আবারো অঘটন ঘটল কাতার বিশ্বকাপে। এশিয়ার সৌদি আরব আর জাপানের পর এবারে অঘটন ঘটালো আফ্রিকার মরক্কো। তারা কিছুটা অপরত্যাশিতভাবেই হারিয়ে দিল শক্তিশালী ইউরোপীয় ফুটবল দল বেলজিয়ামকে। নিঃসন্দেহে কাতার বিশ্বকাপ অঘটনের ঘনঘটায় পরিপূর্ণ। বিতর্ক এবং বিস্ময় এই বিশ্বকাপের মূলপর্বের শুরুর আগে থেকেই ছিল, বিশ্বকাপ শুরুর পর একের পর এক অঘটন ঘটে চলেছে বিভিন্ন ম্যাচে। দিনকয়েক আগেই এশিয়ার দুই দেশ সৌদি আরব এবং জাপান ফুটবলবিশ্বের দুই মহাশক্তিধর দেশ আর্জেন্টিনা ও জার্মানীকে হারিয়ে ফুটবলবিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। যদিও তারা তাদের এই পারফরম্যান্স ধরে রাখতে পারেনি। সৌদি আরব পরাজিত হয়েছে পোল্যান্ডের কাছে তাদের দ্বিতীয় ম্যাচে আর এদিন জাপানও ভালো খেলেও পরাজিত হল কোস্টারিকার কাছে ০-১ গোলে। বিশ্বকাপের রোলার কোস্টার রাইড অব্যাহত। এই কোস্টারিকাই তাদের প্রথম ম্যাচে ধ্বংস হয়েছিল স্পেনের কাছে ০-৭ গোলে, কিন্তু কোস্টারিকা তাদের বিশ্বকাপে পরবর্তী রাউন্ডে যাওয়ার আশা জিইয়ে রাখল জাপানকে ০-১ গোলে পরাজিত করে। তবে আফ্রিকা মহাদেশের আরব দেশ মরক্কো এদিন অঘটন ঘটালো। গত রাশিয়া বিশ্বকাপের তৃতীয় স্থানাধিকারী দেশ বেলজিয়ামকে তারা হারিয়ে দিল ২-০ গোলে। বেলজিয়াম তাদের প্রথম ম্যাচে কোনওরকমে জয় পেয়েছিল নবাগত কানাডার বিরুদ্ধে ১-০ গোলের ব্যবধানে। কিন্তু এদিন মরক্কো তাদেরকে পরাজয়ের সামনে ঠেলে দিল। বেলজিয়ামের তারকা ফুটবলার ইডেব হ্যাজার্ড, রোমেলু লুকাকুরা এবারে বিশ্বকাপে প্রথম দুটি ম্যাচেই বেশ নিষ্প্রভ ছিলেন। অন্যদিকে মরক্কোকে ধরা হচ্ছিল এবারের বিশ্বকাপের এই গ্রুপের সবচেয়ে দুর্বল দল হিসাবে। মরক্কো এর আগে কোনওদিন বিশ্বকাপের মূলপর্বে প্রথম রাউন্ডের গন্ডি পেরোতে পারেনি। কিন্তু বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে তাদের এই স্মরণীয় জয় তাদেরকে এবারের কাতার বিশ্বকাপে পরবর্তী রাউন্ডে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। খেলার প্রথমদিকে বেলজিয়াম আক্রমণের ঝাঁঝ দেখালেও খেলা যত এগিয়েছে তত আক্রমণের চাপ বাড়িয়েছে মরক্কো। দ্বিতীয়ার্ধের ৭৩ মিনিটে মরক্কোর সাবিরির ফ্রিকিকে শরীর ছুইয়ে গোল পেয়ে যান রোমেইন সেইস। খেলার ৯০ নির্ধারিত ৯০ মিনিট অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পর দলগত তালমিলে মরক্কোর দ্বিতীয় গোল আসে। দারুণ গোল করেন জাকারিয়া আবৌখলাল। এই জয় মরক্কোকে গ্রুপ থেকে পরবর্তী রাউন্ডে যাওয়ার আশা জোগালেও বেলজিয়ামের কাছে পরিস্থিতি কঠিন হয়ে গেল। কারণ গ্রুপে তাদের শেষ ম্যাচ শক্তিশালী এবং বিগত রাশিয়া বিশ্বকাপের রানার্স ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে।
