পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন

  • 19 December, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 935 view(s)
  • লিখেছেন : দেবাশিস মজুমদার
বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন মেসি, ফাইনালে হ্যাটট্রিকের বিরল রেকর্ড এমবাপের, হৃদয় জয় করা ফুটবল কাতার বিশ্বকাপ ফাইনালে । এই লুসেইল আইকনিক স্টেডিয়ামেই নিজেদের গ্রুপের প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের কাছে হেরে দুঃস্বপ্নের বিশ্বকাপ অভিযান শুরু করেছিল আর্জেন্টিনা। সেই লুসেইল স্টেডিয়ামেই ফাইনালে অধরা স্বপ্ন পূরণ হল লায়োনেল মেসির।

অসাধারণ অসাধারণ অসাধারণ, এককথায় এর চেয়ে অসাধারণ বিশ্বকাপ ফাইনাল হতেই পারত না। আমার জীবদ্দশায় এইরকম অসাধারণ বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। যারা প্রবীণ তাদেরও স্মৃতিতে এইরকম বিশ্বকাপ ফাইনাল বোধহয় ধরা নেই। ১৯৬৬ আর ১৯৮৬-র বিশ্বকাপ ফাইনালের উত্তেজনা সম্বন্ধে যা শুনেছি তাকেও ছাপিয়ে গেল ২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপ ফাইনালের উত্তেজনা আর সেইসঙ্গে ফুটবল সম্বন্ধে যে বলা হয়, ‘ইটস এ বিউটিফুল গেম’ তা আরও একবার প্রমাণ করে দিয়ে গেল ২০২২-এর ফিফা বিশ্বকাপ ফাইনাল।

এই লুসেইল আইকনিক স্টেডিয়ামেই নিজেদের গ্রুপের প্রথম ম্যাচে সৌদি আরবের কাছে হেরে দুঃস্বপ্নের বিশ্বকাপ অভিযান শুরু করেছিল আর্জেন্টিনা। সেই লুসেইল স্টেডিয়ামেই ফাইনালে অধরা স্বপ্ন পূরণ হল লায়োনেল মেসির। মেসি আজ ফুটবলবিশ্বের মহানায়ক, অবসরের প্রাক-মুহুর্তে তার ফুটবলার হিসাবে কেরিয়ারে আর কোনও কিছু পাওয়া অপূর্ণ রইল না। বিশ্বচ্যাম্পিয়নের তকমাও উঠল তার মাথায়, মেসি হয়ে উঠলেন দিয়েগো মারাদোনার প্রকৃত উত্তরাধিকারী। মারাদোনার পর তার অধিনায়কত্বেই বিশ্বকাপ গেল বুয়েনস এয়ার্সে। ১৯৮৬ সালের ছত্রিশ বছরের দীর্ঘ অপেক্ষার পর আর্জেন্টিনা আবার বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন এই নিয়ে তৃতীয় বারের জন্য। আর্জেন্টিনার এই বিশ্বকাপ জয় প্রত্যক্ষ করলেন ১৯৭৮ সালে আর্জেন্টিনার প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক মারিও কেম্পেস। হয়ত দিয়েগোও এই জয় প্রত্যক্ষ করছেন অন্য কোনও জগত থেকে। আর্জেন্টিনার ফুটবল ইতিহাসে ১৮ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখ এক অনন্য জায়গা করে নিল।

উল্টোদিকে ইতালি ও ব্রাজিলের পরপর দু’বার বিশ্বকাপ জয়ের রেকর্ড ছোঁয়ার খুব কাছে এসেও থমকে যেতে হল ফ্রান্সকে। কিন্তু কবিতার দেশ কাতারে যে ফুটবলটা খেলল, বিশেষত ফাইনালে যে লড়াইটা হল তাতে ফুটবলজগতে এক অনন্য সম্ভ্রম আদায় করে নিল ফ্রান্স। আর অবশ্যই বলতে হয় কিলিয়ান এমবাপের কথা। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সেই ফুটবল জগতের মহাতারকা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ২৪ বছরের এই তরুণ। রাশিয়া বিশ্বকাপে ২০১৮ সালে ফ্রান্সকে চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন। এবারের বিশ্বকাপে দলগতভাবে রানার্স হিসাবে শেষ করলেও ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনন্য নজির গড়লেন। কাতার বিশ্বকাপেই এই বয়সে পেলের গড়া রেকর্ড ভেঙে ২৪ বছরের বয়সের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিশ্বকাপ গোল করার রেকর্ড গড়ে ফেললেন, ২০২২ বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি মোট ৮টি গোল করে এই বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোল দাতার গোল্ডেন বুট পুরস্কার জয় করলেন আর সর্বোপরি বিশ্বকাপ ফাইনালে গোলের হ্যাটট্রিক করার বিরল নজির গড়লেন। এর আগে এই কৃতিত্ব দেখিয়েছেন শুধুমাত্র ইংল্যান্ডের জিওফ্রে হার্স্ট ১৯৬৬-এর বিশ্বকাপ ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির বিরুদ্ধে (তবে তার মধ্যে একটি গোল ভূতুড়ে গোল হিসাবে কুখ্যাত) আর তারপরেই ২০২২-এর বিশ্বকাপ ফাইনালে দুটি পেনাল্টিসহ তিনটি গোল করে বিশ্বকাপ ফাইনালে হ্যাটট্রিক করলেন এমবাপে। যদিও হার্স্ট ১৯৬৬ সালে ছিলেন বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন, এমবাপেকে এযাত্রা রানার্স হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হল। তবে তিনি যে ফুটবলবিশ্বের মহাতারকা তা আরও একবার প্রমাণ করে গেলেন।

