এত অসুস্থ! সতর্ক করলে বলতে, এত সহজে মরছি না। দেখে নিস। কিন্তু কি অদ্ভুত! তুমি মরে গেলে। কিছুটা বিনা চিকিৎসায়। বাকিটা চিকিৎসার ভুলে।
কলেজ ক্যান্টিনের সেই দিন গুলি ভুলি কি করে বাচ্চুদা? ৪০ বছর আগের সেই ভরা শ্রাবণের দিন। কৃষ্ণচূড়ার নিচে, স্কটিশ এর ক্যান্টিন। ১৯৮৪ সালের জুন জুলাই। প্রশ্ন করলেই তোমার লম্বা চুলে হাত চালিয়ে বলতে, আমি বলছি। দেখে নিস। মিলিয়ে নিস। তোমার অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস দেখে অবাক হয়েছি। ভয় পেয়েছি। আজ স্বীকার করছি।
সেই ১৯৮৪ সালের বিষন্ন সবুজ মেঘলা বিকেলে তুমি বলতে, আমরা সিপিএমের দলতন্ত্র ভেঙে দিয়েছি। আমরা কংগ্রেসের কফিনে পেরেক পুঁতে দিয়েছি। তোরা কলেজে ইউনিয়নের ভোটে জিতেছিস। আমাদের ছেলেরা প্রেসিডেন্সি, অন্য কলেজে জিতছে। সামনে বিহারের আররোয়ালের ঘটনা। জোট বাঁধছে সবাই। IPF তৈরি হল। এই আগুন ছড়িয়ে পড়বে। শুধু দেখে যা ।
বাচ্চুদা, I am sorry। এই ভাবে আগুন ছড়ায় না। কিন্তু তোমার কথা গুলি আগুনের ফুলকির মত রয়ে গিয়েছে। আজও। মনের গভীরে।
তখন কোথায় ফ্যাসিস্ট মোদী! কোথায় বিজেপি! আরএসএস? ওরা সংসদে মাত্র দুই! ওরা মানে মোদীর পিতৃ পুরুষ। তখন আমাদের সামনে ৪০০ পার রাজীব গাঁধী। তাঁর বন্ধু শ্যাম পিত্রদা। নব্য অর্থনীতি। কম্পিউটার। যা মানুষের কাজ কেড়ে নেয়। আমাদের আঠারো উনিশের রক্ত গরম হওয়া স্বাভাবিক।
বাচ্ছুদা তুমি কোনও দিন হাত পেতে কারও কাছে কিছু নিওনি। কিছু চাওনি। শুধুই বিলোতে। ডাক্তার অনেক কিছুর ওপর "না" করেছিলেন। যদিও তুমি মানতে না সেই এসব নিষেধ।
দীর্ঘ অসুস্থ । মাস ছয়েক আগে একদিন খেতে চাইলে। বললাম ক্লাবে এসো। কোনও এক মানবাধিকার সংগঠনের মিছিলে যোগদানের শিয়ালদহ থেকে এলে। বললে , হেঁটে এলাম। বুঝলি, ফার্স্ট ক্লাস আছি।
প্রচুর আড্ডা হলো। বললে, দেখ এই এসব কাজ চালিয়ে যেতেই হবে। থামলে চলবে না। তোর পরিবেশ আন্দোলন কিন্তু চালিয়ে যেতেই হবে। সমস্যায় পড়লে ফোন করিস।
রাম ছাড়া তোমাকে কোনও দিন হুইস্কি বা ভদকা খেতে দেখিনি। স্নেহাশিসদা ( প্রেস ক্লাবের সভাপতি) আজ বললেন, তুমি ওঁর স্ত্রীর সঙ্গে পড়তে। তাই ওঁর কঠিন নির্দেশ ছিল তোমাকে ক্লাবে যেন মদ না দেওয়া হয়। কারণ তোমার শরীর ভালো নয়। কিন্তু তুমি যে চির বিপ্লবী। এই নির্দেশ তুমি মানবে কেন ? তাহলে তো তোমার তুমির অসন্মান হয়। তাই নানা ছল চাতুরি করতে।
একটা কথা বলবো বাচ্চুদা? তোমাকে হিংসে করতাম। ঈর্ষা হত। তোমার ছয় ফুট উচ্চতা। তোমায় কাঁধ অব্দি চুল। তোমার আকর্ষণীয় চাহুনি। তোমার উন্নত নাক। তোমার অনর্গল বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলার ক্ষমতা। পকেট শূন্য জেনেও মানুষকে সাহায্যের আশ্বাস। তার জন্যে প্রয়োজন পড়লে অন্যের কাছে ধার চাওয়া। আর শুধুই মানুষের কথা বলা। সাধারণ মানুষ। যাঁরা ইতিহাস গড়ে। কিন্তু যাদের নাম থাকে না। আর কথার মাঝে চুলের মধ্যে হাত চালানো।
আমি অসমে ট্রান্সফার হওয়ার কথা শুনে টেবিলে জমিয়ে বসে বললে, "ওরে নর্থ ইস্ট এর মেয়েরা বড্ড বেশি স্নেহ করে। সহজেই প্রেমিকা হয়ে যায়। তখন মায়া কাটানো কঠিন। আগাম বলে দিলাম!"
