেবাসে নিজের প্রতিবাদকে নথিভুক্ত করলো না, তাকে চলে যেতে হল গরাদের ওপারে।আমাদের জানা নেই কোন 'মোক্ষের' কথা সে বলে, কিন্তু এটুকু বুঝি আমাদের বৃহত্তম গণতন্ত্রের খাঁচায়, কখনো কখনো রোদ্দুরের প্রয়োজন হয়।
শ্লীল- অশ্লীল দ্বন্দ্বসমাস
রোদ্দুরের বিরুদ্ধে মূলতঃ প্রকটভাবে সামাজিক অভিযোগটি অশ্লীলতার। পনেরো শতকের বিখ্যাত সংস্কৃতজ্ঞ বিশ্বনাথ কবিরাজের সাহিত্য- দর্পণে' অশ্লীলতার উদাহরণস্বরূপ লেখক একটি বাক্য উদ্ধৃত করেছিলেন- 'ভ্রমসার শনৈর্বায়ুর্বিনাশে তন্বী, তে তদা' (অর্থাৎ, হে তন্বী! তুমি চলিয়া যাইবার সময় ধীরে ধীরে বায়ু নিঃসৃত হইতেছিল) অর্থাৎ, ইঙ্গিতটা মহিলার বাতকর্মের প্রতি। অথচ, এই স্বাভাবিক শারীরিক ক্রিয়াটি প্রখ্যাত আলঙ্কারিকের মতে 'অশ্লীল'। এই ক্ষমতা-ভাষ্যের বিপরীতে প্রায় বিকল্প নির্মাণে ১৯৮৪-১৯৯০ অবধি প্রকাশিত আঁভাগার্দ পত্রিকা 'মানুষের বাচ্চা'য় সুব্রত সেন লিখেছিলেন- 'দুজন মানুষ চুদছে- এটা সরল বাক্য নয়? দুজন মানুষ হাসছে-র মত 'স্বাভাবিক' নয়? সুন্দর নয়? যাবতীয় সমাজমানসিক জড়তা ও বদঅভ্যাস সরিয়ে সহজ বাক্যের সারল্যকে বোঝার জন্যই বহুদীর্ঘ আন্দোলনের প্রয়োজন নেই? সারল্যের অর্থ কি নয় নির্মোহ, বিজ্ঞান, বস্তুমাতৃক জৈবিক জটিলতা এড়াবার কান্ডজ্ঞানী শ্বেতসন্ত্রাসের প্রতিরোধ? সারল্য বোঝায় নাকি কি করে একটা সাধারণ দৈহিক ক্রিয়া ক্রমশ রহস্য, মায়া, মিথ্যে, গল্প, ফাঁকি, বুজরুকির পাহাড় হয়ে ওঠে? কেন হয় এসব? কে করে? যুগপৎ একথাও না ভুলে থাকা যাক সত্যানুসন্ধানের ছায়া-ধরার-খেলা বাবুসভ্যতার এক ধারাবাহিক ষড়যন্ত্র মাত্র।' - যাইহোক, শরীর ও অশ্লীলতার সঙ্গে সম্পৃক্ত মিথবলয়টিকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেওয়া 'মানুষের বাচ্চা' পত্রিকাগোষ্ঠী রোদ্দুরের মত সেনসেশন হয়নি; তারা হতেও চায়নি। কারণ, তাদের কাছে শিল্পের শর্ত ছিল, মূলতঃ শিল্পীর আপাদমস্তক ক্ষমতাহীনতা, একটি পাওয়ারলেস- এন্টিটি হয়ে ওঠা। এখানেই, রোদ্দুর নয়, অনির্বাণ রায়ের কাছে আমার কিছু প্রশ্ন থাকে। কারণ, অনির্বাণ রোদ্দুরের মত ন্যালাক্ষ্যাপা নন, তিনি তো সজাগ, সচেতন, স্মার্ট। তাহলে, যে ভিডিওটিতে তিনি বঙ্গজ বুদ্ধিজীবীদের- পাওয়ার এলিটদের খিস্তালেন, তাও আবার 'পাওয়ার- ল্যাঙ্গুয়েজে' (ক্ষমতার ভাষায়), এটা