আর অবশ্যই ফাইনালে যেভাবে খেলা হল তা বলতেই হয়। প্রথমার্ধ পুরোটাই ছিল আর্জেন্টিনার। ফ্রান্স কোনওভাবে বলের দখল নিতেই পারেনি। ২৩ মিনিটে আর্জেন্টিনার প্রাপ্ত পেনাল্টিটা নিঃসন্দেহে রেফারির সফট ডিসিশন কিন্তু ডি মারিয়াকে বাধা দেওয়া হয়েছিল পেনাল্টি বক্সের মধ্যে পেছন থেকে যখন বলের নিয়ন্ত্রণ ছিল মারিয়ার পায়ে। মেসি পেনাল্টি থেকে আবারও দলকে এগিয়ে দেন। তারপর সারা মাঠ জুড়ে এলবিসেলেস্তে জার্সির ছটা বিচ্ছুরিত হয়েছে। ম্যাচের ৩৬ মিনিটে ডি মারিয়ার গোলটা তো আর্জেন্টিনা ফুটবলের সার্বিক সৌন্দর্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। গোটা টুর্নামেন্টে সেভাবে সুযোগ পাননি মারিয়া, কিন্তু ফাইনালে নিজের বিদায়ী ম্যাচে অসাধারণ ফুটবল খেললেন এঞ্জেল ডি মারিয়া। মেসি-মারিয়া জুটির পাশাপাশি, আলভারেজ-ম্যাকএলিস্টার জুটিও কাঁপিয়ে দিলেন ফরাসি রক্ষণভাগ, সেইসঙ্গ ডি পলের কথাও আলাদাভাবে বলতেই হয়। দ্বিতীয়ার্ধেও প্রথম কুড়ি মিনিট ছিল আর্জেন্টিনার। দিদিয়ের দেশঁ প্রথমার্ধেই তুলে নিয়েছেন জিরৌউ আর দেমবেলেকে। দ্বিতীয়ার্ধে আর্জেন্টিনার ডি মারিয়া উঠে যাওয়ার পর ফ্রান্স আস্তে আস্তে খেলায় ফেরার চেষ্টা করল বটে কিন্তু গ্রিজম্যান আর হার্নান্ডেজ যখন উঠে গেলেন তখনও আর্জেন্টিনা ২-০ গোলে এগিয়ে। কিন্তু ঠিক নেদারল্যান্ডস ম্যাচের অনুসরণ করে পঁচাত্তর মিনিটের পর থেকে হঠাত কাঁপুনি ধরে গেল এতক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যাওয়া আর্জেন্টাইন রক্ষণভাগে। পরিবর্তিত কোপম্যান আর কোলো মোয়ানি আর্জেন্টিনার রক্ষণভাগে ফাটল ধরালেন। ফ্রান্সের হয়ে প্রথম পেনাল্টিটা আদায় করলেন কোপম্যানই। গ্রিজম্যান উঠে যাওয়ায় পেনাল্টি নিলেন এমবাপে এবং এমিলিয়ানো মার্টিনেজ সঠিক দিকে ঝাঁপিয়েও গোল আটকাতে পারলেন না। এতক্ষণ যাকে মাঠে দূরবীন দিয়ে খুঁজতে হচ্ছিল সেই এমবাপে যেন ঘুম ভাঙা দৈত্যের মতই জেগে উঠলেন। ৯৬ সেকেন্ডের মাথায় এমবাপে এক অসাধারণ গোল করে সমতা ফিরিয়ে আনলেন। নির্ধারিত সময়ের বাকি সময় ফ্রান্সের কর্তৃত্বই বেশি ছিল ম্যাচে। অতিরিক্ত সময়ে অবশ্য দুদলই সমানে সমানে লড়াই করল। একদলের পেনাল্টি বক্স থেকে অন্য দলের পেনাল্টি বকে মুহুর্মুহু আক্রমণ প্রতি-আক্রমণ উঠে আসতে শুরু করল। যখন তখন গোল হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হল উভয়পক্ষেই। গোল এল অবশ্য প্রথমে আর্জেন্টিনার পক্ষেই অতিরিক্ত সময়ের দ্বিতীয়ার্ধে এবং দলগত আক্রমণ থেকে সেই মেসিই গোল করলেন আবার। কিন্তু সেই অগ্রগমন বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। পরিবর্তিত মন্টিয়ল আর্জেন্টিনার পেনাল্টি বক্সের মধ্যে বল হাতে লাগিয়ে ফেলায় আবার পেনাল্টি পায় ফ্রান্স আর আবার গোল করলেন এমবাপে।