ক্রোয়েশিয়া প্রথম ম্যাচে আটকে গিয়েছিল মরক্কোর বিরুদ্ধে। এদিনও তাদের কানাডার বিরুদ্ধে সূচনা ছিল কাঁপুনি ধরিয়ে দেওয়ার মত। ম্যাচের দুমিনিটেই ঝটিতি আক্রমণে গোল করে যান কান্ডার আলফানসো ডেভিস। ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে বেশ নজর কাড়া ফুটবল খেললেন এই ডেভিস। প্রথমার্ধের ২০ মিনিট খেলায় আক্রমণের চাপ ছিল কানাডারই বেশি, কিন্তু তারপর যত খেলা এগিয়েছে খেলার রাশ নিজেদের পায়ে নিয়ে নিয়েছেন লুকা মডরিচ, পেরিসিচরা। লুকা মডরিচ কানাডার বিরুদ্ধে কিছুটা নিষ্প্রভ থাকলেও পেরিসিচ কিন্তু এই বয়সেও এখনও অনবদ্য ফুটবল খেলে যাচ্ছেন। কানাডার বিরুদ্ধে ক্রোয়েশিয়ার বাম প্রান্তকে সচল করে তোলেন পেরিসিচই। প্রথমার্ধের ৩৬ মিনিটে ক্রামারিচের গোলে সমতা ফেরায় ক্রোয়েশিয়া আর ৪৪ মিনিটে দলকে এগিয়ে দেন লিভাজা। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুর কয়েক মিনিট কানাডা গোল শোধের মরিয়া চেষ্টা চালালেও পরে খেলা থেকে তারা সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে যায়। ক্রামারিচ ৭০ মিনিটে তার দ্বিতীয় গোল করেন। ৩-১-এ এগিয়ে থাকা অবস্থায় খেলার অতিরিক্ত সময়ে কানাডার ডিফেন্ডার মিলারের ভুলে বল পেয়ে গতি বাড়িয়ে বিপক্ষের বক্সে পৌছে যান ওরসিচ, কিন্তু নিজের গোলসংখ্যা বাড়ানোর বদলে দলের গোলসংখ্যা বৃদ্ধি সুনিশ্চিত করতে অরক্ষিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা মাজেরের দিকে বল এগিয়ে দেন তিনি। স্কোরবোর্ডকে ৪-১ করতে কোনও ভুল করেননি মাজের। এই হারের ফলে কানাডার বিদায় সুনিশ্চিত হয়ে গেল এবারের বিশ্বকাপ থেকে আর বিশ্বকাপ রানার্সরা আরও একধাপ এগিয়ে গেল পরবর্তী রাউন্ডের দিকে।
তবে যে দুটি দেশের মধ্যে মহারণের লগ্ন ছিল সেই স্পেন-জার্মানী ম্যাচ শেষ হল অমীমাংসিতভাবে। ২০১০-এর বিশ্বচ্যাম্পিয়ন স্পেন ২০১৪-র ব্রাজিল বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছিল প্রথম রাউন্ডেই। সেই বিশ্বকাপ অর্থাৎ ২০১৪ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন জার্মানী আবার ২০১৮ বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নিয়েছিল। তবে ২০১৮ বিশ্বকাপেও জার্মানী প্রথম ম্যাচে মেক্সিকোর কাছে পরাজিত হওয়ার পর দ্বিতীয় ম্যাচে হারিয়েছিল সুইডেনকে। কিন্তু এবারে কাতারে দুটি ম্যাচ খেলার পরও জয়ের মুখ দেখল না জার্মানরা। স্পেন ৭-০ গোলে তাদের প্রথম ম্যাচে কোস্টারিকাকে হারানোর পথে ৮১% বল নিয়ন্ত্রণ রেখেছিল। সেই ম্যাচে কার্যত স্পেনের রক্ষণভাগকে কোনও চাপই নিতে হয়নি। এদিনও প্রায় ৬৫% বল নিয়ন্ত্রণ নিজেদের দখলে রাখলেও জার্মান প্রতি-আক্রমণের চাপে বেশ কয়েকবার বেশ নড়বড়ে দেখালো