কি দ্বিচারিতা নয়? এটা কি দ্বিচারিতা নয় যে অশ্লীলতা- নামক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লড়তে লড়তে আমরা ভুলেই যাবো তৃতীয় বিশ্বের বিবর্ণ পৃথিবীতে লিঙ্গরাজনীতির কথা? কেন আমাদের সমস্ত গালিগালাজ শেষমেশ মা ও বোনকে নিজের- পুরুষাঙ্গ দিয়ে বিদ্ধ করায় এসে থামে? কেন একজন মহিলাকে স্রেফ রাজনৈতিক আক্রমণের জন্য আমাদের যৌন ইঙ্গিতের আশ্রয় নিতে হবে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিঃসন্দেহে একটি প্রতিষ্ঠান, এবং তিনি বিশাল নারীবাদীও নন, কিন্তু তাকে আক্রমণের জন্য বাঙালি- মধ্যবিত্তসুলভ,প্রতিশোধপরায়ণ সিপিএম-ক্যাডারসুলভ উচ্চারণের প্রয়োজন নেই, একথা অনির্বাণ নিশ্চয়ই বুঝবেন, বিশেষত তিনি যখন 'মানবাধিকারের' পক্ষে।
এই ক্লাউনের পয়সা হবে
একদা উনিশ শতকীয় রেবেল রূপচাঁদ পক্ষী লিখেছিলেন- 'এত বাজার দোকানদার/ কোনো রাজ্যে নাই কো আর/ পাহারাওয়ালা গলি গলি/ হাতে লয়ে পুলিশ ঝুলি/ দেখিলে মাতাল মাতোয়ারা/ ঠেলে ঢুকায় গারদ ঘর/ উত্তম মধ্যম অধম দিয়ে করে বহু সমাদর'। এই যে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা বিশ্ববাজার, সেখানে অচিরেই রোদ্দুর রায় লোভনীয় পণ্য হয়ে উঠবেন, বলাই বাহুল্য। এখানে মিডিয়াতাত্ত্বিক ম্যাকলুহান কথিত, 'Medium is the message' স্মতর্ব্য, যে মাধ্যমের ফাঁদে রোদ্দুর পা দিয়েছেন, সেই মাধ্যমটিই তাকে 'কমোডিফাই' করবে, তার রাজনৈতিক চিৎকার, উত্তরাধুনিক সাংস্কৃতিক যুক্তিতে হয়ে যাবে 'ডিপলিটিসাইজড' জনতার 'অ্যাপলিটিক্যাল' উচ্চারণ।
আর, এই পণ্যায়নের ঝোঁকে অনেকে ঋত্বিক কুমার ঘটক, নবারুণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে একপংক্তিতে রোদ্দুর রায়ের নাম উচ্চারণ করবে। অথচ, ঋত্বিক- নবারুণেরা নিজেদের মাঠের জীবন- ঘাটের জীবন দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন, শিল্প যে মুহূর্তে 'ইভেন্ট' হয়ে উঠতে চাইবে, তখন তাকে প্রথমেই পুঁজিতন্ত্রের ওই যুক্তিজালকে বিপন্ন ও খানিক অপ্রস্তুত করে দিতে হবে- যে যুক্তিপরম্পরা আমাদের মগজে গেঁথে দিয়েছে, যে কোন মনুষ্য -অভিজ্ঞতা -সে ব্যক্তিগতই হোক অথবা সমষ্টিগতই হোক, তার সঙ্গে মুনাফা মুখী হিসেবনিকেশের সম্পৃক্ততা থাকবেই।সুতরাং, সকলেই ফ্যাতাড়ু নয়, কেউ কেউ ফ্যাতাড়ু।