শুনলাম। ঘাড় নাড়লাম। অর্থাৎ সতর্ক হলাম!
পরে বুঝেছি, ওটা তোমার জীবনের উপাখ্যান। কিন্তু প্রকাশ্যে স্বীকার করনি। পরে তোমার বই এর লেখায় প্রকাশ পেয়েছে। পরে তোমায় শুধিয়েছি। ওই একটাই কথা, ছাড় তো! একলা মানুষের জীবন। এই বেশ ভালো আছি। একটা বেড়ালকে খাওয়াই। ওটাই আমার দায়িত্ব।
বাচ্চু দা, আর কোনও দিন তুমি বলবে না, ছাড় তো!
কারণ, এখন কেউ তোমার মত করে ভাবে না।
কেউ বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে না। সবাই জানে কলেজে পড়তে গিয়ে কেরিয়ার গড়াটাই আসল কাজ। তোমার মত কেউ আর "অ - কাজ" করে সময় নষ্ট করে না।
পুনঃ
বাচ্চু দা আসলে তুমি মরিয়া প্রমাণ করিলে মর নাই।
কারণ, তুমি জানো না এই তিন দিন আমাদের দেখা সোশ্যাল মিডিয়া, বিশেষ করে ফেসবুক জুড়ে ছিল তোমার স্মৃতি চারণ।
তোমার নিজের গোটা চাকরি জীবন সব সময়েই ছিল টলমল। কিন্তু তোমার একাধিক ভক্ত, হ্যাঁ ইচ্ছে করেই এই "ভক্ত" শব্দ টা ব্যবহার করলাম, জানাচ্ছেন যে, তুমি তাঁদের প্রথম চাকরি বা কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলে!! যাঁরা লিখছেন, তাঁরা অধিকাংশই আজ জীবনে নিজের নিজের মত করে প্রতিষ্ঠিত।
কেউ বলছে, তোমার হাত ধরে সে উত্তরবঙ্গ চিনেছে। কেউ বলছে, পাহাড় আর চা বাগানের জীবন চিনেছে। কেউ বলছে নদী চিনেছে। আবার কেউ বলছে গ্রাম বাংলা জঙ্গল মহল চিনেছে। তোমার একাধিক মহিলা ভক্ত বা অনুরাগী জানাচ্ছেন, তুমি কেউকে কপি লিখতে শিখিয়েছ। কেউ বলছে, তুমি তাকে একটা বিশেষ পাখির নামে ডাকতে। আমাদের পরিচিত আর্টিস্ট সেন্টু লিখেছে, তোমার নামে তোমার কার্টুন এঁকে নিয়মিত টিভির পর্দায় খবর-পাঠক হিসেবে দেখানো হত। এবং লেখাটা পড়ার পর মনে হয়েছে, ঠিকই তো আমিও বহু দেখেছি।
কেউ বলছে, তুমি তার পাঁচ বছরের শিশু কন্যার বন্ধু ছিলে। কেউ বলছে, তোমার সঙ্গে ঝগড়া হয়ে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হওয়ার আগে অব্দি কত রাত একসঙ্গে আড্ডা দিয়েছে। এমনকি তোমার কোন দাঁতে ব্যথা সেটাও সে জানতো।
কেউ লিখছে, তুমি যখন স্কটিশ এর ছাত্র, কি ভাবে প্রতি বছর ছাত্র পরিষদ আর এর এস এফ আইয়ের মুখে ছাই দিয়ে স্টুডেন্ট ইউনিয়ন জিতে ভক্তদের কোলে কলেজের লোহার গেট পেরিয়ে হেদুয়ার মুখে এসে নামতে। সারা অঙ্গে তোমার তখন লাল আবির। উত্তর কলকাতার রাজপথে তখন বিপ্লবের দামামা বাজতে শোনা যেত!
তোমার কঠিন এবং বিরল অসুখ, তোমার ভুল চিকিৎসা তোমাকে দমাতে পারেনি বাচ্চুদা।
তুমি চলে যাওয়ার ৬০ ঘণ্টা পরে বুঝতে পারছি, এই মধ্যমেধা এবং আমাদের মত মধ্যবিত্ত, কুপমণ্ডুক বাঙালিদের জগতে বিচরণ করেও তুমি আসলে অনেকটাই এগিয়েছিলে। তাই শেষ যাত্রায় জিতে বেরিয়ে গিয়েছ অশ্বমেধের ঘোড়ার মত।
দেবাশিস আইচ যে বইগুলো লিখেছেন তার অন্যতম দহননামা।
সহমনে প্রকাশিত দেবাশিস আইচের কিছু লেখার সূত্র।
নিছক মৃত্যু নয়, এ এক বিচারবিভাগীয় হত্যাকাণ্ড
সিট ও সিবিআই : একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