স্পেন রক্ষণভাগকে। স্পেনের গোলরক্ষক সিমোন বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে অপ্রতিরোধ্য হয়ে কয়েকটি দুর্দান্ত সেভ না করলে এই ম্যাচের ফল অন্যরকম হতেই পারত। জার্মানী প্রত্যাশা মতই গতি ও শক্তির মিশ্রণে ফুটবল খেলল, এটাই তাদের চিরাচরিত রীতি। কিন্তু স্পেন তাদের সম্পূর্ণ তিকিতাকাকে অনুসরণ না করে হাল্কা পাসের সঙ্গে গতি বাড়িয়ে ঝটিতি আক্রমণে যাওয়ার চেষ্টাও করল। কোথাও কোথাও পাল্লা দিয়ে জার্মানীর সঙ্গে ফুটবলশক্তির প্রয়োগ করতে গেল তাতাএ কোথাও কোথাও স্প্যানিশ ফুটবলের ছন্দবদ্ধ পাসিং-এর সৌন্দর্য বিঘ্নিতও হল। যদিও ম্যাচের প্রথমার্ধ গোলশূন্য থাকার পর দ্বিতীয়ার্ধের ৬২ মিনিটে পরিবর্ত খেলোয়াড় এলভারো মোরাতা দর্শনীয় গোল করে স্পেনকে এগিয়ে দেয়। এর আগে ২০০৮ ইউরো ফাইনালে লুই আরাগনেস-এর প্রশিক্ষণাধীনে এবং ২০১০ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে দেল বস্কির প্রশিক্ষণাধীনে স্পেন জার্মানীকে হারিয়েছিল ১-০ গোলের ব্যবধানে। যখন মনে হচ্ছে বর্তমান স্প্যানিশ কোচ লুইস এনরিকেও সেই একই ঐতিহ্য বজায় রাখতে চলেছেন তখনই একের পর এক জার্মান আক্রমণে কাঁপতে শুরু করে স্প্যানিশ ডিফেন্স। আগের দুই ক্ষেত্রেই জার্মান কোচ ছিলেন জোয়াকিম লো কিন্তু এবারে কোচ হ্যান্সি ফ্লিক। জার্মানীর মোসিয়ালা ৭২ মিনিটে সহজ সুযোগ নষ্ট না করলে জার্মানীকে ম্যাচের পর এত দুশ্চিন্তায় থাকতে হত না। ৮৩ মিনিটে নিকলাস ফুলকুর্গ জার্মানীর পক্ষে সমতা ফিরিয়ে আনেন। কিন্তু এই ম্যাচে স্পেনের চেয়েও জয় বেশী দরকার ছিল জার্মানীর। কিন্তু কাঙ্খিত সেই জয় না আশায় পরপর দুই বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায়ের খাঁড়া ঝুলছে জার্মানীর মাথার ওপর। স্পেন চার পয়েন্ট নিয়ে এই মুহুর্তে এই গ্রুপের শীর্ষে। তাদের শেষ ম্যাচ জাপানের বিরুদ্ধে। জাপান কোস্টারিকার কাছে হেরে যাওয়ায় গ্রুপের তলানিতে এক পয়েন্ট নিয়ে থাকা জার্মানীর বিশ্বকাপে টিকে থাকার আশা এখনও জীবিত রয়েছে কিন্তু তা বড়ই ক্ষীণ। তাদের গ্রুপের শেষ ম্যাচ কোস্টারিকার বিরুদ্ধে। এই গ্রুপ এখনও পুরো ওপেন। প্রথম রাউন্ডের তৃতীয় ও শেষ পর্বের খেলাগুলিতেই স্থগির হবে কারা পরবর্তী রাউন্ডে উঠবে আর কারা বিদায় নিয়ে স্বদেশে ফিরে যাবে। তবে স্পেন-জার্মানী দ্বৈরথ ১-১ গোলে অমীমাংসিত থেকে যাওয়ায় জার্মানীর অস্বস্তি কিন্তু থেকেই গেল। আর্জেন্টিনা সৌদি আরবের কাছে পরাজিত হয়েও মেসির নেতৃত্বে মেক্সিকোর বিরুদ্ধে জয় পেয়ে দুর্দান্তভাবে ফিরে এসেছে কিন্তু জার্মানী সেরকম কিছু তাদের দ্বিতীয় ম্যাচে স্পেনের বিরুদ্ধে করে দেখাতে না পারায় এখনও গ্রুপের তলানি অবস্থানে থেকে তারা অস্বস্তিতেই রয়ে গেল।