টাইব্রেকারেও আবার পেনাল্টি থেকে গোল করে ফ্রান্সের পক্ষে সদর্থক শুরু করেন সেই এমবাপেই। আর্জেন্টিনার হয়ে গোল করে শুরু করেন তাদের অধিনায়ক। কিন্তু কোপম্যানের শট আটকে টাইব্রেকারে নায়ক হয়ে গেলেন এমিলিয়ানো মার্টিনেজ, যিনি এই বিশ্বকাপের সেরা গোলকিপারের স্বীকৃতি হিসাবে পেলেন গোল্ডেন গ্লাভস পুরস্কার। ফ্রান্সের পরের শটটিও বাইরে যায়। অন্যদিকে আর্জেন্টিনার প্রতিটি পেনাল্টিই গোলে পরিণত হল। মন্টিয়লের পেনাল্টি শট জালে জড়িয়ে যেতেই তৃতীয়বারের জন্য বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায় আর্জেন্টিনা। অধরা স্বপ্ন পূরণ হয় লায়োনেল মেসির। অন্যদিকে আবারও বিশ্বকাপ ফাইনালে টাইব্রেকারের পেনাল্টি শুট-আউটে আটকে গেল ফ্রান্স। ২০০৬-এর বিশ্বকাপ ফাইনালেও তাদের ইতালির কাছে হারতে হয়েছিল টাইব্রেকারেই। ২০০২-এ এশিয়ার মাটিতে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে পন্মবারের জন্য বিশ্বকাপ জিতে নিয়ে গিয়েছিল ব্রাজিল তারপর আবার এশিয়ার মাটি থেকেই বিশ্বকাপ গেল আবার এক লাতিন আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনায়। এর মাঝের সবকটি বিশ্বকাপই জিতেছিল কোনও না কোনও ইউরোপের দেশ (২০০৬-ইতালি, ২০১০-স্পেন, ২০১৪-জার্মানি, ২০১৮-ফ্রান্স)। প্রত্যাশা মতই কাতার বিশ্বকাপের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় হিসাবে গোল্ডেন বল পুরস্কার জিতলেন মেসি। ১৯৯৪ সালের রোমারিওর পর আবার এমন কোনও খেলোয়াড় গোল্ডেন বল জিতলেন যিনি বিজয়ী দলের সদস্য (১৯৯৮-গোল্ডেন বল- ব্রাজিলের রোনাল্ডো নাজারিও দি লিমা, চ্যাম্পিয়ন-ফ্রান্স; ২০০২-গোল্ডেন বল- জার্মানির গোলরক্ষক অলিভার কান, চ্যাম্পিয়ন-ব্রাজিল; ২০০৬-গোল্ডেন বল- ফ্রান্সের জিনেদিনে ইয়াজিদ জিদান, চ্যাম্পিয়ন-ইতালি; ২০১০-গোল্ডেন বল- উরুগুয়ের দিয়েগো ফোরলান, চ্যাম্পিয়ন-স্পেন; ২০১৪-গোল্ডেন বল- আর্জেন্টিনার লায়োনেল মেসি, চ্যাম্পিয়ন-জার্মানি; ২০১৮-গোল্ডেন বল- ক্রোয়েশিয়ার লিকা মডরিচ, চ্যাম্পিয়ন-ফ্রান্স)। সর্বপরি আবারও জয়যুক্ত হল ফুটবলের মহিমা। আরও একবার প্রমাণ হল ফুটবলের সৌন্দর্য, আরও একবার জিতে গেল ফুটবলের আবেগ যা ফুটে বেরোলো মেসির হাসির সারল্যে, ডি মারিয়ার অঝোর কান্নায়, দিদিয়ের দেশঁর হতাশায়, লায়োনেল স্কালোনির মুষ্টিবদ্ধ হাসিতে, এমিলিয়ানো মার্টিনেজের নাচে আর কিলিয়ান এমবাপের উদাস দৃষ্টিতে। ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপ সত্যিই মানব ঐক্যের মঞ্চ, যার এক এবং একমাত্র মাধ্যম ফুটবল। তাই কাতার বিশ্বকাপেও সর্বশ্রেষ্ঠ বিজয়ীর নাম ফুটবল, ফুটবল আর ফুটবল।    

0 Comments

Post Comment